সালমা আক্তার চিশতী
ধর্মের মূল বিষয় হলো ইয়াকিন। ইয়াকিনের দ্বারাই ধর্ম-অধর্ম নির্ণয় হয়। এখান থেকেই শুরু ধর্ম এবং কর্ম জগতের উর্ধ্বারোহণ। নিজকে চিনার জন্য ইয়াকিন পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পাঁচ ইয়াকিন হলো বেলগায়েব ইয়াকিন, এলমুল ইয়াকিন, আয়নুল ইয়াকিন, হক্কুল ইয়াকিন, হুয়াল ইয়াকিন। মানব দেহের মাঝে একই ইয়াকিন পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যেন মানুষ খোদাকে চিনতে পারে। খোদাকে চিনার মাঝে খোদার ভেদ উন্মোচণ করা যায়। খোদা অচেনা রূপ ধরে এই নাছুতের দেশে ঘুরে বেড়ায়। খোদার ভেদ জানতে হলে নিজ সম্পর্কে চেতন থাকতে হবে। কারণ, একজন কামেল ইনসান ব্যতিত খোদার ভেদ রহস্য কেউ বলতে পারবে না। মানুষ ধ্যান সাধনা করে খোদার ভেদ রহস্য উন্মোচণ করে থাকে। এই ধ্যান সাধনা করাটা সহজ সাধ্য বিষয় নয়। একটা মানুষের সারাটা জনম পার হয়ে যায় এই আমিত্বকে দূর করার সাধনা করতে গিয়ে। আমিত্ব এমন একটা ভেজাল বিষয় যা একজন মানুষের অন্তর জগতকে বিকশিত করতে বাধাস্বরূপ এসে দাঁড়িয়ে যায়। সাধারণ মানুষ এই বাধাটিকে ভেদ করতে হিমসিম খেয়ে থাকে। খাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, দৃশ্যমান খোদার বা খোদাকে দেখে উপাসনা করা আর বেলগায়েবে বা অদৃশ্য ঈমানে খোদার ইবাদত করা এক বিষয় নয়। খোদাকে দেখে বিশ্বাস করা দুঃসাহসের বিষয়।
নিরাকার খোদাকে বিশ্বাস করার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, ইহা শয়তানও পারে। যারা ইলমে এলাহীর অধিকারী তারাই খোদা চিনে এবং খোদাতে ফানা হয়ে বাকাবিল্লাহ প্রাপ্ত হয়। জ্ঞান ও কর্ম সাধনায় তারা এই হুয়াল ইয়াকিনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সাধনার পথে ততোটুকু অগ্রগামী হতে পারে যার ইয়াকিনের দরজাটা যতো শক্তিশালী। ইয়াকিন হতে অনুরাগের প্রকাশ ঘটে এবং একজন সাধক অনুরাগের বাহনে চড়ে সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারে। অনুরাগ সাধনার বলে ধ্যানের জগতে কামিয়াবী হওয়া যায় এবং মনকে স্থির করা সম্ভব হয়। যার মন নিয়ন্ত্রণ হয়েছে তার সর্ব সাধনাই সিদ্ধি। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন ‘আল্লাহর জাতের ধ্যানের একটি মুহূর্তের মর্যাদা হাজার বছর ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ খোদার প্রেম আর দুনিয়ার প্রতি প্রেম এক বিষয় নয়, সম্পূর্ন বিপরীত। যারা আল্লাহকে ভালবাসে তারা এই মানব জনমে খোদার খাটি বান্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যার ইয়াকিন যতোটুকু তার কর্ম সাধনার ফল ততোটুকু উন্নতি লাভ করবে। নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে যারা বে-খেয়াল তারা খোদার ভেদ জানতে পারবে না। কারণ, নিজকে চেনা মানেই খোদাকে চেনা। এ বিষয়ে যারা গাফেল তারা কি করে সে ভেদ পাবে। খোদার ভেদ-রহস্যের মূল হলো মানুষ। যারা অচেতন-গাফেল তারা নিজেরাই জানে না যে, তারা জাহান্নামের অতুল সাগরের মাঝে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। অচেতন থাকাটাই হলো ইহকাল।
