লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
যুগে যুগে এ ধরনীতে আবির্ভূত হন স্রষ্টার কিছু প্রিয় বান্দা। যারা তাদের জিবনকালে মানুষকে ঐশী প্রেমের আচার শিখিয়ে আবার প্রস্থান করেন মহান জাতপাকের স্বানিধ্যে। তাদের সমগ্র জিবনটাই হয় দুনিয়ার কামকামনা মোহলিপ্সায় জর্জরিত মানুষের জন্য শিক্ষা। তারাই যুগের শ্রেষ্ঠতম সত্ত্বা। তাদের অনুকরণ-অনুসরণের জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে সকল ধর্মেই। আমাদের আজকের আলোচনায় থাকছে এমনই এ জোতির্ময় সত্ত্বা “হযরত খাজা ওয়ায়েস করনী”।
খাজা ওয়ায়েস করনী এর নবী প্রেম
হযরত খাজা ওয়ায়েস করনী হলেন সর্বোত্তম নবী প্রেমিক। রাসুল (সা) মাঝে মাঝেই ইয়ামেনের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘আমি ইয়েমেনের দিক থেকে রহমতের সুগন্ধি পাচ্ছি।’ তার নবী প্রেমের দৃষ্টান্ত কিংবদন্তীতূল্য। ওহুদের ময়দানে মুসলিম বাহিনী ও কাফিরদের যুদ্ধে নবী আহত হন এবং পাথরের আঘাতে তার মুখের একটি দাত মোবারক শহীদ হয়। এ সংবাদ শোনা মাত্র নবী প্রেমিক ওয়ায়েস করনী নিজে নিজে পাথরের আঘাতে একটি একটি করে তার মুখের সবকটি দাত উপড়ে ফেলেন। নবী প্রেমের এমন দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
নবী (সা) কর্তৃক জুব্বা লাভ
নবী করীম (সা) এর দেহত্যাগের সময়কাল নিকটবর্তী হইলে সাহাবীগণ নবী (সা) কে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁর গায়ের পবিত্র জামা মোবারক কাকে দেয়া হবে। নবী (সা) জানালেন, ইয়েমেনের ক্বরণ জঙ্গলে বসবাসরত নবী পাগল ওয়ায়েস করনীর কথা। পরবর্তীতে সাহাবীগন নবী (সা) এর গায়ের জামা মুবারক ওয়ায়েস করনীকে পৌঁছে দেন। তখন ওয়ায়েস ক্বরণী নবী পাকের গুনাহগার উম্মতগণের জন্য দোয়া করেন।
জীবন-যাপন
ওয়ায়েস করনী ছিলেন সংসারত্যাগী সিদ্ধপুরুষ। তিনি তার লোকসমাগম সবসময়ই অপছন্দ করতেন। বৃদ্ধ মাকে সঙ্গে নিয়ে ক্বরণ জঙ্গলে নিরিবিলি বাস করতেন। দিনের বেলা জঙ্গলে উট চড়াতেন আর সারারাত প্রভূর উপাসনায় নিবিষ্ট থাকতেন। তার উপসনাও ছিল বড় অদ্ভুত! কখনো তিনি বলতেন, “রাত এতো ছোট যে, একটিমাত্র সেজদাতে রাত শেষ হয়ে যায়”, আবার বলতেন, ‘সময় এতো সংকীর্ণ যে একটিমাত্র রুকুতেই রাত পোহায়ে যায়”।
সারারাত জেগে জেগে উপসনায় মগ্ন থাকতেন তিনি। যদি লোকে তাকে জিজ্ঞেস করতো “কেমন আছেন আপনি?” তিনি উত্তর করতেন, “যে ভোরে উঠে বলতে পারে না সন্ধ্যা অব্দি সে বেঁচে থাকবে কিনা, সে আর কেমন থাকতে পারে?”
হযরত ওয়ায়েস করনী এর মর্যাদা
হযরত ওয়ায়েস করনী ছিলেন নবী পরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠতম ওলী, সিদ্ধ পুরুষ তথা ইনসানে কামিল। অসাধারন নবীপ্রেমের জন্য বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। তার অনবদ্য প্রজ্ঞা, ইলমে মারেফত জ্ঞান ও সর্বপরি ইশকে রাসুল তাকে যুগশ্রেষ্ঠ ওলীতে পরিণত করেছে। তার উপদেশগুলি নবী জাগ্রত করে ও ইলমে মারেফতের পথের পথিকদের আত্মার খোরাক যোগায়। ইবনে হিব্বান এর সাথে সাক্ষাৎকালে হযরত ওয়ায়েস করনী তাকে বলেন, “যিনি আল্লাহকে চিনেছেন, তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ভালোবাসায় শান্তি পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। জেনে রাখুন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কেউ কোনোদিন সুখী হতে পারে না।” তিনি আরো বলেন, “যখন ঘুমিয়ে যাবেন, তখন মনে করবেন, মৃত্যু আপনার শিয়রে। যখন জেগে থাকবেন তখ জানবেন, মৃত্যু রয়েছে আপনার চোখের সামনে। কোনো পাপকে ছোট মনে করবেন না। কেননা, পাপকে ছোট মনে করাও পাপ।”
ইলমে মারেফতের পথে
হযরত খাজা ওয়ায়েস আল করনী এক ঐশী রহস্যে পরিব্যপ্ত হয়ে রাসুল (সা) এর জীবদ্দশায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন নাই। রাসুল (সা) ইন্তেকালের পর তিনি শেষ বয়সে হযরত আলীর সাথে একত্রিত হন। হযরত আলী সাথে দীর্ঘ সময় সহাবস্থানের ফলে তিনি ইলমে মারেফত তথা ইলমে হাকিকি অর্জন করেন এবং মাওলা আলী হতে মাওলাইয়াত প্রাপ্ত হন। নবী কারীম (সা) এর গুপ্তজ্ঞান, যা মাওলা আলীর মাধ্যমে সিনা-ব-সিনা ফল্গুধারার মতো প্রবাহমান, সে নিত্য জ্ঞানের ধারায় নিজেকে যুক্ত করে খাজা ওয়ায়েস করণী লাভ করেন ইলমে নববীর অমৃতসুধা।
ওফাত
হযরত খাজা ওয়ায়েস করনী তাঁর নবী প্রেমে উৎসর্গীকৃত জীবন যাপনের পরিনতিতে মাওলা আলী এর সাথে মুয়াবিয়ার সংঘাতকালীন সময়ে সিফফীনের যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। শেষ বয়সেও তিনি অসীম তেজ সহযোগে মুয়াবিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ করে শাহাদাতের পীযুষধারা পান করেন। মুর্শিদ মাওলা আলীর কোলে মাথা রেখে ইতি টানেন তিনি প্রেমময় জীবনের।
পরিশেষ
হযরত খাজা ওয়ায়েস আল করনী জগতের এক জ্যোতির্ময় আলোকিত সত্ত্বা যিনি নবীপ্রেমের মশাল প্রজ্জলন করে ঐশী প্রেমের অৃমতধারা প্রবাহিত করেছেন জগৎময়। তাঁর অত্যুজ্জল আদর্শ আমাদের সকলের ধর্মজীবনের পাথেয় হলেই প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃত ধর্ম। ক্বরণ দেশনা স্ব মহিমায় প্রজ্জলিত থাকুক জগৎময়।
রচনাকাল – 26/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী