পুলিন বকসী
‘গান গাই আমার মনরে বোঝাই, মন থাকে পাগল পারা
আর কিছু চাই না মনে গান ছাড়া!’
শাহ আব্দুল করিম বলছেন – গান গেয়ে তিনি তার ‘মনরে’ বোঝান এবং আপাতত গান ছাড়া ‘আর কিছু’ তিনি বোঝেনও না। সমগ্র বাংলার গ্রামগুলোতে এখনও অল্পবিস্তর দু’একজন বাউল-ফকিরদের দেখা মেলে, তারা গান গেয়ে চলেন রাস্তায় নইলে ট্রেনের কামরায় কিংবা বিলের কোনায়, হাতে হয়তো একটা একতারা নইলে দোতারা থাকে। অনেক পীরের খানকা আছে যেখানে গান তথা সেমা সঙ্গীত চলে অহরহ। আর ভারতবর্ষীয় সুফিদের গানের সুনামের কোন বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই সময়ে তীব্র অক্ষরবাদী প্রবণতা, সেইসাথে ইউরোপ-আমেরিকার ঔপনিবেশিক ও পূজিবাদি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ইউরোপ-আমেরিকা কর্তৃক তথাকথিত ‘শান্তি’ ও ‘গণতন্ত্র’ এক্সপোর্টের অযুহাতে মধ্যপ্রাচ্য সহ আফ্রিকায় গণহত্যা ইত্যাদির সাথে সৌদী আরবের পেট্রোডলারের রাজনীতির বদৌলতে ‘ওয়াহাবিবাদ’এর তীব্র প্রসারের কারনে আমাদের ভারতবর্ষীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক অর্থোডক্সি প্রবনতা বেড়েছে। সেটা কখনও ‘ব্রাক্ষণ্যবাদ’ বা কখনো ‘সালাফিবাদ’ নামে। এই অতি ‘পিউরিটান’ প্রবনতায় গানকে ধরা হচ্ছে ‘নাজায়েজ’ কিংবা হারাম কর্ম হিসেবে এবং কিছুকিছু জায়গায় এমনও দেখা যাচ্ছে তরুণেরা এই ‘অতি শুদ্ধতার’ বশবর্তী হয়ে তাদের বাদ্যযন্ত্রও ভেঙ্গে ফেলছেন!
গান প্রসঙ্গে এবং গানের শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতার প্রশ্নে যেহেতু হাদিসে এবং ক্ল্যাসিক্যাল মুসলিম মনীষিদের দু’রকম বয়ানের বিবৃতিই আমরা পাই, সুতরাং হাদিস সংক্রান্ত বিবৃতিতে না গিয়ে আমরা কোরানিক বয়ান মতে গান বিষয়ক ‘জায়িজ-নাজায়িজে’র তত্ত্ব-তালাশ করি।
গান নাজায়িজ বা ইসলামী অন্টোলজি মতে গান সঠিক না, এই পক্ষের ব্যক্তিবর্গ কোরানের যে আয়াতগুলোকে সামনে নিয়ে আসে তা হলো-
প্রথম দলিল- ‘মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যারা লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য অজ্ঞানতা বশত লাহওয়াল ক্রয় করে এবং আল্লাহর পথকে হাসি-তামাশারূপে গ্রহণ করে’।
এই আয়াতে সরাসরি গানের কোন উল্লেখ দেখা যায় না। এখানে যে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ আছে তা হলো ‘লাহওয়াল হাদিস’। মুসলিম আইনবেত্তাদের মধ্যে অনেকেই ‘লাহওয়ালে’র বিভিন্ন অর্থের মধ্যে গানকেও ধরেছেন। যদি এই ‘লাহওয়ালে’র অর্থ গান হয় তাহলে অবশ্যই গান হারাম এবং নাজায়েজ কাজতো বটেই! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এই শব্দের অর্থ করেছেন মূলত এমন- ‘গান ও তার অনুরূপ বিষয় সমূহ’। মূলত ‘লাহওয়াল’ শব্দের অর্থ আরো কিছু, যেমন- খেলা, তামাশা, অসার কথা, অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ, অনর্থক কাজ ইত্যাদি যা মানুষকে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে বিরত রাখে।
আবার গান বা সংগীতের জন্য আরবী ভাষায় পৃথক শব্দও রয়েছে। যেমন- ‘গেনা’ বা ‘সামা’, ‘নাগমা’। কোরানে যদি গানকে হারামই বলা হতো তাহলে ‘লাহওয়াল’ শব্দ ব্যাবহার না করে সরাসরি ‘গেনা’ বা ‘নাগমা’ শব্দই ব্যবহার করা হতো। কথা হলো, ‘লাহওয়াল’ শব্দের যে অর্থ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস দিলেন সেই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকেই আমরা দেখি তিনি গানকে খুব পছন্দ করতেন এবং নিয়মিত গানের শ্রোতাও ছিলেন! সুতরাং আমরা বলতে পারি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস সম্ভবত ‘লাহওয়াল ‘ শব্দের এই অর্থ সম্পর্কিত বিবৃতি দেন নাই।
