মুফতি খন্দকার নূরে আলম চিশতী
সময়ের পরিক্রমায় মানুষের মাঝে চিন্তা, উপলব্ধি ও আক্বিদাগত বিভিন্ন পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এ পার্থক্য কালক্রমে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে ঐশী ধর্মের অনুসারীদের মাঝে তৈরী করে বিচ্ছিন্নতা। এ কথা স্বীকার্য যে, এই বিচ্ছিন্নতা তথা বিভিন্ন ফেরকা গুলো দ্বীনের ঐক্যকে টার্গেট করে বিভক্তির তীর নিক্ষেপ করে চলেছে। ইসলাম সার্বজনীন ঐক্যের ধর্ম। বিভিন্ন ফেরকা বা দলমতগুলো মুখে ঐক্যের কথা বললেও বাস্তবে এরা ইসলাম হতে ছিটকে পড়েছে।
হক-বাতিল আর সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব আবহমানকালের। এ সংঘাত প্রথম মানব ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ) ও বিতাড়িত ইবলিশের মাঝে আরম্ভ হয়ে আজ অব্দি চলমান। আল্লাহপাক বলেন, মুনাফিকরা আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে তাদের ব্যর্থ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে (সুরা তাওবা ৩২, সুরা ছাফ ০৮)। তারই ধারাবাহিকতায় চিরদিনই ধর্মের দুশমনরা বিভিন্ন ছলে বলে কৌশলে ধর্মীয় পরিমন্ডলে প্রবেশ করে অব্যাহত রেখেছে তাদের দুশমনি। ধর্মীয় ছদ্মাবরণে থেকে তারা ধ্বংস করার পাঁয়তারা করেছে ধর্মকে।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়া’লা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম এর জীবদ্দশা থেকেই শুরু করে একদল ধর্মবিরোধী চক্র দ্বীনে মুহাম্মদীর আসল হাকিকত কে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে শুরু করে দূরভিসন্ধীমূলক অপতৎপরতা। যা মারাত্মক পরিণতি লাভ করে ৬১ হিজরীতে কারবালায়। আহলে বাইয়্যেতের অন্যতম সদস্য, মা ফাতেমার নয়ন মণি, ইমাম হোসাইন (আ) এবং তার পরিবার, অনুসারীদের সকলের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে।
ধর্মবিরোধী দুশমনদের পরবর্তী চক্র আত্মপ্রকাশ করে নজদ প্রদেশ হতে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা) বলেছিলেন, নজদ হতে শয়তানের দুটি শিং বাহির হবে। যারা হলেন যথাক্রমে – মিথ্যা নবুয়তের দাবিদার মুসায়লামা কাজ্জাব এবং ভ্রান্ত ওহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী। এই ভ্রান্ত ওহাব নজদী এবং তার অনুসারীদের দ্বারাই দ্বীনে মুহাম্মদীর ওপর আসে অন্যতম বড় আঘাত। তাদের সম্পর্কের রাসুল (সা) বলেছিলেন, শেষ যামানায় এমন একদল লোকের উদ্ভব হবে, যারা কুরআন পড়বে কিন্তু কুরআন তাদের কন্ঠের নিচে নামবে না (হৃদয়ে পৌছবে না)। তারা ইসলাম থেকে এমন ভাবে দূরে সরে যাবে যেমন ভাবে ধনুক থেকে তীর বের হয়ে যায়। তাদের অন্যান্য আরো লক্ষণ হলো, তারা নামাজ পড়তে পড়তে কপালে কালো দাগ করে ফেলবে। কথায় কথায় তসবীহ পড়বে, সুমধুর কন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করবে, ইসলামের মূল কাজ বাদ দিয়ে সামাজিক কাজগুলোর ওপর বেশী জোর দিবে। এদের প্রবর্তকের নাম জুল খুয়াইসারা।
এরা একের পর এক নাম পাল্টায়ে বের হতেই থাকবে, শেষ পর্যন্ত এদের দলটি দাজ্জালের দলের সাথে মিলিত হবে।
অন্য মতে বলা হয়, যদি তোমরা তাদের সাক্ষাৎ পাও তবে তাদের হত্যা করো। তারা সৃষ্টির মধ্যে সবচাইতে নিকৃষ্ট। নবীজি বলেছেন, যদি আমি তাদেরকে পেতাম, তাহলে আদ জাতির মতো তাদের হত্যা করতাম।
এরাই ধর্মীয় ছদ্মাবরণে থেকে উদ্গার করছে বিভেদ বৈষম্যের বিষবাস্প। সাধারন মানুষ বুঝতে না পেরে পা দিচ্ছে তাদের ফাঁদে। তারাও হরণ করে নিচ্ছে মানুষের ঈমান।
ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান বা হাকিকত যুগে যুগে সংরক্ষিত হয়েছে ওলী মুর্শিদ তথা জ্ঞানী মানুষদের সিনায় সিনায়। ধর্মজগতে প্রচলিত সকল ভ্রান্ত মতবাদ থেকে বের হয়ে ওলী মুর্শিদের শরনাপন্ন হলেই পাওয়া যাবে সে ইলমে এলাহী বা ইলমে নববী বা খোদার পরিচয় জ্ঞান। যে জ্ঞান লাভ করলে বুঝা যাবে ধর্মের হাকিকত।
ইসলাম হলো সার্বজনীন স্বভাব ধর্ম। মাওলার ফেতরাত বা ইনছানিয়াত যার মধ্যে জাগ্রত তিনিই মুসলমান। মানুষ আল্লাহর ফেতরাতে সৃষ্টি (সুরা রুম-৩০)। আমরা ক্রমে সে গুনসমূহ হারিয়ে পশুত্বের গুণ খাছিয়ত তথা আঠারো হাজার মাখলুকাতের গুণ খাছিয়তকে ধারন করে মনুষ্যত্ব থেকে নির্বাসিত হয়েছি অনেক দূরে (দুনিয়ায়)। কাজেই পূর্বের স্বভাব তথা ¯্রষ্টার স্বভাব বা ফিতরাতাল্লাহ ফিরে পাওয়াই বা পাওয়ার প্রচেষ্টাই হলো ধর্ম কর্ম বা গুরুসাধনা।
যিনি ইলমে সিনার অধিকারী তথা ওলী মুর্শিদ, তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করলে বা ধর্মকর্ম করলে তবেই লাভ হবে মুক্তি। এ পথে স্বীয় আমিত্বটিকে মুর্শিদের চরণে সমর্পন করতে হয় বা বিসর্জন দিতে হয়। যে কথা বলা হয়েছে সুরা ফাতাহ এর ১০ নম্বর আয়াতে। সুরা বনী ইসরাইলের ৯৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন সেই সঠিক পথ প্রাপ্ত আর যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোনো অভিভাবক পাবেন না। এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন মুখের ওপর ভর করে উঠাবো অন্ধ, মূক ও বধির করে।’
আপনত্বে পরম সত্ত্বা প্রাপ্তির অনুশীলনে, মহান ¯্রষ্টার স্বভাব ধারন করে তাঁর তথা তার ওলী মুর্শিদের পায়রবী গোলামীর মধ্য দিয়ে নিজেকে স্থিত করতে হয় মুক্তির ধামে। এটাই ইসলাম। মহান প্রভু আমাদের সবাইকে সরল সঠিক পথের দেশনা দান করুন। আমিন।