পত্রিকা – তরিকতে নূর : প্রসঙ্গ আদব – ১ম পর্ব

ছালমা আক্তার চিশতী

আদব ও নম্রতা হলো জন্নাতি গুণ। এই আদব, নম্রতা, তমিজ, তাজিম অর্জন রেতে হলে তরিকতে পরিপূর্ণ দাখেল হতে হয়। ঈমান যার যতো বিশুদ্ধ/নির্মল আদব-নম্রতা-বিনয় তার ততো প্রবল। ইতাই সর্ব ইবাদতের মূল। কারণ-কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত এই পাঁচটি স্তম্ভ ঠিক মতো ধরে রাকতে হলে আদবও নম্রতার নূর লাগবে। আমরা মনে করি এমনি স্বাভাবিক গতিতেই চললেই হবে- এই ধারণাটিই হলো আমাদের ভুল। এই ভুলের মাঝে থাকলেই বিপথগামি হতে হবে। যেমন- কথায় আছে, ‘কাাঁচাতে নু নুলে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস’। যখন কাঁচা থাকে তখন বাঁশকে নোয়ানো যায় না। তেমনি একজন তরিকতপন্থী মানুষের হওয়া উচিত। তরিকতপন্থী হওয়াটাই হলো তার মাঝে আদব নম্রতার নূর লাগবে। যার মাঝে আলো রয়েছে তার আর অতিরিক্ত আলোর প্রয়োজন হয় না তেমনি যার মাঝে আদব নম্রতা রয়েছে সেই ব্যক্তি অতিরিক্ত কোন চাহিদা থাকবে না। অতিরিক্ত চাহিদাটা হলো দুনিয়াতে কায়েম থাকার লক্ষণ।

যার চাহিদার নিয়ন্ত্রণ হয় নাই তার আখেরাতের ফলাফল হবে শুন্য। কারণ, আখেরাত এই নাছুতের জগত হতে তৈরি করে যেতে হবে, না হলে কর্মফল অনুযায়ী ফলাফল তৈরি হবে। যে কর্মফলটা আখেরাত মুখি হবে সে মানব জনমা হবে সার্থক। সর্থকতা অর্জন করতে হলে আদব নম্রতা সর্বোচ্চতর অবস্থানের উপর দাঁড়াতে হবে। কারণ, কর্মফলটার মাঝে নিজ অবস্থান কি হবে কতা নির্ভর করে। নিজ অবস্থানের উপর যেই মানুষ অচেতন তার কর্মফলটা অতি ভয়াবহ হবে। এই ভয়াবহ কর্মটাকে সুফলে পরিণত করতে হলে চরম আদব নম্রতার মাঝে যুব দিতে হবে। যেমন- একটি বরফের টুকরা আগুনের তাপ পেলে গলতে শুরু করে তেমনি যার মাঝে আদব নম্রতা রয়েছে তার মান গুরুর এশকের আগুনে পুড়ে বরফের মতো শক্ত অবস্থানটি পানির মতো সরল হয়ে যাবে, শুধু তা-ই নয় সবার সাথেই তার আচার-আচরণ হবে মধুময়। পানি যেমন যেই পত্রে রাখা হয় সেই পত্রের আকর ধারণ করে তেমনি যার মাঝে আদব নম্রতা রয়েছে তাকে যেই হালে রাখে সে ঐ হালেই থাকবে। আমার গুরু হযরত কাজা কাজী বেনজীর হক চিশত নিজামী (মাঃ জিঃ আঃ) তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেন “সরল মনে গুরুর ধ্যানে সদায় যেইজন মজে থাকে, বলো তার মতো কি ধনীরে আছে ত্রিজগতে”।

এলেম দ্বারা মুর্শিদকে চিনা যায় আর আদব নম্রতা দ্বারা মুর্শিদের মনকে জয় করা যায়। বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ)- তাঁর আলোচনা সভার মাঝে একটি কুকুরকে দেখে সাত বার দাঁড়িয়ে গেলেন। কারণ, সে কুকুরটি ঐ পথে সাতবার আসা-যাওয়া করেছিল এবং সে কুকুরটি ছিল তাঁর হুজুরের বাড়ির। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ)- তাঁর এত উচ্চ স্তরের আদব ছিল যে তাঁর আলোচনা সভার মধ্যে যখনই তাঁর দুষ্টি ডান দিকে পড়তো তখনই সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যেতেন। কারণ, তাঁর হুজুরের মাজার বা রঁওযাটি ছিল আলোচনা সভার ডান দিকে।

