পত্রিকা – গোপন ও প্রকাশ্য শত্রু – ১ম পর্ব

ছালমা আক্তার চিশতী

জালাল উদ্দিন খাঁ বলছেন –          

“মানুষ থুইয়া খোদা ভজো
এ মন্ত্রণা কে দিয়েছে?
মানুষ ভজো, কোরান খুঁজো
পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।”

এই কথার ভেদ-রহস্য রয়েছে। কারণ, ভেদ উন্মোচন করার মাঝেই রয়েছে কোরানের মূল মর্ম। আধ্যাত্মিক ভেদ-রহস্য যারা জানে তারা আলিফ, লাম, মীম আসলে কি তা তারা বুঝে। আলিফ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে, লাম দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে আর মিম দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে তা জানাই হলো কোরানের মূল ভেদ জানা। আলিফ এর ভেদ না জানা থাকলে নিজ অস্তিত্বের মাঝে খোদা রয়েছে তা জানা হবে না। কারণ, একজন মানুষ জীবিত থাকে এই আলিফের দ্বারা। লাম দ্বারা এই দেহ-ঘর নূরে নূরান্বিত হয়। আর মিম হলো মূল অস্তিত্বের প্রকাশ ও বিকাশ। কোরানের সাথে একজন মানুষ এক সুতায় বাধা কারণ, কোরানের ভেদ বিষয় জানার একটাই পথ তা হলো একজন কামেল মানুষ। একজন চেতন মানুষ হলো কোরানের মূল ভেদ। কোরানের মূল ভেদ সম্পর্কে জানতে হলে আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশ্তী নিজামীর লেখা ‘আসরারুল কোরান’ বইটি পড়লে জানতে পারবে।

বায়াত হয়ে একজন মানুষ যখন নিজ সম্পর্কে চেতন থাকে সর্বাবস্থায় তাঁর জবানেই কোরানের বাণী প্রকাশ পায়। এই অবস্থাটি তৈরি করতে হলে পরিপূর্ণ ঈমান নিয়ে নিজ সম্পর্কে চেতন থাকতে হবে। নিজ সম্পর্কে গাফেল হওয়া মানে নিজ অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা। তাই নিজ সম্পর্কে যথার্থ চেতন থাকা মানেই ঈমানের দৃঢ়তা অর্জন করা। একজন মানুষ পারে সব কিছুকে জয় করতে। তাই বলা যায় ঈমানদার অর্থাৎ ঈমানি শক্তি অর্জন করতে হলে মনকে অনুরাগের বাহনে বসাতে হবে।

জালালউদ্দিন রুমি (রাঃ) বলছেন – ‘কম্বল কে পিটানো হয় কম্বলের বিরুদ্ধে নয়, ধুলোর বিরুদ্ধে।’ ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে হায়ানি আত্মাকে পরিশুদ্ধ অর্থাৎ পরিবর্তন করে। যেমন একটি কাপড়ের মাঝে যদি দাগ না থাকে তবে আর তা পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই, যতক্ষণ দাগ থাকে ততক্ষণই দাগ উঠানোর চিন্তা থাকে তাই ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দীলে যাতে দাগ না লাগে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তবেই গুরুর কৃপায় আখেরে মুক্তি লাভ হবে। আদম অজুদের মাঝে নূর এবং জুলমাত দুইটি গুণ থাকে। যারা এই আদম অজুদে অন্তরাত্মার জুলমাতি গুণগুলোকে কাটিয়ে নূরে নূরান্বিত করেছেন, তারা দীলে সানুয়ারীকে পরিশুদ্ধ করেছেন। কারণ, একটি মানুষ যখন জন্ম নেয় তখন তার দীলের মাঝে ময়লা থাকে না। একটি নবজাতক শিশু হলো পবিত্র। একটি শিশুর আগে পিছে কোন পাপ থাকে না। যখন সে বড় হতে শুরু করল তখন তার মাঝে হায়ানী আত্মার গুণের জাগরণ শুরু করল। তখনই শিশুটির সৌন্দর্য্য হারিয়ে গেল কাল-বৈশাখী ঝড়ের ন্যায়। যখন কাল-বৈশাখী ঝড় আসে মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হলে অনেক দুঃসাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। দেখা যায় একজন মানুষের একটি মাত্র সম্বল তার নিজ বাড়ি তা এই ঝড়ের কবলে পরে ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন সেই মানুষটি কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে ? সে তার বাড়ি তৈরি করার কাজে আবার লেগে যাবে। তেমনি একজন মানুষ হায়ানী আত্মার ঝড়ে পরে তার নিজ বাড়ি/দেহ ইনসানী আত্মাকে হারিয়ে নিজ বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে আছে। কারণ, হায়ানী আত্মা কাটাতে না পারলে নিজ বাড়িতে আর থাকা হবে না। সেই বাড়িটি পরিবর্তিত হয়ে কুকুর, শুকর, বাঘ, সিংহ ইত্যাদির ঘর হয়ে যেতে পারে। সেই বাড়ি যদি ফিরে পেতে হয় তবে এই  ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া বাড়িটিকে মেরামত করতে হবে। এই করাটার নামই হলো চেতন থাকা। কারণ, এই মায়ার জনমের মাঝে চেতন কয়জন থাকতে পারে? বারে বারে অচেতনতা এসে মানুষকে ঘিরে রাখে। মানুষ এই জগতের মোহ ত্যাগ করার জন্য কতইনা চেষ্টা করে থাকে।