বেলগায়েব ইয়াকিন বা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানদারের প্রথম কাজ। কিন্তু অদৃশ্যের বিপরীত দৃশ্য বা হুয়াজ জাহেরু। সেজন্যই কালেমার ‘লা ইলাহা-র’ অর্থ হলো অদৃশ্য উপাস্য আমার উপাস্য নয়। ‘ইল্লাল্লাহ-তে’ দৃশ্যমান আমার উপাস্য। এখানেই শয়তানের যতো বাধা, শয়তান দৃশ্যমান খোদাতে বিশ্বাসী নয়। যারা শয়তানের গুণ-খাছিয়তে আছে তারও দৃশ্যমান খোদাতে বিশ্বাসী নয়। মুসলিম বিশ্বে তাদের সংখ্যা ৭২ কাতার। কারণ, সবাই ‘লা ইলাহা-তে বিশ্বাসী ‘ইল্লাল্লাহ-তে’ (দৃশ্যমান খোদাতে) বিশ্বাসী নয়। ‘লা ইলাহা’ হলো তনজিয়া আর ইল্লাল্লাহু হলো তসবিয়া। লা ইলাহা নফী আর ইল্লাল্লাহ হলো এসবাত। বেলগায়েব হলো অদৃশ্য বিশ্বাসী। বেলগায়েবের মানে অদৃশ্য খোদা। তবে শূন্যের মাঝেই সমস্ত কারণের কারণ, মূর্তের বিমূর্ত। কারণ, শূন্য হলো পূর্ণ। শূন্য হতেই শুরু এবং সবই শূন্যের রূপ। যেই জায়গায় শেষ সেই জায়গা থেকেই শুরু। সে অদৃশ্য হতে দৃশ্যে আসার জ্ঞানকে/জানাকে ইলমুল ইয়াকিন বলে বা এলেম দ্বারা নিজেকে জানা হলো এলমূল ইয়াকিন। এই এলেম স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার এলেম নয় এই এলেম হলো মুর্শিদের তরফ থেকে প্রাপ্ত এলেম। জানার মাঝেই রয়েছে আসলের রূপ পরিচয়-দরশন করার মর্ম। জানা/জ্ঞান না হলে খোদাকে চেনা হবে না। কারণ, জ্ঞানই নূর, তার তো শেষ নেই। কারণ, আজ্জাতু কুল্লুহু আলিমুন। এলেম দিয়ে জানার পর আল্লাহর বাসিরূন শক্তির দ্বারা নিজ অস্তিত্বকে দেখা এই রূপ অবস্থানটি হলো আইনুল ইয়াকিন।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলছেন ‘হযরত আবু তালিবের পুত্র ব্যতিত আমাকে কেউ দেখেনি।’ এই দেখাটি কোন দেখা তা জানাটাই হলো জ্ঞান। তা জানতে হলে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর এলেমের শহরে সাথে যোগ সূত্র স্থাপন করতে হবে। হযরত মাওলা আলী (আঃ) হলো তার দরজা। এই দরজার ধার উন্মোচন করতে হলে মাওলা আলী (আঃ)-এর মতো বাঘের উপর সোয়ার হতে হবে। অনুরাগের বাহনে দাঁড়াতে পারলে তবে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। এমকান ও ওয়াজেব এক দরশন হলো হক্কুল ইয়াকিন। বাকাবিল্লাহ্র স্তরে পৌঁছে যাওয়া হলো হুয়াল ইয়াকিন। হুয়াল ইয়াকিনের ভেদ গোপন আছে, একমাত্র জ্ঞানীগণই তার ভেদ বুঝেন। তবে এ বিষয়ে কোরানে বলা হয়েছে, “তুমি তোমার রবের বন্দেগী করো ইয়াকিন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত।” হুয়াল ইয়াকিনে পৌঁছলে তার আর কোনো বন্দেগী থাকে না। এ স্তরে পৌছলে হয় বন্দেগী করানেওয়ালা। পাক পাঞ্জাতন অর্থাৎ হযরত ফাতেমা (আঃ), হযরত হাসান (আঃ), হযরত হোসাইন (আঃ), হযরত মাওলা আলী (আঃ) ও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। তাঁরা প্রত্যেক মানুষের সাথে বাস করে। পাঁচ বস্তুর সাথে পাঁচ আত্মা, পাঁচ নফস, পাঁচ ইয়াকিন ইত্যাদির সমাবেশ ঘটে একজন মানুষ এই ধরাধামে প্রকাশ হচ্ছে। কারণ, এই পাঁচ ইয়াকিনের সাথে পাঁচ কালেমা সম্পর্ক রয়েছে। কালেমার ভেদ জানা হলে খোদার মূল ভেদ জানা যায়। খোদা এই পঁচিশ বন্দের ঘরে ধরা পড়েছে, অথবা বলা যায় ১২-এর ঘরে খোদা বা মানুষ মোহনায় খোদা জ্ঞানীর কাছে ধরা পড়েছে। একজন কামেল ইনসান বেলগায়েব হতে হুয়াল ইয়াকিন পর্যন্ত একই দরশন করে থাকেন। কারণ, সে সৃষ্টির ভেদ রহস্য দেখতে পায়, জানতে পারে। মূলতঃ আল্লাহই সর্ব দ্রষ্টা। তাঁর অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা সে ভেদ-রহস্য জানতে পারে। মানুষ হলো আল্লাহর ভেদ। অহেদাল অজুদের সাথে হক্কুল ইয়াকিন এর যোগ সূত্র রয়েছে এবং ওয়াজেবুল অজুদের সম্পর্ক রয়েছে হুয়াল ইয়াকিনে। এই অজুদ সম্পর্কে জানতে হলে খোদার সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগ রাখলে তবে সর্ব কিছুর মূল জানা যাবে। জানার পূর্ণতা তখনই মিলবে যখন নিজ অস্তিত্বের মাঝে খোদার রূপ শৈলী ফুটে উঠে। নিজ অস্তিত্বের মাঝে খোদার রূপ দরশন করাটাই বা ঐক্যতায় স্থিত থাকাই হলো হুয়াল ইয়াকিন। এখানে দুইয়ের পর্দা উঠে যায়।
খোদার রূপ দরশন করার জন্য কিছু কর্ম সাধনা আছে তা করতে হবে। এই পথ পরিক্রমাগুলো গুরুর দেওয়া হতে হবে। তবেই মরা গাছে ফুল ফুটবে। কারণ, গুরুর দয়া ছাড়া একজন শিষ্য তার মূল অবস্থানে পৌঁছাতে কখনোই পারবে না। হাদিস হতে জানা যায় ‘‘তালিবুদ্দুনিয়া মুয়ান্নাস, তালিবুল উকবা মামদুদ্, তালিবুল মাওলা মুযাক্কার।” অর্থাৎ দুনিয়ার সন্ধানীগণ স্ত্রীলোক, পরকালের সুখ সন্ধানীগণ নপূংসক এবং মাওলার সন্ধনীগণ পুরুষ। পুরুষত্ব যারাই অর্জন করেছে তারাই ইয়াকিনের পূর্ণতা প্রাপ্ত হচ্ছে। তাঁদের অজুদটি হলো খোদার তরফ থেকে সাধারণ মানুষদেরকে তাঁর রূপ দরশন করার জন্য এনায়েতস্বরূপ। যেমন দই তৈরী করতে হলে দুধের সাথে অল্প করে দই মিশাতে হয়, দই না মিশিয়ে দই পাতলে দই হবে না দুধটা নষ্ট হয়ে যাবে তেমনি হয় একজন ইসানুল কামেলের অবস্থান। কারণ, তার নিজ গুরুর কাছ থেকে কিছু অর্জন না করে সে একজন কামেল ইনসানে পরিণত হতে পারবে না। মানুষ অচেতন জীব তাই খোদার আসল লীলা দেখতে পায় না। কারণ, তা দেখতে হলে দিব্য দৃষ্টি অর্জন করতে হবে সেই অচেতন ঘুম ভাঙ্গাতে হলে হক্কুল ইয়াকিন অর্জন করতে হবে।
হক্কুল ইয়াকিনের দরজাটার মালিক হলো মাওলা আলী (আঃ)। আল্লাহপাক তাঁর জবানীতে (হাদিস কুদসিতে) বলে দিয়েছেন “আল ইনছানু সিররী ওয়া আনা সিররুহ।” অর্থাৎ মানুষ আমার গোপন ভেদ এবং আমি মানুষের গোপন ভেদ। হুয়াল ইয়াকিন যার অর্জন হয়েছে সে এই হাদিসের ভেদ জানেন। মুখস্ত বিদ্যার মতো জানলে চলবে না তা অর্জন করতে হবে। মাওলার ভেদ সম্পর্কে জানলেওয়ালা একজন কামেল অলীর সঙ্গ করলে তবেই অসিমের ভেদ সম্পর্কে জানতে পারবে।
খোদার ভেদ রহস্যের ভান্ডার সম্পর্কে অবগত হতে প্রথমে হক্কুল ইয়াকিন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। খুব কম সংখ্যক মানুষ হুয়াল ইয়াকিনের দরজা হাসিল করতে পারে। হুয়াল ইয়াকিন দ্বারা খোদার ভেদ জানা যায়। যারা খোদাকে চিনতে পেরেছে তাদের মন আর বদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না। কারণ, তাঁরা হলো মুক্ত মনের অধিকারী। প্রবাদ বাক্য রয়েছে ‘গাছের গোড়া কেটে আগার মাঝে পানি ঢাললে কি ফল হবে’ তেমনি হুয়াল ইয়াকিন প্রতিষ্ঠিত হলে ধীরে ধীরে অনুরাগ বাহনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। নয় তো একজন সাধকের মূল উদ্দেশ্য/লক্ষস্থলটিতে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। সর্ব কিছুর মূল হলো মুর্শিদের ভেদ উন্মোচন করা। মুর্শিদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই হলো সব ইয়াকিনের মূল।