হযরত ফরিদউদ্দীন মাসুদ গঞ্জেশকর (রাঃ)- তাঁর হুজুরের খেদমত করেছিল চৌদ্দ বছর। তাঁর হুজুরের খেদমত করতে গিয়ে পতিতা মহিলার নিকট চোখ বন্ধক রেখে হুজুরের খেদমতের আঞ্জাম দিয়েছিলেন। ইহা এক কঠিন বিষয়। হযরত ইব্রাহিম বিন আদহাম (রাঃ)- তাঁর রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে হুজুরের খেদমত করেছিল চব্বিশ বছর। তিনি নিজেই জঙ্গল হতে কাঠ কেটে এন জীরের দরবারে দিতেন। ইহাই ছিল তার খেদমতের আঞ্জাম। আদব নম্রতা ধরে রাখাইট ভক্তের মূল সাধনা। বিশ্বাস যার যতোটুকু প্রতিষ্ঠিত/পরিশুদ্ধ তার আদব-নম্রতা ততোটুকু পরিশুদ্ধ। যারা পর্থিব স্বার্থ পূরণের জন্য বায়াত হয়, তাদের বায়াত সঠিক নয়, তারা তাদের কর্ম অনুসারে ফলাফল ভোগ করবে। কারণ, হেদায়েত পাওয়াটা অতি ভাগ্যের বিষয়। আর পার্থিব স্বার্থ পূরণ না হলে যারা গুরুকে ত্যাগ করে আল্লাহপাক হাশরের দিন তাদের প্রতি তাকাবেন না। যাদের মাঝে স্বার্থ রয়েছে তাদের আদব নম্রতার ঘাটিতিও রয়েছে। আদব নম্রতা থাকলে নিজ ব্যক্তি স্বার্থ আর থাকে না। আদব নম্রতা যার যত বেশি সে ততো বেশি মুর্শিদের আনুগত্যে থাকতে পারবে।

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রাঃ) –এর একটি ঘটনা নিচে বর্ণনা করা হলো- মানুষের নফস বা কু-প্রবৃত্তি যেন কয়লা সদৃশ। প্রথমতঃ তিনি কয়লার প্রভাবে অর্থাৎ তামসিকতায় ভুগছেন। তখন এবাদত-বন্দেগীর অগ্নিকুন্ডে ফেলে দিয়ে কয়লাকে তিনি উত্তপ্ত করেন। আর তওবা ও অনুতাপের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাকে আয়নার মতো স্বচ্ছ করেন। এ নিয়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়। নানা ধরনের এবাদত-বন্দেগীতে নিজেকে তিনি গড়ে তোলেন। পুরো এক বছর নিজের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে তিনি দেখতে পান, অহংকারের রশি তাঁর কাঁধে। এ রশি ছিন্ন করার জন্য আরও পাঁচ বছর তিনি কঠের সাধনায় রত হন। আর নব মুসলমান হয়ে যান। তখন মানব সমাজকে তাঁর মৃত বলে মনে হয়। তিনি তাদের ওপর জানাযা আদায় করে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যান। যেমন জানাযা আদায়কারীরা মৃত ব্যক্তি থেকে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যান। যেমন জানাযা আদায়কারীরা মৃত ব্যক্তির থেকে আলাদা হয়ে যান। তারপর তিনি আল্লাহর নৈকট্যলাভে সক্ষম হন।। গুরুর প্রতি আদব, নম্রতা, তমিজ ও তাজিম দ্বারাই সর্ব সাধন সিদ্ধি হয়। সব যুগের যত মহাপুরুস রয়েছে তাঁরা এই আদবের দ্বারাই সাধনার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছেন। আদবের ফল’ই হলো পবিত্র প্রেম। যেমন- একটি মসজিদ ঘর তৈরি করতে গিয়ে তার ফাউন্ডেশন তৈরি করতে হয় ইট, পাথর, সিমেন্ট, বালু দিয়ে তেমনি এই দেহ মসজিদ ঘরের ফাউন্ডেশন হলো বিশ্বাস-ভক্তি, আদব নম্রতা। ফাউন্ডেশন না থাকলে মূল ভিত্তি ঠিক থাকে না। একটা মানুষ তার মূল ভিত্তিকে ধরে রাখে নিজ নফসের খায়েশকে দূরীভূত করে। মুরিদের আদব-নম্রতা সম্পর্কে পীর-মুর্শিদের কিছু বাণী উল্লেখ করা হলোঃ-