মানুষ হলো আধ্যাত্মিক জীব। এই বিষয়টা শুধু আধ্যাত্মিক একজন মানবই বুঝতে পারে। সে হলো অন্তর্দৃষ্টিওয়ালা। যারা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী, তাঁরা নিজ সম্পর্কে সর্বদাই চেতন থাকে, তাঁরা জানে কিসে একজন মানুষকে গাফেল করে রাখে। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রাঃ) বলছেন ‘ধ্যান ও ইবাদত বন্দেগীর তরবারি দিয়ে যিনি যাবতীয় কামনা-বাসনা কেটে ফেলেছেন, তিনিই খাঁটি আরেফ।’ মানব জনমটা সুন্দর করতে হলে আধ্যাত্মিক ভাব নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। ঈমানের সাথে এই বিষয়গুলোর সম্পর্ক বিদ্যমান। ঈমানের বলেই মুর্শিদের সুঘ্রান প্রাপ্ত হতে হয়। কারণ, ঈমানদার মুর্শিদের সুঘ্রাণের মোজেজা বুঝে। সেই ভক্তের জ্যোতির্ময়ী সত্তা হতে জগত ব্যাপি তার আলোক-রশ্মি ছড়িয়ে পরে। যদি ঈমানের অপূর্ণতা থাকে তবে আর আত্মার উন্নতি ঘটবে না। ঈমানটা হেফাজত করার জন্যই মানুষের জীবনে সাধনা করতে হয়। নূরে ঈমানের মধ্যেই খোদার রূপ দরশন হবে। এই সাধনার দরজায় সিদ্ধি লাভ করতে হলে নির্জনতাকে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হয়। যখন একজন মানুষ তার নিজ সত্তাকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টায় রত হয় তখন তার একাকি বা নির্জন হয়ে বসতে হবে। কারণ, আল্লাহর ধ্যান নির্জনতা ব্যতিত হয় না।

এই দিকে লক্ষ্য করে মহর্ষি মনমোহন দত্ত বলছেন –

“নির্জনে থাকিলে হয় ঈশ্বরত্ব বোধ,
নির্জনে সাধন করো পাইবে প্রবোধ”

মানব অজুদটাই হলো নূরের ভান্ডার। এই ভান্ডার থেকে যার নূরের জ্যোতি বিকশিত হয়েছে, তার আচার-আচরণ দ্বারাই তা বুঝা যাবে। যেমন – একটি পোকা মানুষকে কামড় দিতে পারে। কিন্তু পোকাটিকে মানুষ কামড় দিতে পারে না, ইহা তার কাজ নয়। তেমনি ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কতইনা প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করতে হয়। এমনও হতে পারে মুর্শিদই ঈমান ভাঙ্গার জন্য অনেক কর্ম করতে পারে। যেমন করেছিল হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রাঃ)। এই সমস্ত বিষয়গুলো বুঝে নিতে পারলে ঈমান প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। কারণ, মুর্শিদের সকল কর্মের মাঝেই ভেদ লুকানো রয়েছে। ভাল মন্দ এক করতে না পারলে ঈমান প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ভাল হলে একজন মুরিদের মন ভাল থাকবে আর মন্দ হলে খারাপ হয়ে যাবে। তবে আর ঐ ভেজাল/খান্নাছযুক্ত বা আমিত্বময় হৃদয় দ্বারা ঈমান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যেমন – কাপড় ছিড়ে গেলে তা আর পুনরায় আগের মতো হয় না। ঠিক তরিকতের বিষয়টা আলাদা। নফসে আম্বারা মানুষের নফস মোৎমাইন্নাহ’কে ছিড়ে ফেললে তা পুনরায় ঠিক করা যায়, ঈমানের পূর্ণতার বলে।

এই মানব জনমটা টিকিয়ে রাখতে হলে মনকে কাদা-মাটির ন্যায় করে নিতে হবে। তা করে নেওয়াটার মাঝেই লুকিয়ে আছে ভক্তের সাধনা। এই সাধনা সম্পর্কে জানাটাও একটি জ্ঞান।  জ্ঞানী যারা তারা ছাই এর মাঝে মানিক খুঁজতে থাকে। কারণ, সৃষ্টির সর্ব কিছুতেই আল্লাহর সৃষ্টি-লীলার জ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে। আধ্যাত্মিক জ্ঞানীরা তা জানেন, তাই তারা হলো জ্ঞানপিয়াসী।  সাধারণ চিন্তাধারা দিয়ে খোদার ভেদ জানা যায় না। খোদের মাঝেই খোদার ভেদ গোপন রয়েছে। যারা খোদ সম্পর্কে চেতন তারা খোদার ভেদ জানতে পেরেছে। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাঃ) বলছেন – “গাফেল হৃদয়ে কিভাবে বন্ধুর দয়া ও ভালোবাসার আলো জ্বালবে, চেতন হৃদয় ব্যাতিত সে নূরের অবরোহন স্থল নেই।” আল্লাহ চেতন মানুষের মাঝে অবস্থান নিয়ে কথা বলে, দেখে, শুনে, হাটে চলে। নিজ সম্পর্কে চেতন হওয়া মানেই খোদার ভেদ রহস্য উন্মোচিত করা।

