সালমা আক্তার চিশতী
মানব জনমকে সুন্দর করার মাঝে রয়েছে খোদার রহমতের দরজায় পৌঁছে যাওয়া। যেমন, একটি বেলুন যখন আমরা ফুলাই তখন যদি বেলুনটি বেশি ফুলানো হয় তখন বেলুনটি ফেটে হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে আবার অনেক সময় বেলুনটি ফেটেও যায়, তেমনি একজন মানুষ যখন অচেতন হয়ে পড়ে তখন তার অন্তরের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যায়। আর এই সৌন্দর্য্য নষ্ট হওয়ার মূল হলো হায়ানী স্বভাবের বাধ্য হওয়া যা দ্বারা ইনসানী আত্মা হারিয়ে যায়, নিজেকে গুরুর অনুগামী রাখতে পারলে ইনসানিয়াত প্রতিষ্ঠিত করা যায়। বন্ধুর দয়া লাভ করতে চাইলে বন্ধুকে অনুসরণ করতে হবে। এই অনুসরণ সঠিক ভাবে করতে পারলে একজন কামেল ইনসানে পরিণত হওয়া যাবে। কামেল ইনসান বা কামালিয়াত অর্জন করাটা সহজ নয়। তা অর্জন করতে হলে খোদার প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যেমন – শীতকালে গাছের পাতা ঝড়ে পরে। এই পাতাগুলোকে কোনক্রমে ধরে রাখা যায় না, তেমনি যারা ঈমান শূন্য হয়ে গেছে তারা তরিকতের জগত হতে ঝরে পরে যাবে। কারণ, খোদাকে চিনা না হলে খোদার ভেদ জানা হবে না। যারা ভাবুক সদাসর্বদা নিজ প্রবৃত্তির দিকে খেয়াল রাখে, তারা পারে নিজ ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কারণ, ভাব না থাকলে একজন ইনসানে পরিনত হওয়া যায় না। এই ভাবটা হবে বৈরাগ্যময়ী।
এলমে এলাহীর অধিকারী হওয়াটাই হলো নব সৃষ্টির দিকে ধাবিত হওয়া। কারণ, যারা আধ্যাত্মিক এলেম অর্জন করবে তারা এই মানব জনমে অমরত্ব লাভ করবে। অমরত্ব কিভাবে অর্জন করা যায় তা একজন মুর্শিদ জানিয়ে দিতে পারে। তাই সদাসর্বদা মুর্শিদের নিরিখ ঠিক রাখতে হবে। যেমন – একটি বাড়িওয়ালা যখন তার বাড়ির দেয়াল তৈরী করে, তখন দেয়াল বা ওয়াল তৈরি করতে ইট, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি লাগে। এই ওয়ালটিকে বালু আর সিমেন্ট দিয়ে প্লাষ্টার করা হয়। ওয়াল যখন সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে যায় তখন তার মাঝে রং করা হয়। তেমনি একজন মানুষের দীলে যখন আগুন বস্তুর অন্ধকারে আবৃত থাকে তখন তা পরিশুদ্ধ করতে হলে নফস মোৎমাইন্নার সবুজ রং দ্বারা তা পরিশুদ্ধ করা যায়। মনকে পরিশুদ্ধ করার মাল মসলা হলো আদব – নম্রতা, তমিজ – তাজিম। এই জান্নাতি গুণ। মানুষের কর্ম হলো এই জান্নাতি গুণগুলোকে ধারণ করা। এই অবস্থানটি তৈরী হয় একজন মানুষের দীলে। কারণ, ওয়ালটি যখন প্রথম প্লাষ্টার থাকে, তখন ঘরের সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায় না আর যখন রং করা হয় তখন ওয়ালের সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায়।
আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশ্তী নিজামী (কুঃ ছেঃ আঃ) বলছেন –
“যারা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত তথা সিবগাতাল্লাহ্-এ ভূষিত তথা প্রভূসত্তার বৃত্তিতে সিক্ত তারাই হলো ধার্মিক।”
আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হতে গেলে এই নফস আম্মারার কালো রং-কে বদলিয়ে সবুজ রং দ্বারা সুসজ্জিত করতে হবে। দীল দ্বারাই একজন মানুষের সুন্দরতম দিকগুলো ফুটে ওঠে, এই ফুটে ওঠার মাঝে রয়েছে একজন শিষ্যের অবস্থান তৈরি করার সুফল। গুরু বা মুর্শিদ একজন শিষ্যের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য অনেক পথ অবলম্বন করবে। শিষ্য যদি ধৈর্য্য ধারণ করে অগ্রগামী হতে পারে তবেই পারবে ঈমানদার হতে। যেমন – দুইটি বোতলের মাঝে মধু ও বিষ ভরে রাখলে একজন চেতন মানুষ তার নিজের জন্য মধুর বোতলটি বেছে নিবে। কারণ, সে বিষের জ্বালা সহ্য করেই মধুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর যারা অচেতন তারা মধুর স্বাদ গ্রহণ করতে গিয়ে বিষের বিষাক্ত এক কুয়ার মাঝে নিজেকে অজান্তে ফেলে দিবে, এই অবস্থানটির ভেদ রয়েছে।
হায়ানিয়াতকে তারা মধুর মতো মনে করে, হায়ানিয়াতের বিষকে ধারণ করে নিচ্ছে, আর একজন মুর্শিদ ঈমান পরীক্ষা করার জন্য মধু আর বিষের বোতল সামনে রেখে দিয়েছে। যারা ঈমানদার হবে সে মধুর বোতলটি বেছে নিবে আর যার তকদির খারাপ সে বিষ পান করে নিজ ঈমানের সাথে সাথে নিজ ছুরত হারাবে। এই হারিয়ে যাওয়াটা অনেক ভয়াবহ। কারণ, ছুরত বদল হয়ে গেলে আর কোন জনমে মানব ছুরত পাওয়া যাবে কিনা তা সন্দেহজনক হয়ে থাকবে। কর্মফল দ্বারাই মানব ছুরত, না হলে পশুর ছুরত। নফস আম্মারার আবরণটি অনেক গভীর, এই গভীরতা কাটাতে হলে ইনসানিয়াত ধারণ করার হাতিয়ার লাগবে। এই হাতিয়ারটি হলো ‘জুলফিকার’। ‘জুলফিকার’ হলো হযরত আলী (আঃ) এর তলোয়ার, তা দুই দিক দিয়েই কাটে। এই কাটার যোগ্যতা যারা মুর্শিদের নিকট থেকে জেনে নিতে পারে তারা নিজ মানব জনমটাকে বিপদমুক্ত করতে পারবে। যেমন – একটি বাচ্চাকে ভালো এবং মন্দ বুঝালে তা সে বুঝবে না, যাদের তকদিরে ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা নেই তারা এই অবুঝ বচ্চার মতো। তারা পশুর মতো এই পৃথিবীর মাঝে ঘুরে বেড়ায়, যদিও আকৃতি মানুষের মতো।
হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রাঃ) বলছেন – “যে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়াছে, সেই প্রকৃত আরেফ। আরেফ লোকটি পৃথিবী আলোকিতকারী সূর্যের মত। তার আধ্যাত্মিক আলোকে বিশ্ব আলোকিত হয়।” যত মহাপুরুষ এই পৃথিবীর বুকে রয়েছে তারা এই আধ্যাত্মিক জগতের মাঝে উজ্জল নক্ষত্র রূপে চিরস্থায়ীত্ব নিয়ে অমর হয়ে থাকে। যারা চিরস্থায়ী হয়েছে তারা এ লোকসমাজ থেকে দূরে অবস্থান নিতে চায়। কারণ, লোক সমাজের সাথে টিকে থাকাটা আর নিজ ঈমানকে হেফাজত করাটা অনেক দুঃসাহসের বিষয়। যার ঈমান যতটা পরিপূর্ণ হয়েছে সে ততটা স্বাধীন সত্তার অধিকারী হয়েছে। স্বাধীন সত্তাটি এইরূপ হবে যেই সত্তার মাঝে খোদার গোপন ভেদ রহস্য উন্মোচিত হবে। এই উন্মোচনটার দ্বারা খোদার রহস্যের ভান্ডারের দ্বার খুলে যাবে। কারণ, মন যতটুকু নির্ভেজাল হয়েছে ততটুকু বেহেশতী সুঘ্রাণ প্রাপ্ত হয়েছে। বেহেশতী সুঘ্রাণ হলো নির্ভেজাল দেশ অর্থাৎ মানব আত্মার জাগরণ ঘটিয়ে মোহমুক্ত দেশে বিচরণ করা। এই করাটার মাঝে দুই রকমের দিক রয়েছে একটি দিক হলো দীলে মুখে ঠিক রাখা। আর একটি দিক হলো দীলের ঠিক নেই কিন্তু মুখে মুখে স্বীকার করা। তারা হবে ‘আসফালাস সাফেলীন’ অর্থাৎ নিন্ম থেকে নিন্মগামী। যারা ঈমানটাকে আঁকরে ধরে রাখবে তারা দীলে মুখে এক করে গুরু ভজন করবে। তারাই জান্নাতী হবে এই জান্নাত মোল্লা মৌলবীদের সাধারণ মানুষদেরকে শোনানো জান্নাতের মতো নয়। এর মাঝে রয়েছে আকাশ জমিন তফাত। যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানী তারা জানে জান্নাত ও জাহান্নাম কি ? যারা আধ্যাত্মিক জগতের মানব, তারা তাদের ঈমান দ্বারাই জান্নাতকে নিজ অস্তিত্বের মাঝে ধারণ করে রাখে। তাই ঈমান প্রতিষ্ঠিত করাটাই হলো একজন মানবের মূল লক্ষ্য। আর মনের জগতে যদি অনিত্য ভাব থাকে তবে ঈমান থাকবে না।
