ছালমা আক্তার চিশতী
এই আদব, নম্রতা, তমিজ ও তাজিম ধরে রাখতে পারলেই একমাত্র পীরের ফায়েজ বরকত লাভ করবে। খোদাকে জয় করার একটাই রাস্তা হলো বিশ্বাসযোগে আদব-নম্রতা ধারণ করা। এর দ্বারাই খোদার ভেদত্ত্ব জানা যায়। খোদার ভেদ হলো একজন ইনসান। ইনসাফ হতে ইনসান এবং ইনসানের গুণ-খাছিয়ত হলো ইনছানিয়াত- যাকে ফিতরাতাল্লাহ্ বলে। এই জানার মাঝে বাধাস্বরূপ এসে দাঁড়ায় কালো রঙ্গের একটি অজুদ। তার আছে অসংখ্য সুরত। সেই কালো অজুদকে নূরের অজুদের রূপ দিতে চাইলে আল্লাহর খাস নাম আলিমুল দীলে ধারণ করতে হবে।
আমর দাাদ হুজুর দেওয়ান শাহ রজ্জব আলী চিশতী নিজামী (রাঃ) তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেন- ‘হলে জ্ঞানের অঙ্কুর, মন পাগল তোর, ভয় কিরে কার শমনে, জ্ঞান দিয়ে মন রাখবে সংশোধনে’।
মন একটি অচিন পাখির ন্যায়, এই মনকে ধরতে হলে গুরুপ্রদত্ত জ্ঞান লাগবে, তা ধারণ করতে না পারলে এই অচেনাকে চেনা যাবে না। দীলের মাঝে যাদি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বাসা বাধে তবে আর কালো রঙের অজুদটি ভাঙ্গা যাবে না/অতিক্রম/নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ, সব ভেজালের মূল হলো দুনিয়ামুখি চিন্তা চেতনা- যা এ অজুদের নফস হতে প্রকাশ। এই জগতে যারা কামেল তাঁদেরকে চিনতে হলে সরল স্বভা দীলে ধারণ করতে হবে। যারা খোদার ভেদ জানতে চায় তাদের গুরুর সংযোগে এসে নিজকে চিনতে হবে। রুহে ইনসানীর অধিকারী হলেই হবে চৈতন্যের উদয়, আর চৈতন্যতাই পরকাল। চেতন যারা তার সর্বসময়/দম-কদমে রূপের পাহাড়া দিবে। কারণ, রূপের ঘরেই মাওলার বাসস্থান। আদব নম্রতা ধরে রাখতে হলে জান্নাতি কিছু গুন লাগবে। জান্নাতি গুণগুলো না থাকলে পীর মুর্শিদের প্রতিও আদব নম্রতা আর থাকবে না। ভক্তি রস দ্বারাই গুরুকে জয় করা যায়। প্রেম ফুল দ্বারাই তাঁর পূজা করা যায়। কারণ, গুরু হলো প্রেমের কাঙ্গাল, সে ধারে ধারে ঘুরে বেড়ায় প্রেমেরে জন্য। গালিমপুরের সাধক শেরআলী খান একটি গানে লিখেছেন, গানটি হলো- ‘প্রেম ফুলে পূজলে নাকি শুদ্ধ পূজা হবে তোমার, পূজিবার কী আছে আমার পূজিবার কী আছে আমার।’ গুরুর এখতিয়ারের বাহিরে চলাফেরা করলে পবিত্র প্রেমের আবাস ইঙ্গিত বিন্দু পরিমাণও দেখা মিলবে না তকদিরে।
পীর-মুর্শিদ আসলে দাঁড়াইয়া সম্মান করবে এবং তাজিম করবে। তাঁর বংশধরকেও সম্মান করবে এবং তাদের প্রতি সু-ধারনা পোষণ করবে।
শুধু গুরুকে/পীরকেই নয় তাঁর বংশধরদের প্রতিও আদব সম্মান বজায় রাখতে হবে। সম্মান না দিতে পারলে নিজ পূর বিরক্ত/অসন্তুষ্ট হবে। পীর অসন্তুষ্ট হওয়া মানে আল্লাহকেই অসন্তুষ্ট করা- এই কথার ভেদ রহস্য কেবল একজন কামেল পীর-মুর্শিদ দিতে পারবে। পীরের বংশধরদের অবস্থান অনেক উচ্চ স্তরে। কারণ, তাদেরকে সম্মান দিতে না পারলে পীরকে/গুরুকে পুরোপুরি সম্মান দেয়া হলো না। কারণ, যদি এই সম্পর্কে জানার চ্ছিা থাকে তবে আদবের সাথে একজন পীরের নিকট থেকে জেনে নিতে পারে। বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যে আদব-নম্রতা ধারণ করে রেখেছে সেই