পত্রিকা – আসরারে পাঞ্জাতন ৮ম সংখ্যা

হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

‘আরজাহুল মাতালিব’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, একদিন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ! আমার চেয়ে প্রিয় কোনো কিছু কি আপনি তৈরী করেছেন ? এ কথার কোনো জবাব হযরত আদম আল্লাহর পক্ষ হতে না পেয়ে আবারো একই প্রশ্ন করলেন। এ ভাবে তিনবার কোনো উত্তর না পেয়ে চতুর্থবার ওয়াস্তাগফার পাঠ করলেন। তারপর আল্লাহপাক বললেন, হে আদম! আমি যদি তাদেরকে পয়দা না করতাম, তবে তোমাকেও পয়দা করতাম না। আদম আলাইহিস্ সালাম আল্লাহর সেই প্রিয়জন দেরকে দেখার বাসনার্থে প্রার্থনা জানালেন। ফেরেশতাগণকে আল্লাহপাক হুকুম করলেন আরশের পর্দা উঠানোর জন্যে। আরশের পর্দা উঠানোর পর হযরত আদম পাঁচটি নূরময় সুরত দেখতে পেলেন। একটি মাঝে আর চারটি তাঁর চারদিকে ঘিরে রয়েছে। আদম আলাইহিস্ সালাম জানতে চাইলেন এরা কারা ?

আল্লাহপাক পরিচয় দিয়ে বললেন, ইনি আমার হাবিব শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম, তিনি আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী, উনি আখেরী নবীর মেয়ে হযরত ফাতেমা, আর ইনারা দু’জন মাওলা আলীর দু’সন্তান হাসান ও হুসাইন আলাইহিস্ সালাম। হযরত আদম যখন পৃথিবীতে চলে আসেন তখন ঐ পাঁচ জনের উছিলায় গুনাহ মাফের প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহ পাকও তাকে মাফ করে দিলেন। আবার কোনো কোনো বর্ণনায় আছে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের উছিলায় আল্লাহপাক তাঁর গুনাহ মাফ করে দিলেন [আশ্শেফা-১ম খন্ড]। আসলে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের সাথেই তাঁর আহলে বাইয়েত চিরবর্তমানে স্থিত আছে। মোহাম্মদ তাঁর পবিত্র আহলে বাইয়েত ছাড়া নয় এবং আহলে বাইয়েতও মোহাম্মদ ছাড়া নয়, উভয়ই একরূপ ধারণ করে চিরবর্তমানে স্থিত আছে। খফির ঘর মোহাম্মদ আর সে ঘরের অদিবাসী চারজন আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন আলাইহিমাস্ সালাম হলেন ‘আহলে বাইয়েত’ এবং ইনারাই হলেন সমস্ত সৃষ্টির মূল নিয়ামক। মাদারেজুন নবুয়ত কিতাবের ৩য় খন্ডের ১১৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, হাবিবেপাক মোহাম্মদ রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, আহলে বাইয়েতের পরিচয় লাভ করা হলো দোযখ হতে নাজাতের উছিলা।” সুতরাং সেই চিরন্তনÑশাশ্বতকালের আহলে বাইয়েতের পরিচয়টি কতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তা কি ভাবনার বিষয় নয় ?

আরো একটি রেওয়ায়েতে রয়েছে যে, যখন আদম আলাইহিস্ সালামের বৃদ্ধাঙ্গুলে নূর নবীর সুরত মোবারক দেখলেন, তাতে ভক্তিভাবে তিনি উভয় বৃদ্ধাঙ্গুলীতে চুম্বন করলেন। তারপর হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহ, আরো কোনো নূর রয়েছে কি-না ? আল্লাহপাক তখন শাহাদাত আঙ্গুলে আলী, বাকি তিন আঙ্গুলে হযরত ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন এর সুরত স্থাপন করে আদম আলাইহিস্ সালামকে দেখালেন।

একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের খেদমতে আরজ করলেন, “ইয়া রাছুলুল্লাহ, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম যখন জান্নাতে ছিলেন, তখন আপনি কোথায় ছিলেন ? হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম মুচকি হাসি দিয়ে বললেন – আদমের ঔরশে। তারপর হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম তাঁর ঔরশে আমাকে ধারণ করে নৌকায় আরোহণ করেছিলেন। তারপর হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালামের পৃষ্ঠদেশে। তারপর পবিত্র (মুমিন) পিতা-মাতাগণের মাধ্যমে আমি পৃথিবীতে আগমন করি। আমার পূর্ব-পুরুষগণের কেহই চরিত্রহীন ছিলেন না [তাওয়ারিখে মোহাম্মদী, আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া]।

ইবনে সা’দ কালবী থেকে, তিনি আবু ছালেহ থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম এরশাদ করছেন, আরববাসীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ‘মুযার’। মুযারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ‘আবদে মানাফ’। আবদে মানাফের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে ‘বনু হাশেম’ এবং তার মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে আবদুল মুত্তালিবের সন্তান-সন্ততি। আল্লাহপাক আদম থেকে বংশ বিভক্ত করেছেন, আমাকে তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখায় রেখেছেন [খাসায়েসুল কুবরা, ১ম খন্ড- ৭৩ পৃষ্ঠা]। এ সর্বশ্রেষ্ঠ শাখাটিই হলো ‘হাসেমী গোত্র’, যে হাসেমী গোত্রের মধ্যে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহিস ওয়াচ্ছাল্লাম এবং হযরত মাওলা আলী আলাইহিস্ সালামের জন্ম।

ইবনে আবি ওমর আদনী হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, আদম সৃষ্টির দু’হাজার বৎসর পূর্বে ‘কোরাইশ’ আল্লাহপাকের সামনে একটি নূরের আকারে ছিল। এ নূর যখন তাসবীহ পাঠ করতো, তখন ফেরেশতারাও সঙ্গে তাসবীহ পাঠ করতো। আল্লাহপাক আদমকে সৃষ্টি করে এ নূর তাঁর ঔরশে রেখে দিলেন। রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলেন, এরপর আল্লাহ আমাকে আদমের ঔরশে পৃথিবীতে নামালেন। এরপর নূহ নবীর ঔরশে স্থানান্তরিত করলেন এবং তারপরে ইব্রাহীমের পৃষ্ঠদেশে। এমনিভাবে আল্লাহপাক আমাকে সম্মানিত বান্দার ঔরশে এবং পবিত্রাত্মা নারীদের গর্ভে স্থানান্তর করতে থাকেন। অবশেষে আমার পিতা-মাতা আমাকে জন্ম দেন। আমার পিতৃপুরুষের মধ্যে কেউই ব্যভিচারের ভিত্তিতে সঙ্গম করেনি [মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, খাসায়েসুল কুবরা, প্রথম খন্ড- ৭৫ পৃষ্ঠা]।

আবু নুয়াঈম তার ‘তাহ্কীকুল মাকামে আলা কেফায়াতিল আওয়াম’ কিতাবে বলেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, “আল্লাহপাক স্থানান্তরিত করতে থাকলেন আমার নূরকে। এটা ঐ নূর যে নূর আদম আলাইহিস্ সালাম আরশ মোয়াল্লার পর্দাসমূহে দেখেছিলেন।

‘মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়াতে’ বর্ণিত আছে, “যখন আল্লাহর ক্বাদর অনুসারে আদম ও হাওয়া মিলন ঘটলো আরাফাতে, তখন আল্লাহ আদমের প্রতি বেহেশত হতে একটি নহর পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এ নহরে গোসল করলেন এবং হওয়ার সাথে মিলিত হলেন। ফলে ঐ নূরগুলো তাঁর প্রতি স্থানান্তরিত হলো। অনন্তর নূর-ই-মোহাম্মদীর স্থানান্তরিত হতে থাকলো এক পৃষ্ঠদেশ হতে আরেক পৃষ্ঠদেশে এবং এক উদর হতে অপর উদরে আসতে আসতে তা স্থানান্তরিত হলো হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালামের পৃষ্ঠদেশে।

হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম তাঁর পুত্র শীশকে উপদেশ দিলেন, যেন আল্লাহকে স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে মোহাম্মদকেও স্মরণ করা হয়। কারণ, বেহেশতের প্রতি জায়গায়, ফেরেশতাগণের পেশানীতে ও হুরদের চক্ষুতে ঐ নাম অঙ্কিত আছে এবং ফেরশেতাগণ প্রতি নিঃশ্বাসে জিকির করে মোহাম্মদ নামের উপর।
হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম একবার প্রার্থণা করলেন, হে আমার রব! আমার সন্তানদের মধ্যে যে সকল পয়গাম্বর আগমন করবেন, তাদের সকলের চিত্র বা ছবি আমাকে দেখানো হোক। তখন আল্লাহপাক সমস্ত পয়গাম্বরদের ছবি নাযিল করেন। হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের ভান্ডারের সে ছবিগুলো সূর্যাস্তলে রক্ষিত ছিল। সেখান থেকে বাদশাহ যুলকারনাইন এ ছবিগুলো বের করে নিয়ে হযরত দানিয়েল আলাইহিস্ সালামের নিকট সমর্পণ করলেন (খাসায়েসুল কুবরা-১ম খন্ড)।

বায়হাকী ও আবু নায়ীমের রেওয়ায়েতে হিশাম ইবনে আস বলেন, হযরত আবু বকরের আমলে জনৈক কোরাইশীকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট ইসলামের দাওয়াতের জন্য প্রেরণ করেন। সম্রাটের নিকট যাবার পর তিনি অনেক বিষয়েই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং সব প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিলেন। সেখানে তিন দিন তারা অবস্থান করলেন এবং বাদশাহ তাদের জন্য পানাহার ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা করলেন। বাদশাহ রাতে লোক পাঠিয়ে তাদেরকে নিয়ে আবার পূর্বোক্ত প্রশ্নোত্তরগুলো শুনলেন। অতঃপর সম্রাট একটি স্বর্ণখচিত সিন্দুক আনলেন। তাতে কয়েকটি ছক ছিল এবং প্রত্যেক ছকের পৃথক দ্বার ছিল। তিনি একটি ছক খুলে তা থেকে কালো রেশমী বস্ত্র বের করে ছড়িয়ে দিলেন। তাতে একটি হস্তাঙ্কিত ছবি ছিল। ছবিতে নেত্রদ্বয় ও কর্ণদ্বয় বড় বড় ছিল এবং গ্রীবা দীর্ঘ ছিল। মুখে কোনো দাড়ি ছিল না এবং মস্তকে প্রচুর চুল ছিল। সব মিলিয়ে সেটি ছিল এক সুশ্রী পুরুষের ছবি। সম্রাট তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তারা তাকে চিনে কি না। তারা বললো, না। সম্রাট বললো, ইনি হলেন হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম। এভাবে সম্রাট দ্বিতীয় ছক খুলে একটি শুভ্র চিত্র বের করলেন। তাঁর চুলগুলো কোঁকড়ানো, নেত্রদ্বয় লোহিত বর্ণ, মস্তক বৃহৎ এবং দাড়ি সুশ্রী ছিল। সম্রাট বললেন, তিনি হলেন হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম। এরপর হাস্যরতো একটি ছবি বের করলেন। তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। তাঁর নেত্রদ্বয় সুন্দর, প্রশস্ত ললাট, উন্নত গন্ড ও সাদা দাড়ি ছিল। তারপর বের করলেন মুসা ও হারুন আলাইহিস্ সালামের ছবি, গায়ের রং গোধূম, কোঁকড়ানো ক্ষুদ্র কেশ এবং চক্ষু কোটরাগত ও তীক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন ছিল। পরে বের করলেন হযরত লুত আলাইহিস্ সালামের ছবি। তাঁর কেশ ছিল লম্বা ঝুলন্ত এবং তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের লোক। পরে হযরত ইসহাক, ইয়াকুব, ইসমাঈল, ইউসুফ দাউদ, সোলাইমান এবং ঈসা আলাইহিস্ সালামের ছবি বের করে দেখালেন।

সবার শেষে একটি স্বর্ণখচিত ছক হতে শুভ্র ও সুন্দর ছবি বের করলেন। এ ছবি দেখে সাহাবাগণ সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেনো দাঁড়িয়ে গেলে ? সাহাবাগণ বললেন, এ ছবিটিই হলো আমাদের নবীজি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের (সংক্ষিপ্ত, খাসায়েসুল কুবরা, ২য় খন্ড- ১৯-২০ পৃষ্ঠা)।

আপন খবর