হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
তারপর আল্লাহপাক ঐ নূরকে হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের মেরুদন্ডে স্থাপন করলেন এবং ক্রমাগতভাবে ঐ নূরকে এক মেরুদন্ড থেকে অন্য মেরুদন্ডে স্থানান্তর করতে থাকলেন। যখন এ নূর হযরত খাজা আবদুল মোত্তালিবের মেরুদন্ডে অবস্থান করলো, তখন তা দুই ভাগে পরিণত হলো। এক ভাগ হযরত আবদুল্লাহর মেরুদন্ডে স্থানান্তর হলো। যে নূর হতে হাবিবে খোদা হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের আগমন হলো এবং দ্বিতীয় ভাগ হযরত আবু তালিবের মেরুদন্ডে স্থানান্তর হলো। যে নূর দ্বারা হযরত আলী আলাইহিস্ সালামের আগমন হলো। হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম হতে হযরত ফাতেমা আলাইহিস সালামের জন্ম হলো। হযরত আলী আলাইহিস্ সালাম এবং হযরত ফাতেমা আলাইহিস্ সালামের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হলো এবং এ দুই পবিত্র নূরের মাধ্যমে চতুর্থ এবং পঞ্চম নূরের প্রকাশ ঘটলো অর্থাৎ ইমাম হাসান ও হুসাইনের জন্ম হলো। এভাবেই নবুয়তী পাক পাঞ্জাতনের আগমন ঘটলো। যদিও নবুয়তী পাক পাঞ্জাতনের গোপন ভেদসমূহ সিনার ইলেমের অধিকারীদের নিকট পুশিদায় রয়েছে। উক্ত আয়াত সম্পর্কে ইবনে মাসুদ, জাবের, আনাস এবং হযরত উম্মে সালমা হতেও বর্ণিত আছে যে, এ আয়াত পাক পাঞ্জাতনের শাণে নাযিল হয়েছে।
দ্বিতীয় রেওয়াতটি হলো, হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের সৃষ্টির পর আদম হতে পয়দা হলো হযরত হাওয়া। হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের অজুদ সৃষ্টি করে চল্লিশ দিন শুকানো হয়েছিল। তারপর আদম আলাইহিস্ সালামের দেহে রূহ নাযিল হলো (নাফাকতু ফিহি মির রূহী)। প্রথমে আদম আলাইহিস্ সালামের দেহে অন্ধকার দেখে রূহ প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর ললাটে নূরে মোহাম্মদী স্থাপন করা হয় এবং তাতে দেহের অন্ধকার বিদূরিত হয়। তখনই আদম মানবরূপ ধারণ করে এবং হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে শব্দ করলেন। জবাবে আল্লাহ পাক ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললেন। এরপর ফেরেশতাগণ আদমকে সেজদা করেন এবং আজাজিল সেজদা দিতে অস্বীকার করে কাফের শয়তানে পরিণত হয়। এ সেজদা মুলতঃ আল্লাহর জন্যই ছিল এবং আদম-আল্লাহ পৃথক ছিল না। আর আদম যেহেতু চিরঞ্জীব বা লা-মউতে স্থিত বিধায় আদমের দিকে সেজদা মানে আল্লাহকেই সেজদা করা। ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য করণীয় দিক নির্দেশনা হিসাবে আদমকে সেজদা করানো হলো ফেরেশতা দিয়ে বিধায় এখন তারাই নাজাতপন্থী দল যারা আদমকে সেজদা করবে, অন্যেরা শয়তান মরদুদের দল। তবে আদমকে সেজদা করতে হলে আদম চিনে নিয়ে (ঈমানসহ) তাকে ফিল আরদে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিতে হবে। আর আদম না চিনলে আল্লাহকেও চিনা যাবে না। আদম ব্যতিত আল্লাহকে যারা পৃথক জ্ঞান করে অনুমান-কাল্পনিক ভাবে সেজদা উপাসনা করে এরা মূলতঃ শেরেকীতে লিপ্ত আছে এবং এরাই হলো তাগুতের পূজারী। কারণ, আদম আল্লাহর সীরাত ও সুরাত নিয়ে স্থিত আছেন এবং এ কামেল ইনছানই আল্লাহর গোপন রহস্য (আল ইনছানু সিররী) বিধায় আদমকে সেজদা করলে তা মুলতঃ আল্লাহকেই করা হলো।