জ্ঞানী, ভক্ত। ভক্ত থাকে দায়েমী নামাজে। তাই বলা হয় ভক্তের অধীন ভগবান। নামাজের স্বভাব হলো আদব-নম্রতা (সুরা-মুমিনুন-২)। যার আদব-নম্রতা ঠিক আছে তার সর্ব ইবাদতই ঠিক আছে। আর আদবে আউলিয়া, বেআদবে শয়তান। মনের অবস্থান যদি সুন্দর না হয় তবে আর গুরুর নিকট যাওয়া ফলদায়ক হবে না কারণ, গুরুর কাছে যাওয়ার মূল উদেশ্য হলো মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যার গুরুতে মন একাগ্র চিত্তে স্থির হয়েছে সেই সম্পর্কে লালন সাঁইজি গানের মাঝে বলেছেন- “সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।” গুরু জ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে না লাগাতে পারলে গুরুর দয়া কোন দিন শিষ্যের দীলে পৌঁছবে না। যেমন- টিভি দেখার জন্য রিমোট লাগে, রিমোটের সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে সেই রিমোটই টিভি নষ্ট করতে পারে, তেমনি মানুষের দীলের মাঝে ইচ্ছা শক্তি নামক রিমোট রয়েছে সেই রিমোটের অপব্যবহার করলে দেহ নামক ঘরটি ভেঙ্গে যাবে।
পীরের ব্যবহৃত জিনিস পাত্র ব্যবহার করবে না হুকুম ব্যতীত এবং তাঁর জায়নামাজে পা রাখবে না।
পীর-মুর্শিদ যেই জিনিসপত্র ব্যবহার করে থাকে সেইগুলো তাঁর অনুমতি ব্যতিত ব্যবহার করবে না। কারণ, পীর-মুর্শিদের বিষয়টি হলো আলাদা। তাঁদের সাধারণ মানুষের মত দেখা গেলেও তাঁরা আলাদা। পীর-মুর্শিদের কালামগুলো হলো এলমে লাদুন্নী। তাঁরা আধ্যাত্মিক জগতে মহামানব, তাই তাঁদের সব বিষয় হলো আলাদা। যার আদব নেই তার ঈমান ঠিক নেই। কিছুদিন পর সে ব্যক্তি হয়তো পীর-মুর্শিদ থেকে বিতাড়িত হয়, নয়তো সে নিজেই আল্লাহর প্রতি ঈমান হারিয়ে আসফালা সাফেলীন হয়ে যায়। গুরু কর্তৃক বা নিজেই গুরু/মুর্শিদ হতে বিতাড়িত হলে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর লানত প্রাপ্ত হয়, আঠার হাজার মাখলুকাত তাকে লানত দিতে তাকে। কারণ, গুরু বা মুর্শিদের নিকট বায়াত হওয়াই হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তা আল্লাহর হাতেই বায়াত বলে কোরানে বিধৃত (সুরা ফাতহ্- ১০)। সর্ব প্রথম গুরুর প্রতি বেয়াদবী করে তর্ক-অহংকার করে এবং আল্লাহর ঘর মসজিদে সেজদা না করে লানত প্রাপ্ত হলো মুন্সি আজাজিল। সে হলো গুরু/মুর্শিদ হতে বিতাড়িত। কারণ, সে আদব-নম্রতা, বিনয়ের নূরে দাখেল হতে পারেনি।
যুগে যুগে মুন্স আজাজিলের অনুসারীদের মাধ্যেই আদব-নম্রতা, বিনয়ের চরম ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যারা পূর-মুর্শিদের ভেদ জানে না তারা এইরূপ বেখেয়ালী কর্মকান্ড করে তাকে। যাদের বংশগত ভাবে পীর-মুর্শিদের আদব বুঝেনা তারা বেশীরভাগ এরূপ বেলেহাজ কুফরী কর্মকান্ডগুলো করে থাকে।
মাওলানা রুমী (রাঃ) বলেছেন- “পীরকে খোদা হইতে দুই জানিও না, দুই দেখিও না, দুই ভাবিও না।”
