হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
নূরে মোহাম্মদী পাঁচটি হালিয়তে এসে পাক পাঞ্জাতন রূপে বিকশিত হয়:
প্রথমত ছিলেন: আল্লাহর নূর
দ্বিতীয়তে ছিলেন: তবরকের ফুল (আহামদী নূর)
তৃতীয়তে ছিলেন: ময়নার গলার হার
চতুর্থতে ছিলেন: সেতারা রূপ (সূরা নজম)
পঞ্চমেতে ছিলেন: ময়ূরিণী
এ পাঁচটি অবস্থান মুতাশাবেহাত (রহস্যাচ্ছন্ন) বা রূপক বা উপমা হিসাবে বিধৃত। এ অবস্থাটি বিভিন্ন নামেও পরিচিত আছে, তবে সবার মূলতত্ব একই। এ সময় এশকের তসবীহ নিয়ে দ’ঠোটে নাম জপতেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’। সমস্ত সৃষ্টির রহস্যের আধার হলো এ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ কথাটি এবং শাজারাতুল ইয়াকীন’ গাছে বসে সত্তর হাজার বৎসর এ নাম জপে ছিলেন। ‘সত্তর হাজার’ কথাটিও এক রহস্যপূর্ণ চিরন্তন শাশ্বত কথা। এরপর ‘ইরফানের’ একটি আয়না বা দর্পণ সামনে এলো তাতে স্বীয় অস্তিত্বে পাঁচটি সুরত দেখেছিল- যা ছিল পাক পাঞ্জাতন। মূলত এ পায়রাহীন দর্পনই ‘মাছালু নূরিহী’- যার মধ্যে রূপ দরশন হয়। এ বেলায়তী পাক পাঞ্জাতনের সমষ্টি রূপ নিয়ে বেহেশতী গাছে মোহাম্মদী ফুল রূপে ছিলেন। তানাজ্জুলাত-ই-খামছা তথা পঞ্চস্তরে জাতপাকের নাযিল।
হকিকতে মোহাম্মদী হতে পাক পাঞ্জাতন বিকশিত হওয়ার ধারাটি হলো:
আল্লাহপাক হকিকতে মোহাম্মদীকে জহুর করে তাঁর প্রতি মহব্বতের নজরে তাওয়াজ্জু দেন মানে তাঁর নিজের প্রতি নিজের যে ভালোবাসা ছিল তা তাওয়াজ্জু মারফত ‘ইলকা’ করেন। তাতে ‘হুব্বে এলাহীর’ প্রবলভাব ধারণ করে, ফলে হাকিকতে মোহাম্মদী এতো অস্থির হন যে, তাতে কম্পন সৃষ্টি হয় এবং ডান দিকের এক অংশ পৃথক হয়ে খসে পড়ে ও কাঁপতে থাকে। মাওলাপাক তখন হাকিকতে মোহাম্মদীর মাধ্যমে ঐ খন্ডিত অংশের উপর রহমতের নজর নিক্ষেপ করেন, তাতে নারী জাতির স্বরূপ প্রকাশ করেন। ইনিই বাস্তব জগতে হযরত মা ফাতেমা আলাইহাস্ সালাম হলেন। এবার আল্লাহপাক দ্বিতীয়বার হাকিকতে মোহাম্মদীর প্রতি মহব্বতের নজরে তাওয়াজ্জু দিলেন। তখন বাম দিক হতে আরেকটি অংশ হাকিকতে মোহাম্মদী হতে পৃথক হয়ে যায় এবং প্রথম অংশের সংরক্ষক ও জোড়া হিসাবে একটি পুরুষ আকৃতি হয়ে যায়। ইনিই হলেন মাওলা আলী আলাইহিস্ সালাম। এ দু’সুরত প্রকাশ হওয়ার পর আল্লাহ হাকিকতে মোহাম্মদীর প্রতি তৃতীয়বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এতে আরো একটি অংশ পৃথক হয়ে পড়ে এবং দু’ভাগ হয়ে দু’টি আকৃতি প্রকাশ পায়। প্রথম যে আকৃতি প্রকাশ পায় তা মাথা হতে নাভী পর্যন্ত হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের আকৃতির অবিকল এবং ইনিই হলেন ইমাম হাসান আলাইহিস্ সালাম।