যার মান আরাফা হয়েছে সে এই ভেদ বুঝতে পারে। এই বুঝটা সাধারণ জ্ঞান দ্বারা বুঝা যাবে না। মানুষের জীবনে আল্লাহর দয়া রয়েছে। সেই দয়ার ফসলই হলো এই মানব ছুরত। কারণ, ভাগ্যের ফেরে মানব জনম না হয়ে পশুর জনমও হতে পারত। খোদার সাথে যারা অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখে তারাই পারে তার সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে। যেমন – কেউ যদি কানে না শোনে তার কাছে কোরান পড়া অথবা গালি গালাজ করা একই মনে হবে, ঠিক তেমনি হতে হয় একজন ঈমানদারের অবস্থান। কারণ, একজন প্রকৃত ঈমানদার সে তার নিজ অস্তিত্ববোধ রাখে না। নিজ সম্পর্কে বেখেয়ালী হলে অকাল মৃত্যু ঘটবে। একজন ভক্তের জন্য মুর্শিদ স্বয়ং হলো ঈমান অর্থাৎ ঈমানের ছুরত। গুরু ঈমান, গুরুর নিকট আনুগত্য/বায়াত যে গ্রহণ যারা করেছে তারা হলো ঈমানদার।

আমার মুর্শিদ হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশ্তী নিজামী (কুঃ ছেঃ আঃ) তাঁর গানের মাঝে বলছেন –

“নবীর ঈমানেতে মিলবে আমান
আগে ঈমান চিন আপনার,
বেনজীর কয় ঈমান আমার
মুর্শিদ সরোয়ার।”

খোদা যেই আমানত দিয়েছেন তার কতটুকু হেফাজত করা হয়েছে তা নির্ধারিত হয় নিজ সম্পর্কে চেতন বা অচেতন থাকার মাঝে। কারণ, আমানত চিনে হেফাজত করার মাঝে খোদার পরিচয়ও রয়েছে। নিজ অস্তিত্বের মাঝে খোদাকে ধারণ করা অর্থাৎ অন্ধকারের মাঝে আলো দেখা। তার অজুদ হবে জ্যোতির্ময়ী। নিজেকে হেফাজত করাটাই হলো মানুষের মূল কর্ম। যেমন, কার কাছে কোন জিনিস হেফাজত রাখা হলে তা কিভাবে সুরক্ষিত থাকবে তা খেয়াল রাখতে হয়। যদি বেখেয়ালি হয়ে যায় তবে আর জিনিস হেফাজত করা হবে না। তেমনি ঈমানকে হেফাজত করতে হলে মূল বস্তুর (খোদার জাতের) দিকে খেয়াল রাখতে হবে তবেই মূল গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।

মূল বস্তুটি হলো ইনসানিয়াত। ইনসাফ শক্তি যার মাঝে বিরাজিত রয়েছে সেই ব্যক্তি হলো ইনসান, রুহে ইনসানীর অধিকারী। ইনসানিয়াতের সাথেই আল্লাহর সর্ব বিষয় জড়িত আছে। যারা দিব্যদৃষ্টির অধিকারী, তারা ঈমানকে সচল রাখার জন্য সর্ব সময় খেয়াল রাখে। আমাদের সমাজের মাঝে দেখা যায় বৃহৎ একদল লোক ঈমান না এনেই ঈমানের দাবী করে চলছে, পিতৃ ধর্মের অনুসারী ; সংখ্যায় ৭২ কাতার। আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে ঈমান আনতে হয়, আর তা হলো একজন গুরুর নিকট বায়াত গ্রহণ করা (সুরা ইউসুফ-১০০, সুরা ফাত্তাহ-১০)। মানব গুরুর মাধ্যমে আল্লাহর নিকটই বায়াত গ্রহন করা হচ্ছে, আল্লাহ নিজেই তা স্বীকার করেছেন (সুরা ফাত্তাহ-১০)। কাজেই যারা বায়াত ভঙ্গ করছে তারা আল্লাহর নিকট হতেই ঈমান ত্যাগ করেছে বিধায় তারা আর মুসলমান থাকছে না। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, আবু জাহেল, আবু লাহাব বা নমরুদ, ফেরাউন যুগে যুগেই বর্তমান। 

ঈমান ত্যাগ করা ব্যক্তি, তারা ঈমানদারদের ঈমান ভাঙ্গার জন্য বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে।

আপন খবর