লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
দ্বীনে মোহাম্মদীর অনুসারীগণের মধ্যে এশকে মোহাম্মদীর যে ফল্গুধারা প্রবাহিত, তা সমধিক পরিণত ও প্রস্ফুটিত হয়েছে ইরানে। ফারসী সাহিত্যে। ইরানের গুলিস্তানে বুলবুল আর গোলাপের প্রণয়ে প্রণয়ে কবিচিত্ত খুঁজে পেয়েছেন জগতের এক অমোঘ সত্য। ঐশী প্রেমের পরশ। তারা মাতোয়ারা হয়েছেন প্রভুপ্রেমে তথা রাসুল প্রেমে তথা মুর্শিদ প্রেমে। সে মহিমান্বিত প্রেমের আনন্দরাশি বুলবুল গুঞ্জনের মতো সুর ঝংকারে ঝড়ে পড়েছে রুমী-জামী-সাদী-হাফিজ-খৈয়াম-আত্তার-সানাই এর কন্ঠ হতে। রাসুল (সাঃ) এর প্রেমে উদ্বুদ্ধ ফারসী কবিদের কিছু অমর কবিতার সমন্বয়ে আপন খবরের এবারের আয়োজন-
“দ্বীনে মোহাম্মদীর রয়েছে সমৃদ্ধ সাহিত্যের ইতিহাস। যদিও কথিত আচারসর্বস্ব অতিবোদ্ধারা ধর্মসাহিত্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে থাকেন, তথাপিও সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে তৈরী হয়েছে আমাদের ধর্মসাহিত্যের বিশ্বজয়ী রচনাবলী।”
রাসুল পাক (সাঃ) এর জীবদ্দশায় তাঁরই চরণতলে পেশ করা হযরত কাব বিন জুহাইর (রা) এর কবিতাটি ছিল নবীপ্রেমের এক অনন্য নিদর্শন।
“নিশ্চয়ই রাসুল (সাঃ) এমন এক নূর, যার আলোকপ্রভা প্রতিনিয়ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
মহান আল্লাহর তরবারী সমূহের মাঝে তিনি অতীব তীক্ষ্ণ এবং কোষমুক্ত তরবারি।”
জুহাইরের কবিতায় আপ্লুত রাসুল পাক (সাঃ) নিজের চাদর মুবারক উপহার দিলেন কবিকে। রাসুলুল্লাহর সভাকবি হাস্সান বিন সাবিত (রা) মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে কবিতা আবৃত্তি করে রাসুল (সাঃ) কে শুনাতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা), কাব বিন মালেক (রা), মাওলা আলী ইবনে আবু তালিব (আ), মা ফাতেমা (আ) সহ অনেকের কবিতা আরবী সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কাসিদায়ে বুরদা রাসুলের শানের এক অপূর্ব নিদর্শন।
ফারসী সাহিত্য মূলত প্রকৃত রাসুল প্রেম আর ধর্মবোধের এক উন্নত নিদর্শন। ফারসী ধর্মসাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের এক অভিনব সংযোজন। যে সাহিত্যের প্রতি পরতে পরতে রয়েছে অগাধ রাসুল প্রেমের ধনভান্ডার। দ্বীনে মোহাম্মদীর প্রকৃত দর্শন সযত্নে সংরক্ষিত হয়েছে ফারসী সাহিত্যের পাতায় পাতায়। ধর্মের গুঢ় রহস্যাবলী থেকে শুরু করে রাসুল পাক (সাঃ) এবং তাঁর আহলে বাইয়াতের প্রেম যেনো স্বমহিয়ার প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে এসব কাব্যে। নূর মোহাম্মদ (সাঃ), তাঁর মহিমা ও রাসুল প্রেমের তেমনি কিছু অমর কাব্যাংশ পাঠকদের জন্য উদ্ধৃত হলো।
বিখ্যাত ফারসী কবি শেখ সাদী (র)। যার রচিত কবিতা আজো বিশ্ব মুসলমানের ঘরে ঘরে গীত হয়। তাঁর রচিত কবিতা ব্যাতিত যেনো ধর্মানুষ্ঠান আজও অপূর্ণ।
“তুমি মানবতার পূর্ণতায় উপনীত, মোহন রূপের চ্ছটায় বিদূরিলে আঁধার যত,
সকল গুণের সমাবেশে, হে মহান! তোমার ও তোমার বংশের প্রতি সালাম অগনন।”
“কুল মাখলুকের সুপারিশকারী, হাশরের সরদার, বিচার দিনের নেতা তুমি
তুমি জগতের শ্রেষ্ঠ, প্রভুর বন্ধু, সকল নূর তোমার নূরের অনুগামী।”
“হে রাসুল, আপনি সমগ্র সৃষ্টির মূল উৎস। সকল সৃষ্টি আপনারই শাখা প্রশাখা।”
আত্মার বিজ্ঞানী মহান দার্শনিক ও কবি শেখ ফরিদুদ্দিন আত্তার নিশাপুরি (র)। তাঁর রচিত রাসুলপ্রেমের কাব্য-
“আমি আর কি বলবো? যার প্রশংসাতে স্বয়ং আল্লাহ মাতোয়ারা
যার নাম স্বয়ং আল্লাহর নামের সাথে মিলিত!
যিনি পরম প্রশংসিত, যিনি আল-আমিন
সমগ্র জগতের জন্য যিনি রহমত।
যিনি দোজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, যিনি দোজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত।”
“আদম যখন ছিলেন মাটি পানির খামির, তখন দোজাহানের বাদশাহ রাসুল আমার।
আদম অজুদে তাঁরই নূরের কিরণ, তাই ফেরেশতারা করে তারে সজুদ সমর্পন।”
“উভয় জগত ( মোহাম্মদ সা.) এর নূরে মোহিত, তাঁর পদধুলি আরশের ও কেবলা
উভয় জগত তাঁরই অস্তিত্ব থেকে পরিগ্রহ করে নাম, প্রশান্তি লাভ করে আরশ উতলা।
সকল নবী ও রাসুল তাঁর প্রশংসাকারী, সকল সৃষ্টি করে তাঁর তাবেদারী।”
ফারসী সাহিত্যের উজ্জল নক্ষত্র হাকিম সানায়ী গজনভী (র) বলেন,
“পায়ের আঘাতে তব পারস্য সিংহাসন, ভুলুণ্ঠিত কায়সারের দম্ভ অগনন।
ওলীদের মাঝে তুমি পূর্ণ দীপ্ত নূর, নবীদের মাঝে তুমি ইমামে আকবর।”
আধ্যত্মজগতের এক অত্যুজ্জল নক্ষত্র বড়পির আব্দুল কাদির জিলানী (র)। তাঁর কাসিদায়ে গাউছিয়ায় তিনি রেখেছেন রাসুল (সাঃ) প্রেমের এক অনন্য নিদর্শন।
“হে মহান, রেসালাত করিলে আবাদ, আনিলে জগতে সৌহার্দ্য অম্লান
খসরু, কায়কোবাদ, ফাগফুর যারা, তোমার চরণে হলো অবনত তন।
জগত গাহিবে তোমার মহিমা চিরকাল, যতদিন না আসিবে প্রলয় শামান
কাব কাউসিনে হলো মেরাজ তোমার, প্রভুর স্বানিধ্যে রহ চির দীপ্তিমান।
তোমার নূরের ধারায় রৌশন জাহান, জাহের বাতেন সবি হলো নূরময়
হে সম্রাট, রাসুলদের তাজ, ওলীদের মুকুট তুমি, চির প্রেমময়।
তোমার তনুর ঘামে আসে ফুলের সুবাস, অলীরা মধু পায় তোমার নামে
তোমার রহমত দিও মোদের তরে, নূরের চ্ছটা দিও মোদের মরমে।”
প্রেমরাজ হযরত জালালুদ্দিন রুমী (র)। যার প্রতিটি কথায় ঝড়ে ঝড়ে পড়ে আধ্যাত্মপ্রেমের মণি-মাণিক্য। ফারসী কাব্যসাহিত্যের দ্বিগ্বীজয়ী সম্রাটের কথায় রাসুলের শাণ-
“ইঞ্জিলে যার নাম মোস্তাফা, নবীদের সরদার, পবিত্রতার দরিয়া,
পূণ্যের আশায় কত নাছারায়, ইঞ্জিল পড়িত, ভক্তি করিয়া।
তোমার নামের তরে, ভক্তিভরে, চুমু খেত কত আশেকান!”