আমার দাদা হুজুর হযরত খাজা দেওয়ান শাহ্ রজ্জব আলী চিশতী নিজামী (রাঃ) বলছেন –
যদি নিত্যধামে যেতে করো বাসনা
তোমার অনিত্য দেহ থাকিতে, নিত্যের করণ হবে না।
মূল লক্ষ্যে যাওয়ার প্রতি যারা বেখেয়ালী, তারাই বিশেষ ভুলগুলি করে থাকে। এই অবস্থাটি তৈরি হয় পীর মুর্শিদের প্রতি ঈমানের ঘাটতি থাকলে। আল্লাহ তায়ালা কোরানে সূরা আরাফ ৭নং আয়াতে বলছেন “ফালানাকুচ্ছানা আলাইহিম বিইলমিউ ওয়ামা-কুন্না-গা-ইবীন” অর্থাৎ অতঃপর অবশ্যই আমি তাদের নিকট বিবৃত করব স্বীয় জ্ঞান সহকারে বা প্রমাণসহ যে, আমি অদৃশ্য ছিলাম না। যারা শুধু নিরাকারে বিশ্বাস রাখে তারা এই ভুল করে থাকে। যেমন – একটি বই যদি আমরা না দেখেই এর ব্যাপারে মন্তব্য করতে থাকি তবে কি তা ঠিক হবে? বইটির ভেদ রহস্য ব্যাখ্যা করা যাবে? কখনো না। তেমনি না চিনে না দেখে খোদা কোন দেশে অবস্থান করে তা বলা যাবে না।
খোদাকে শুধু অদৃশ্য না জেনে তাকে দেখে বিশ্বাস করাটাই হলো ঈমানের মূল। যেমন – আমরা খাবার খেয়ে থাকি এই খাবারের স্বাদ ততক্ষণই বিদ্যমান থাকে যতক্ষণ খাবারটি শেষ না হয় আর ঈমানের অবস্থানটি ঠিক বিপরীত ঈমানের স্বাদ যার ভাগ্যে গ্রহণ করা হয়েছে সেই সাধ শেষ হয় না, তা একজন মানুষকে অমরত্ব দান করে থাকে। ঐ মানুষটি দরিদ্র থেকে এই জগতের মাঝে ধনী হয়েছে। এই ধনীটা এই জগতের টাকা পয়সা দিয়ে হওয়া যায় না এই ধনী হতে গেলে মুর্শিদের প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান রাখে যারা তাঁরা হতে পারবে। কারণ, মুরিদ মানেই পরিপূর্ণ ঈমানদার নয়। তাদের অবস্থান হবে অজয়ী। যারা সর্ব অবস্থাকে জয় করে নিতে পারে তারাই পারে তরিকতের জগতে উজ্জল নক্ষত্র হতে।
এই তরিকতের জগতের মাঝে যারা নিজ বাসনাকে পরিপূর্ণ ত্যাগ করতে পারবে তারাই পারবে ঈমানদার হতে। পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। যেমন – মধু ও কালিজিরা খেলে ঠান্ডা জাতীয় রোগ সারে তেমনি নফস আম্মারার রোগ সারাতে হলে ধৈর্য্য ও অনুরাগ ধারণ করতে হবে। কারণ, নিজ অস্তিত্বের ভাল গুণগুলো ধারণ করেই খোদার গুণে গুণান্বিত হওয়া যায়। এই ভালো গুণ ধারণ করার নামই হলো সাধনা। তরিকতের জগতে নিজ অস্তিত্বকে স্বীকার করা মানেই শেরেকি। এই শেরেকি মনোভাব কাটাতে হবে। নিজ ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে দ্বিধা-দ্বন্ধ, খেয়ালিপনা বাদ দিতে হবে। এই বাদ দেওয়া মন তৈরি করতে হলে গুরুর অনুসারী হতে হবে। একজন গুরুর অনুসারী হওয়া গেলে আখেরাতে শস্যক্ষেত্র তৈরি করা যাবে। গুরু হলো উর্বর জমির ন্যায়। কারণ, উর্বর জমির মাঝে যে ফসলই বপন করা হউক না কেন তার ফলন ভাল হবে। তেমনি একজন গুরুর নিকট যাওয়ার পর তাঁর নীতি আদর্শ দ্বারা নিজ দেহ জমিনকে পরিশুদ্ধ করতে পারলে একজন মানুষ রূপে এই জগত মাঝে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে। এই অবস্থা তৈরী করা হলো মানব মুক্তির একমাত্র রাস্তা। কারণ, রাস্তা যখন কঠিন হয় তখন তা দ্বারা পথ চলা সহজ হয় না, আমরা মানব মনের অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তরিকতের সহজ রাস্তাকে কঠিন করে ফেলতেছি। এই জগতে গুরু ভিন্ন অন্য কিছু গ্রহন করাটা হলো মানব জনমের সব চেয়ে বড় ভুল। মনকে গুরু জ্ঞানের আলোকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য একজন মানুষের এই জগতে আসা হয়েছে। মূল উদেশ্য এইটাই ছিল। মানব ছুরতের সাথে ছিরাতকে ঠিক করতে হবে।