পীরের অজুদকে খোদার এনায়েত মনে করবে এবং তার সাথে পূর্ণ আদব বজায় রাখবে। নিজের সুখ-শান্তি পীরের মর্জির উপর নির্ভর করবে এবং নিজের নফসের খায়েশকে তাঁর সন্তুষ্টির তাবেদার করবে।

একজন মুরিদের এইরূপ অবস্থানই তৈরি করে নিতে হয় তার মনের। কারণ, দুনিয়ার সুখ-শান্তির আশা যদি মনে অহরহ থাকে তবে আর গুরু ভজন হবে না। মনের মাঝে যত দুনিয়ার প্রাধান্য থাকবে তত আখেরাত হারানো যাবে। যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানী রূপে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে তাঁরা সবাই দুনিয়ার সুখ-শান্তিকে ত্যাগ করেছেন। আমিত্ব ত্যাগেই মানব ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা আমিত্বের আবরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি সে অশান্তির অতল সাগরের মাঝে ডুবে আছে। মানুষ এক দরজা থেকে অন্য দরজায ভ্রমণ করে যেমন- হায়ানিয়াত থেকে ইনসানিয়াতে। মানুষ যখন খোদার দিকে ধাবিত হয় তখন তার নিজ নফসে বাস করা মুন্সি আজাজিল/খান্নাছ এসে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার বহুরূপ চেষ্টা করে থাকে, এই বাধাগুলোকে অতিক্রম করার একটাই পথ হলো নির্মল বিশ্বাসের মাধ্যমে পীরের মর্জির উপর নিজ মনকে ধাবিত করা। গুরুর এ বাহ্যিক দেহটা বিমূর্তের মূর্তরূপ বিধায় একজন ভক্ত/মুরিদানের জন্য খোদার রূপ দর্শন করার একমাত্র অবলম্বন বিধায় আল্লাহর তরফ হতে ইহা এক মহা নেয়ামতস্বরূপ। মানব মনকে গুরুর প্রতি একনিষ্ট চিত্তে ধাবিত করতে চাইলে নফসের ভেজালগুলো সরাতে হবে/হায়ানিয়াত দূর করতে হবে। যেমন ইটের দেয়াল তৈরি করতে চাইলে ঐ দেয়ালটি মজবুত হবে পানির দ্বারা তেমনি আমাদের দেহ ঘরের মনের দেয়ালগুলো শক্ত হবে আদব নম্রতার পানি দ্বারা। আদব নম্রতার নূর দ্বারা একজন ভক্ত তার নিজ সত্তাকে কলুষিত করে তোলে। পীরের ভেদ জানা হরে খোদার ভেদ রহস্য জানতে হলে খোদার ভেদ রহস্য জানতে পারবে, কারণ, খোদাকে চেনার মাঝে অন্তর্নিহিত মূল ভেদ রয়েছে নিজকে চেনার মধ্যে।

পীর-দরবেশদের সাথে ওঠা-বসা করা এবং আদবের সাথে পবিত্র মন নিয়ে আলোচনা করা পৃথিবীতে সবচেয়ে উত্তম কাজ এবং তার বিপরীত কাজ হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ।

নিজ পীরকে রেখে অন্য দরবারে বা বিভিন্ন মাজারে দৌড়াদৌড়ি করলে বা ‍পূণ্য লাভের আশা করলে নিজ পীরের ফায়েজ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি তার ঈমান মাত্রই সঠিক নয় বলে সাব্যস্ত হবে। তাই একজন প্রকৃত মুরিদের কতৃব্য হলো পীরকে রেখে কোথাও না যাওয়া। ‘বস্তুত বাধ্যকারী সটিক প্রয়োজন ছাড়া স্বীয় পীর-মুর্শিদ থাকা সত্ত্বেও অন্য পীরের হাতে বায়’আতে ইরাদত’ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা জরুরী। এটাই নির্ভরযোগ্য অভিমত। এটাতেই কল্যাণ নিহিত। অন্যথায় পরিপূর্ণ ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমান’ (বায়আত ও খিলাফতের বিধান ২১ পৃঃ)। যারা পীরকে রেখে অন্য দরবারে আসা যাওয়া করে এবং স্বীয় পীর অসন্তুষ্ট হয় তবে তার সর্ব আমল ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পরিণামে তারা অন্ধকার কবরের মাঝে নিক্ষিপ্ত হবে, কালো অজুদ নিয়ে হাশরে উঠবে। এই অন্ধকার থেকে মুক্ত হতে গেলে পীর মুর্শিদের দয়া লাগবে।

আপন খবর