এজন্যই রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়া আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলেছেন, “আনা ওয়া আলীউন নূরীন মিন ওয়াহিদ” অর্থাৎ আমি এবং আলী একই নূরের দু’খন্ড। “আলী মীননী ওয়া আনা মিনাল আলী” অর্থাৎ আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। “ফাতেমা মিননী ওয়া আনা মিনাল ফাতেমা। হাসান মিননী ওয়া আনা মিনাল হাসান। হুসাইন মিননি ওয়া আনা মিনাল হুসাইন।” অর্থাৎ ফাতেমা আমা হতে এবং আমি ফাতেমা হতে। হাসান আমা হতে এবং আমি হাসান হতে। হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে। এখানেই হুসাইনের জলিতে প্রতিঘাত হয়ে আল্লাহর কালাম ওহী হয়। হুসাইন চির সত্য, দ্বীন ইসলামের ভিত্তি। এখানেই রয়েছে ঈমান এবং ঈমানের সুরত। এ ঈমানকে ধারণ করলেই মিলবে আমান তথা মুক্তি। মাওলা আলী আলাইহিস্ সালাম বলেছেন, “হাসান হলেন মাথা হতে বক্ষ পর্যন্ত রাছুলুল্লাহর সদৃশ। আর হুসাইন হলেন নাভী হতে পা পর্যন্ত রাছুলুল্লাহর সদৃশ। [তিরমিযী, মেশকাত ১১তম খন্ড]। হাসান এবং হুসাইন মিলে ‘আহসান’ সুরত জহুরে আসছে। হাকিকতের জগতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় মোহাম্মদী গুণ-খাছিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। সমস্ত কিছুর ধারক-বাহক হলো হুসাইনী জগত এবং এখানেই জিবরাইলের আগমন হচ্ছে, কোরান নাযিল করছেন। পাক মাটি বস্তুর জগতে রমজানের সাতাশ তারিখে আল্লাহর কালাম নাযিল হচ্ছে। ‘ইন্না আনজালনা-হু ফী লাইলতিল ক্বাদরি’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই নাযিল হয় ‘হু’ শক্তির রজনীতে। আল্লাহপাক যখন কোরান শিক্ষা দিয়ে তারপর মানুষ সৃষ্টি করেন তখনই ‘হু’-এর আগমন ঘটে, নাযিল হয়। এখানেই পবিত্র রমজান মাস, যে মাসে কোরান নাযিল হয়। কোরান শিক্ষা দেয়া হয় শাবান মাসে আর তা নাযিল হয় রমজান মাসে।
রমাজন মাস ব্যতিত কোরান নাযিল হয় না।
নূরী জগতের বহু উর্ধ্বে সম্মান ও মহত্বের সিংহাসনে হযরতহ রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ত’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের মাহবুবিয়াতের গৌরবময় দীপ্তিমান অবস্থায় বিরাজমান আছেন।
এ সিংহাসনের নিচে:
হাকিকতে মোহাম্মদী, বামদিকে মাওলা আলী ডান দিকে মা ফাতেমা, ইমাম হাসান ইমাম হুসাইন (আ)
আল্লাহপাকের নিকট হতে আলমে খালকের পরিবর্তনের দুটি ধারা চিহ্নিত আছে এবং তা প্রথমে হাকিকতে মোহাম্মদীর উপর প্রকাশ পায়- ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ তথা ভালো ও মন্দ- এ অবস্থায়। ভালো বা খায়ের হলে হাকিকতে মোহাম্মদী হতে হাকিকতে ফাতিমীয়ার দিকে পৌঁছে তথা সোপর্দ করা হয়। এজন্য ফাতেমাকে ‘খায়রুন্নেছা’ বলা হয়। শর বা মন্দ হলে মাওলা আলীর হয়ে হাককিকতের উপর ন্যায় হয়। তারপর ভাল-মন্দ দু’ হাকিকত মিলিত হয়ে হাকিকতে হাসান ও হুসাইনের দিকে পৌঁছে। তাদের এ দু’ হাকিকতের মধ্যস্থতায় যমানার গাউছের নিকট পৌঁছে। গাউছে যমানা হতে আবদাল, আওতাদ ইত্যাদি সমস্ত ওলী-আউলিয়াগণের নিকট পৌঁছে। তারপর তাদের মাধ্যমে সৃষ্টি পগতে এস বিকশিত হয় বিধায় ওলী-আউলিয়ার উছিলায় সৃষ্টি রহমতপ্রাপ্ত হচ্ছে। “খোশ আমদেদ ইমাম মাহদী (আঃ)” গ্রন্থে বলা হয়েছে, আল্লাহর খেলাফত বলতে এ রহমতকে বুঝায়- যা আল্লাহপাক হাকিকতে মোহাম্মদী বা পাক পাঞ্জাতনকে দান করেছেন। হাকিকি পাক পাঞ্জাতন সৃষ্টি করে তাদের উপরস্থ এবং নিম্নস্থ যাবতীয় জিনিসের স্থায়ীত্বের মূল স্থির করলেন এবং হাকিকি পাক পাঞ্জাতন হতে যাবতীয় বস্তুর হাকিকত সৃষ্টি করলেন। যাবতীয় বস্তুল স্থির করে আল্লাহ তাঁর নিজের খেলাফত দ্বারা পাক পাঞ্জাতনকে গৌরাবান্বিত করলেন।