যাহোক এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম গাজালী আরো খানিক স্পষ্ট করে বলেন- ইসলামের পরিবতে লোকদের পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে অলীক কথা ও কাহিনী খরিদ করা নিন্দনীয় এবং হারাম। এতে কারো কোন মতভেদ নেই। কিন্তু সকল প্রকার গান-বাজনা ইসলামের প্রতিকূলে বিক্রি হইতে পারে না। এটাই এই আয়াতের মূল উদ্দেশ্য। পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে গান-বাদ্যতো দূরের কথা, কোরান পাঠ করলেও হারাম হবে।
২য় দলিল- ‘তবে কি তোমরা এই কোরান দ্বারা আশ্চর্যন্বিত হও? হাসি ঠাট্টা করছো! ক্রন্দন করছো না এবং তোমরাতো সামেদুন’। এই আয়াতের শেষ শব্দ ‘সামেদুন’ -এটি যদি আরবী ভাষার শব্দ হয় তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় উদাসীন, গাফেল অবিবেচক, বেহুদা কাজে লিপ্ত ইত্যাদি।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মতে ‘সামেদুন’ আরবী শব্দ না। তার মতে ‘সমেদ’ হুমায়রী ভাষার শব্দ এবং এর অর্থ গান। ‘সমদ’ অর্থ গান হলে ‘সামেদুন’ অর্থ গায়ক বা গান পরিবেশনকারী। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী গান অবশ্যই হারাম। সেই হিসাব মতে ‘আশচর্যন্বিত’ হওয়া, ‘হাসি-ঠাট্টা’ ইত্যাদিও হারাম হয়ে দাঁড়ায়! কিন্তু হাসি-ঠাট্টা, আশ্চর্য হওয়া ইত্যাদি ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম না সুতরাং গান হারাম হওয়ারো কোন কারণ দেখিনা। আবার আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এই বর্ননার কথা বিবৃত করেছেন ইকরামা; যার মিথ্যা বর্ণনা করার অভ্যাস ছিল।
আবার কোরানে ভিন্ন ভাষা তখনই ব্যবহার হয়েছে যখন আরবীতে সেই শব্দ নেই কিন্তু আমরা জানি গানের প্রতিশব্দ আরবীতে ছিল। গিনা, নাগমা, সামা ইত্যাদি হিসেবে। তাহলে গানের আরবী শব্দ থাকা সত্ত্বেও কোরানে কেন হুমায়রী শব্দ ব্যবহৃত হলো সে-বিষয়ক ব্যাখ্যা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস দেননি।
৩য় দলিল- আল্লাহ বলছেন,‘হে শয়তান! তুমি তাহাদের মধ্য হইতে যাহাকে পার তোমার স্বর (ছওত) দ্বারা পথভ্রষ্ট কর’।
এই আয়াত অনুযায়ী শয়তানের স্বর বা ‘ছওত’ দিয়ে অনেকেই সংগীতকেই বোঝান। আর যেহেতু শয়তানের কন্ঠ থেকেই সংগীত আসে সুতরাং সংগীত হারাম! এটা এক রকমের অদ্ভুত যুক্তি! এই ‘ছওত’ নিয়ে আরেকটি আয়াতও আছে কোরানে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘তোমাওরা তোমাদের ‘ছওত’ কে নবীর ‘ছওতে’র উপর কোরো না। বনী ইসরাইলের সাত নম্বর আয়াত অনুযায়ী ‘ছওত’ মানে যদি গান হয় তাহলে সুরা হুজরার আয়াত অনুযায়ী আমরা বলতে পারি ‘তোমরা তোমাদের গানকে নবীর গানের উপর কোরো না’! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কিন্তু উপরের আয়াতের মত এই আয়াতে ‘ছওত’কে গান হিসেবে ব্যাখ্যা করেননি। তাহলে ব্যাপারটা কেমন আত্মসাংঘর্ষিক হলো বলে আমাদের মনে হয়!
উপরের তিনটি সুরার তিনটি আয়াতের কোথাও গানকে হারাম, নাজায়েজ ইত্যাদি বলা হয়নি। এই আয়াতগুলোকে ভিত্তি ধরে এর বিবিধ ভাবার্থ তৈয়ার করে বহু পন্ডিতবর্গ গানকে নিষিদ্ধ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু কোরানে কোনটি হারাম আর কোনটি হালাল সে-বিষয়ে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে। যেমন-
‘তোমাদের প্রতি যা হারাম করা হয়েছে, অবশ্যই সে সম্বন্ধে বিশদভাবে, সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করা হয়েছে’।
কোরান দ্বারা পরিষ্কার ভাবেই শুকর, মদ, জুয়া, সুদ, জেনা ইত্যাদিকে হারাম বলা হয়েছে। এই তালিকার কোথাও সংগীতের উল্লেখ নেই। কারণ, সঙ্গীত নিশ্চয়ই কল্যাণ বয়ে আনে। বয়ে আনে সৃষ্টির সৌন্দর্য। তাইতো মাওলানা জালালুদ্দিন রূমী সঙ্গীতের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য প্রেমের পথকে বেছে নিয়েছিলেন।