‘মৌলুদে বরজিঞ্জি’ নামক বিখ্যাত কিতাবে আল্লামা শরীফ বরজিঞ্জি লিখেছেন, আল্লাহপাক যখন হাকিকতে মোহাম্মদীকে প্রকাশ করার ইচ্ছা করলেন তখন হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে পয়দা করলেন এবং তাঁর ললাটে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নূর স্থাপন করলেন। ‘আহসানুল মাওয়ায়েজ’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, একদিন আল্লাহপাকের কাছে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম প্রার্থনা করলেন নূরে মোহাম্মদী দর্শন করার জন্য। তখন আল্লাহপাক নূরে মোহাম্মদীকে আদম আলাইহিস্ সালামের দু’হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলীকে স্বচ্ছ আয়নার ন্যায় বিকশিত করলেন। ইহা দেখে আদম আলাইহিস্ সালাম উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখ চুম্বন করতঃ উহা চোখে লাগালেন এবং নবীজিকে দেখে কলেমা পড়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনলেন। অতঃপর এ সুন্নত তাঁর বংশধরের মধ্যে প্রচলিত হয়ে গেল। এ কথাটি তাফসীরে ‘রুহুল বয়ানে’ বর্ণিত আছে। তাই আযান শুনে বা আযানের মধ্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নাম শুনে অঙ্গুলী চুম্বন করা হলো সুন্নত। এ সুন্নত যারা পালন করেন আল্লাহপাক তাদের সমুদয় গুণাহ মাফ করে দিবেন। এ ঘটনাটি শায়খ ইমাম আবু তালিব মোহাম্মদ বিন আলী মক্কী তাঁর ‘কুতুল কুলুব’ কিতাবেও বর্ণনা করেছেন।
হযরত আদম আর হাওয়া যখন বেহেশতে ছিলেন, তখন আদম হাওয়ার রূপ-সৌন্দর্যের অনেক প্রশংসা করে বললেন যে, হযরত হাওয়ার চেয়ে সুন্দর আল্লাহপাক আর কাউকে সৃষ্টি করেননি। এ কথা শুনে আল্লাহপাক জিবরাইলকে নির্দেশ দিলেন আদমকে বেহেশত ফেরদৌসে নিয়ে যাবার জন্য। বেহেশতের একটি ঘোড়াতে তুলে আদমকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। একটি অতুলনীয় সৌন্দর্যময় প্রাসাদের সামনে যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন প্রাসাদের দরজা দিয়ে একটি মেয়ের রূপ দেখে হযরত আদম বেঁহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। চেতনা ফিরে পাবার পর জিজ্ঞেস করলেন, জিবরাইল ঐ মেয়েটি কে ? জিবরাইল বললেন, আখেরী নবীর মেয়ে হযরত ফাতেমা আলাইহিস সালাম।
অন্য বর্ণনা হতে আরো জানা যায় যে, যখন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম জান্নাতুল ফেরদৌসে হযরত ফাতেমাকে দেখলেন, তখন তাঁর মাথায় একটি তাজ আর দুই কানে দুইটি দুল, কোনো কোনো বর্ণনায় ফুল দেখতে পেলেন। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে আল্লাহপাক বললেন, হে আদম, যার পবিত্র নাম আমার আরশপাকে লিখিত দেখতে পেয়েছ সেই হাবিব মোহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের মেয়ে হলো এ নারী। তাঁর নাম হলো ফাতেমা। আমার সমস্ত সৃষ্টির সৌন্দর্যের সমাবেশ ঘটেছে এ ফাতেমার মধ্যে। তুমি তাঁর মাথায় যে তাজ দেখেছ সেই তাজ হলো তাঁরই স্বামী হযরত আলী আলাইহিস্ সালাম। আর দুই কানে যে দুল বা ফুল দেখেছ তা হলো তাঁরই দুই পুত্র হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন আলাইহিস্ সালাম। আমার হাবিব মোহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম এবং বাকি চারজন তাঁর পবিত্র আহলে বাইয়েত মোট পাঁচজনকে আমি তোমার সৃষ্টির নয় লক্ষ বৎসর পূর্বেই সৃষ্টি করেছি। এ পাঁচজনই হলো পবিত্র পাঁচ তন তথা পাক পাঞ্জাতন-যাদের প্রতি মহব্বত রাখা উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ওয়াজিব বলে কোরানের ঘোষণা করেছেন (সুরা আহযাব- ৩৩)।