নবুয়ত ও রিসালাতের ফায়েজ ছাড়া খেলাফতের ফায়েজ আসে না। হযরত আদম (আঃ) আল্লাহপাক হতে জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে খেলাফত লাভ করেছিলেন তাকে বলা হয় ‘আসলী খেলাফত’। এ খেলাফত পাক পাঞ্জাতন ব্যতিত সৃষ্টির আর কেউ লাভ করেনি বিধায় কামেল মোকাম্মেল সবাই পাক পাঞ্জাতনের মধ্যাস্থতায় খেলাফত ফায়জী লাভ করেন। তবে বুঝতে হবে এখানে বেলায়তী পাক পাঞ্জাতনের বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে।
আল্লাহপাক একদিন জিবরাঈলকে হুকুম করলেন বেহেশত হতে মতান্তরে আরশ মোয়াল্লার নিকট হতে ঐ ফুলটি নিযে আসো। জিবরাঈল একে এক দু’বারই চেষ্টা করে ফুলের নিকট যেতে পারলেন না। জিবরাঈল এ অবস্থা আল্লাহপাককে জানালেন। আল্লাহপাক বললেন, তুমি এবার “বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলে ফুলে হাত দিবে। জিবরাঈল তা-ই করলো এবং ফুল নিয়ে এলো। আল্লাহপাক জিবরাঈলকে বললেন এ ফুল নিয়ে শাম শহরে এক খেজুর বাগানে চলে যাও। সে বাগানে হযরত আবু তালিব ও আব্দুল্লাহ শুয়েছিলেন। তারা বাণিজ্য উপলক্ষে এখানে এসেছেন। জিবরাঈল ফুলটি নিয়ে আব্দুল্লাহর নাকে ধরলেন। সে ফুলের ঘ্রাণ দু’ভাগ হয়ে গেল আব্দুল্লাহ ও আবু তালিবের মধ্যে।
মোহাম্মদী ভাগ পেল হযরত আব্দুল্লাহ এবং বাকী অংশ পেল হযরত আবু তালিব। সুতরাং বলা হলো ‘আনা ওয়া আলীউন্ নূরীন্ মিন ওয়হিদ।’ অর্থাৎ আমি এবং আলী একই নূরের দুই খন্ড। তাই হযরত আবদুল্লাহ (আঃ) এর মাধ্যমে দুনিয়াতে এলো হাবিবে খোদা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম এবং হাবিবে খোদা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম এর মাধ্যমে এলো ফাতেমা আলাইহিস্ সালাম। আর হযরত আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর মাধ্যমে এলো মাওলা আলী এবং মাওলা আলী ও ফাতেমা আলাইহিস্ সালামের মাধ্যমে পৃথিবীতে এলো ইমাম হাসান ও হুসাইন আলাইহিস্ সালাম। ইনারাই হলেন আহলে বাইয়্যেত বা নবী বংশ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলেছেন, “সবার বংশ আরম্ভ হয় নিজ ঔরশ থেকে আমার বংশ আলী হতে।”
সুরা ফোরকানের ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ওয়া হুওয়াল্লিজি খালাকা মিনাল্ মা-ই বাশারান্ ফাজ্বা’আলাহু নাসারাও ওয়া সিহরা, ওয়া কানা রব্বুকা ক্বাদীর।” এবং তিনি যিনি পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানুষ (বাশার)। অতঃপর তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন। এ আয়াত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, ইহা পাক পাঞ্জাতন সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। যা হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের সৃষ্টির পূর্বে বিদ্যমান ছিল।