নিজ মানব সত্তার মাঝে যদি আদব-নম্রতা থাকে তবে পীর মুর্শিদের প্রতি এইরূপ সুধারণা আসবে। নিজ সত্তাটাকে পবিত্র করে তুলতে হবে, না হরে অপবিত্র সত্তার জন্য এই মানব জনমটা অভিশপ্ত জনমের অীধকারী হয়ে যাবে। যেমন- মানুষ বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন পোশাক পরিধান করে থাকে, আর ঋতুটা যদি একটাই হতো তবে একই রকমের পোশাক পরিধান করা হতো, ঠিক তেমনি একজন মানুষের এই মনকে বহুগামী করলে সেই স্বভাব অনুসারে তাকে পোশাক পরিধান করানো হবে সেই পোশাকগুলো মানুষের হবে না, আর মান যদি গুরুর অনুগামী হয় তবে সেই মানুষটির পরনে মানুষের পোশাক পরিধান করা থাকবে।
একজন মুরিদের নিজ অস্তিত্বকে বা ইচ্ছাকে পীরের ইচ্ছিা/মর্জির উপরে পরিপূর্ণ সমর্পিত করতে হবে। কারণ, পীর যদি সন্তুষ্ট থাকে তবে একজন মুরিদ তার মূল গন্তব্যে পৌঁছতে পারে। আমাদের এই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়াটা হলো একটি অজানা পরীক্ষার মতো, আর গুরুর দেখা পাওয়াটা হলো সৌভাগ্যের বিষয়, আল্লাহর দয়া ও করুণার ফল। কারণ, ইহা পূর্ব ওয়াদার বাস্তবায়ন (সুরা আরাফ- ১২৭)। আর এই অজানা পরীক্ষা পাশ করতে হলে গুরুর নিকট গিয়ে তাঁর নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে, গুরুকে নিজ মনের ভিতরে ফুলের বাগান তৈরি করে আদব নম্রতা অর্থাৎ তাজা ফুলের সুগন্ধি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে এই অসার জনমটা সার্থক হবে। কোদা যার সহায় হবে তার এই দূর্গম পথ অতিক্রম করতে কষ্ট হবে না। যেমন- যারা শিক্ষকের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল এবং পড়ালেখায় অধিক মনোযোগ থাকে তাদের পরীক্ষায় পাস করাটা কষ্টকর হয় না। তেমনি যারা তরিকতের জগতে অধিক মনোযোগী , বিশ্বাস-ভক্তি নির্মল আছে তারা এই নাসুতের দরিয়া ধৈর্য্যের সাথে পাড়ি দিযে রুহে ইনসানীর দেশে দেশে পৌঁছে যাবে। পীরের জিনিস পত্র পীরের অনুমতি ব্যতিত না ধরার মাঝে একটি নিগুর ভেদ রহস্য লুকিয়ে রয়েছে কারণ, একজন মুরিদের জন্য এই অবস্থানটি হলো চরম আদব নম্রতার। গুরু একজন সাধারণ মানুষের মতো দেখতে হলেও কিন্তু সে সাধারণ নয় তাঁর অন্তর জগতটা হলো পরিশুদ্ধ, আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারীতে পূর্ণ। আর একজন সাধারণ মানুষ ভুল ভ্রান্তির অতল সাগরের মাঝে ডুবে থাকে, গুরু হলো এই মায়ার জগতের ভুল ভ্রান্তির উর্ধ্বে হলো তাঁর বাসস্থান।
এ ডুবন্ত নাসুত সাগর হতে গুরু তার অনুসারীকে তুলে মুক্তির জগতে নিয়ে যায় তাই একজন গুরুর সম্মান আল্লাহ নিজেই তৈরি করে দেন। গুরুর প্রতি আদব, নম্রতা, তমিজ ও তাজিম না থাকলে তার সরিষার তেল মেখে কলা গাছে ওঠার মতো পরিস্থিতি হবে। পিছল খেতে খেতে সে নিজের গন্তব্য ভুলে যায়। একবার যদি ভুল পথে অগ্রসর হয় তবে আর সহজে মূল গন্তব্যে পৌঁছানো হবে না। কারণ, শয়তান অহরহ মানুষের পিছনে লেগে আছে। তাকে বশ করতে না পারলে মানব জনমটাই অসার হয়ে যাবে। বহু রূপের মাঝে ভ্রমণ করতে হবে। আমার মাঝে আদব নম্রতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। গুরু/মুর্শিদের নিকট নূরে-এ-আদব/বিনয়-নম্রতার করুণা প্রার্থী। তারপরেও নূর-এ-আদবের মতো কঠিন বিষয়টি সম্পর্কে কিছু লেখার বাসনায় কলম ধরলাম, ভুল হলে দয়াল যেন ক্ষমা করেন।