হাকেম, বায়হাকী এবং তিবরানী স্বীয় গ্রন্থ ‘আস্ সগীরে’ এবং আবু নায়ীম ও ইবনে আসাকির হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যখন গন্দম খেলেন, তখন তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন – হে আমার রব ! আপনি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের উছিলায় আমার মাগফেরাত করে দেন। তখন আল্লাহপাক বললেন, হে আদম ! তুমি মোহাম্মদকে কিভাবে চিনলে ? হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম বললেন, যখন আপনি আমাকে সৃষ্টি করে আমার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিলেন, তখন আমি মাথা তুলে আরশে গায়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ” লিখিত দেখলাম। এ থেকে বুঝতে পারলাম, ইনিই আপনার সর্বাধিক প্রিয়। আল্লাহপাক বললেন, “হে আদম ! মোহাম্মদকে সৃষ্টি না করলে আমি তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।” এ হাদিসটি ইবনে আসাকির কা’বে আহবার হতে এবং হযরত মাওলা আলী আলাইহিস্ সালাম হতে বর্ণনা করেছেন। ইবনে আদী হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে, আবু ইয়ালা, তিবরানী তার স্বীয় গ্রন্থ ‘আওসাতে’, হাসান ইবনে আরফা তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘জুযে’ আবু হুরায়রা হতে, বাযযাজ আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং হযরত আবুজর গিফারী হতে, দারে-কুতনী স্বীয় ‘আফরাদ’ কিতাবে আবু দারদা এবং হযরত জাবের হতে, আবু নয়ীম তার ‘আল-হিলইয়া’ কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে এবং তিবরানী ওবাদা ইবনে সামেত হতে বর্ণনা করেছেন। সবগুলো বর্ণনার মূল কথা একটিই আর তা হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ” -এ কলেমার বর্ণনা। মেরাজের বর্ণনায়ও এ ধরনের হাদিসের উল্লেখ রয়েছে-যার বর্ণনা হতে জানা যায় আরশ, কুরশী, লওহ, কলম, বেহেশতের পত্র-পল্লবে, দরজায়, হুরদের কপালে সর্ব কিছুতেই এ কালেমা লেখা রয়েছে।
বায়হাকী এবং ইবনে আসাকির হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, রাছুলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলেন, যখন হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সৃষ্টি করলেন, তখন তাকে তাঁর সন্তান-সন্ততি দেখালেন। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম তাদের পারস্পারিক শ্রেষ্ঠত্ব নিরীক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি একটি চমকদার নূর দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হে আমার রব ! এ কে ? আল্লাহপাক বললেন, এ তোমার সন্তান আহামদ। সে-ই প্রথম এবং সে-ই শেষ। সেই সর্বপ্রথম শাফায়াত করবে।
হযরত আদম আলাইহিস সালাম যখন পৃথিবীতে আগমন করেন তখন তাঁর সাথে সমস্ত পয়গাম্বদের সম সংখ্যক লাঠিও নাযিল হয়েছিল (খাসায়েসুল কুবরা, ২য় খন্ড)। কোনো কোনো বর্ণনা হতে জানা যায়, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যখন বেহেশত হতে আগমন করেন তখন একটি লাঠিও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সেই লাঠিই বংশ পরম্পরায় মুসা নবীর নিকট এসেছিল।
বিষয়টি বুঝার দরকার যে, এ লাঠি যার নিকটই থাকবে সে-ই খোদার রহস্যের জগতে প্রবেশ করতে পারবে এবং সে-ই হলো সত্যিকারের ওলী – যে হবে গুরু বা পীর বা মুর্শিদ। ইহা একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত লাঠি কোরানে সুরা বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াতে ভেদ-ঈশারায় তার বর্ণনা রয়েছে। যদিও কোরানের আরো বহু জায়গায় এ লাঠির কথা বর্ণিত আছে। কোরানে মুসা নবীর ঘটনায়ও এ লাঠির বর্ণনা রয়েছে। ইলমে সিনার অধিকারীগণ ব্যতিত আর কেহই তার সন্ধান জানে না। এ জন্য অনেক মৌলবীরা বলে থাকেন যে, লাঠি ব্যবহার করা সুন্নত। মূলতঃ তারা যা বলছে তা হলো লাঠির প্রতীক বা রূপক, তার হাকিকত বুঝেনি।