“আহমদ নামের গুণে পেল সবে মুক্তি, সকল বাদশাহীর আজ শেষ হলো শক্তি।
নামের গুণে আজ দুনিয়া উজালা, ঘরে ঘরে আহমদ, নামের কাফেলা।
আহদম নাম তাঁর চির মদদগার, কত নূর ঝড়ে পড়ে নামেতে তোমার ।
রুহুল আমিন তাঁর সত্ত্বা ও জাত, তোমার হেফাজতে আছে জাহান, কুল মাখলুকাত।”
নুরুদ্দীন আবদুর রহমান জামী (র)। যার প্রতিটি কথা আশেকের হৃদয়ে জ্বেলে দেয় রাসুলপ্রেমের বহ্নিশিখা, তিনি তাঁর কাব্যে বলেন,
“জাম’ আমার জন্মভুমি, পূর্ণ আমার কলম, পিয়ে আহমদী জ্ঞানের, জ্ঞানসুধা অবিরাম।”
“মানুষের তরে হলো সৃষ্টি এ সংসার, মুহাম্মদের তরে হলো সৃজন মানুষ,
মুহাম্মদী গুণ মোদের রক্ষাকবচ, নচেৎ প্রভুর নূরে না পেতাম হুশ।”
“মুহাম্মদের পবিত্র বদন মুবারকে ছায়া ছিলনা- কেননা, তিনি খোদার নূর ব্যতিত, অন্য কিছু না।”
“আহমদ, মুহাম্মদ দুটি নামে, স্রষ্ঠার সকল ভেদ গোপন
তাঁর অস্তিত্বের রহমতে, সৃষ্টি সকল পায় প্রাণ।”
“আসমানের চাঁদ তারকা, নবীর নূরে দীপ্তিমান, সংগোপনে মেরাজ তাঁহার, উর্ধ্বলোকে মহীয়ান।”
ফারসী সাহিতের অন্যতম প্রতিভাবান কবি ওমর খৈয়াম (র)। তিনি বলেন,
“হে মহান, যিনি জগতের অদ্বিতীয়! আমার মন, চক্ষু ও জিবনের চাইতেও অধিক প্রিয়।”
প্রেমিক কবি আমীর খসরু গজনভী (র)। তাঁর কাব্যে তিনি বলেন,
“তব নূরানী বদন হেরী সবে ঈর্ষাতুর, ফুলের মতন তব রুপ, হে রাসুল আমার।”
ফারসী কাব্যসাহিত্যের অন্যতম কবি নিজামী গজনভী (র)। তিনি বলেন,
“প্রেরিত পুরুষ আহমদ, প্রজ্ঞা যার সত্ত্বার আবরণ, যার নূরের বাধা উভয় জাহান।
আদম থেকে ঈসা সকলের শ্রেষ্ঠ তিনি, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আল-আমিন, আদিঅন্তের নবী যিনি।”
ফরাসী কাব্যসাহিতের খ্যাতিমান কবি মালেকুশ শোয়ারা খোরাসানী (র) বলেন,
“হে নবী, তোমার দয়ায় মোদের মিলিবে জান্নাত, নেয়ামত,
তোমার গোস্বায় মোদের ধ্বংস, নরকবাস, অনিবার্য মউত।
অন্যতম ফারসী কবি রোকনুদ্দিন আওহেদী (র) বলেন,
“শিরে তব চিরদিন, গৌরব তিলক, সকল রাত্র তোমার শবে মেরাজ,
ইশারায় খন্ডিত যামীনির নূর, হাতের মুঠোয় করে সূর্য বিরাজ।”
“মাখলুক জ্যোতির্ময় ইলেমে তব, হাওয়া সেপাহী তোমার রহে হরদম,
তোমার আদেশে কথা বলে যে পাথর, তোমার সুবাসে পায় মৃত্যু ও জনম।”
ফারসী দার্শনিক ও কবি খাকানী শিরয়ানী (র) বলেন,
“হে চির বিজয়ী, তব উচ্চ তব শান, হে পবিত্র, তব অবয়ব, কতই মহান।
হে রাসুল, তব এক শ্বাসের দশমাংশের দাম, না দিতে পারে কভু উভয় জাহান।”
রাসুলপ্রেম, দ্বীনে মোহাম্মদী, আহলে বাইয়াত সহ ধর্মের সকল গুঢ় তাৎপর্য ও রহস্যাবলী নিয়ে সবচাইতে বেশি সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে ফারসী ভাষায়। উর্দু এবং বাংলাতেও রাসুল (সাঃ) এর শান মান নিয়ে রচিত হয়েছে প্রচুর কাব্যসাহিত্য। রাসুল (সাঃ) এর শান মান ও তাঁর প্রেমে বিগলিতচিত্ত ফারসী কবিদের সমুদ্রসম গভীর সাহিত্যকর্ম থেকে যৎসামান্য কাব্যাংশ একত্রিতকরণের প্রয়াস করা হলো।
রচনাকাল – 11/11/2017
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী