হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
মহান জাতপাক আল্লাহ কোরানুল করিমের সুরা ইউনুসের ৬২ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আলা ইন্না আউলিয়াআল্লাহে লাখাওফুন্ আলাইহিম ওয়ালা হুম্ ইয়াহ জানুনা” অর্থাৎ সাবধান! নিশ্চয় আল্লাহর আউলিয়াগণের (বন্ধুদের) কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা কখনো চিন্তিতও হবেন না।
সুরা বাকারা ১৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে “ওয়ালা তাকুলু লিমাই-ইউকতালূ ফী সাবিলিল্লাহে আমওয়াতুন বাল আহইয়াউন ওয়ালাকিন লা তাসউরূনা” অর্থাৎ এবং তাদেরকে মৃত বলিও না, যারা আল্লাহর রাস্তার (সাধনায়) মধ্যে কতল হয়েছেন, বরং তাঁরা জীবিত, এবং তোমরা উহা জানতে পার না (অনুধাবন করতে পার না)।
একথা উহুদের যুদ্ধে শহীদানদের মাজারে গিয়ে কাফেরগণ বলতো, তোমরা মুহাম্মদের কথায় যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছ, দুনিয়ার সুখ ভোগ করতে পারনি। দেখ আমরা এখনো জীবিত আছি দুনিয়ার সুখ আমরা ভোগ করছি। আল্লাহপাক কাফেরদের এ কথার মোকাবেলায় উক্ত আয়াত নাজিল করে বলেছেন – না তাঁরা মৃত নয়, বরং জীবিত, যদিও তোমরা বুঝতে পার না বা জানতে পার না। রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামও বলছেন, “আউলিয়া আল্লাহে লা ইয়ামুতুন বালইয়ান তাকিলু মিন দারুল ফানা ইলা দারুল বাকা” অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের মৃত্যু নেই বরং তারা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহলোক হতে স্থায়ী পরলোকে। কাজেই আল্লাহর অলিগণ হলেন লামউতের অধিকারী তথা চিরঞ্জীব জগতের বাসিন্দা।
জামাদাত, নাবাদাত ও হায়ানাত- এ তিন জামাতের উর্দ্ধে তাদের অবস্থান, যেখানে ইনছানিয়াতের জগত। অন্যান্য সাধারণ মানুষ স্তর বিশেষে সিরাতে হায়ানাত, নাবাদাত ও জামাদাত শ্রেনীভূক্ত তথা আঠার হাজার মাখলুকাতভূক্ত হয়ে অবস্থান করে। রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, “মুতু কাবলা আনতা মাউত” অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করো তথা হায়ানাত, নাবাদাত ও জামাদাতের গুণ-খাছিয়ত পরিহার করে ইনছানের গুণ-খাছিয়ত তথা ইনছানিয়াত অর্জন করে লামউতে স্থিত হও তথা চিরঞ্জীব হয়ে যাও। এ পথে ধাবিত হওয়ার রাস্তা হলো নফসে আম্মারার গুণ-খাছিয়ত পরিশুদ্ধ করে ছালাত কায়েম করা। এই লামউতের অধিকারীগণই হলো নবুয়তে নবী-রাছুল আর বেলায়েতে তাদেরকে বলা হয় কামেল মুর্শিদ বা অলি-আউলিয়া। তাদের সাথে থাকার জন্য আল্লাহপাক হুকুম করেছেন আমানুগণকে তথা নতুন ঈমানওয়ালা বা ভক্তগণকে।
মুমিনদের উপর আল্লাহর কোনো হুকুম নেই। কারণ, তারা দায়েমী ছালাতে উপর স্থিত আছে। কোরানে তাই বলা হয়েছে, “ইয়া আয়্যুহালল্লাযিনা আমানুত্তাকুল্লাহা ওয়াকুনু মা’আছ ছাদেকীনা” অর্থাৎ হে আমানুগণ তথা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের বা অলিদের সঙ্গে থাক। সুরা বাকারাতে আরো বলা হয়েছে, “ওয়ালা তাহ্তাসাবান্নাল্লাযিনা ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াতুন” র্অথাৎ তাদেরকে মৃত বলে ধারণাও করো না, যারা আল্লাহর রাস্তায় কতল হয়েছে। কাজেই আল্লাহর অলিগণ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের কোনো ক্ষমতা নেই ইত্যাদি যারা বলে তারা অবশই আল্লাহ ও তাঁর রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকে এবং তারা স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত আছে। নবী-রাছুল অলি-আউলিয়াগণ তাদের জেসমানী অজুদ ছেড়ে মালাকী অজুদ ধারণ করে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সর্বত্রই গমনাগমন করতে পারেন জীবিত বা ইন্তেকালের পর উভয় অবস্থায়ই। শত শত প্রমাণ রয়েছে কিতাবাদিতে বা বাস্তবেও।
ইন্তেকালের (কালান্তর বা স্থান পরিবর্তন) পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মৃত দেহের অবস্থান স্থলকে আরবীতে কবর বলা হয়। শুধু কবরে শায়িত ব্যক্তির মর্যাদার পার্থক্যের কারণে পুনরুত্থানের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সে মোতাবেক নবী-রাছুলদের এবং অলি-আউলিয়া তথা পীর-মুর্শিদের কবরকে বলা হয় রঁওযা আর ফার্সি ভাষায় বলা হয় মাজার বা দরগাহ এবং সাধারণ মানুষের মৃতদেহের অবস্থান স্থলকে কবর বলা হয়। রঁওযা মানে বেহেশতের বাগান। মাজার স্থানগত বিশেষ্য শব্দ। ধাতুগত অর্থ দর্শনার্থে গমন করা। সাধারণতঃ অলি-আউলিয়াগণের সমাধিস্থলকে মাজার বলা হয়, রঁওযাও বলা হয়। “তাফসিরে কানজুল ঈমান ও খাজাইনুল এরফানে” সুরা কাহাফের ২১ নম্বর আয়াতের টিকার মাসআলা বর্ণিত আছে, “মাজার হতে বরকত লাভ করা জায়েজ” এবং এ কথা ফতোয়ায়ে আলমগিরীর ২য় খন্ডে-র ৫৫১ পৃষ্ঠায়ও বিধৃত আছে। হযরত আল্লামা আলহাজ্ব মোঃ আজিজুল হক আল কাদেরী আস-সাঈদী সাহেব তাঁর রচিত “আস সায়েক্বাহ” কিতাবে বলেছেন, “মাজার করাটা হচ্ছে একটি উত্তম ও জায়েজ কাজ। বুযুর্গদের মাজারকে সর্বসাধারণের জিয়ারতের সুবিধার জন্য তার উপর ঘর তৈরী করা উত্তম ও জায়েজ এবং সুন্নতে সাহাবা”।
রঁওযা ও মাজারের উপর ঘর বা গম্বুজ করার নিয়ম-নীতি প্রত্যেক নবী- রাছুলগণের যুগ হতে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম পর্যন্ত এবং তারপর আল্লাহর সমস্ত অলিদের মধ্যেই তা প্রচলিত আছে। যেমন, রোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “এরশাদুস সারীর” মধ্যে উল্লেখ আছে যে, আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের পূর্বে যতো নবী রাছুল ছিলো তাদের সকল রঁওযা সমূহ পাকা করে তাঁর উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দিতেন যাহা দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পরও পূর্ব স্মৃতিগুলো ঝকঝক করতো। প্রমাণস্বরূপ আজো পূর্বেকার নবী-রাছূলদের রঁওযা যেমন, হযরত বাগদাদ শরীফ হতে ৪৩০ কিঃ মিঃ উত্তরে মওসুল শহরের দজলা নদীর দক্ষিণ পার্শ্বে এক পাহাড়ের চূড়ায় হযরত ইউনুছ আলায়হিস সালামের মাজার শরীফ, যেখানে যেতে ১৫৭টি ধাপ অতিক্রম করে যেতে হয়, ইরাকে হযরত জোনাইদ বোগদাদী রাহমাতুল্লাহি তা’য়ালা আলায়হির মাজারের উত্তর পাশে নবী হযরত ইউশা ইবনে নুন আলায়হিস সালামের মাজার, মওসুল শহরে নবী হযরত ইউনুছ আলায়হিস সালামের মাজার হতে ২ কিঃ মিঃ উত্তরে রয়েছে হযরত শীষ আলায়হিস সালামের মাজার, হযরত শীষ আলায়হিস সালামের মাজার হতে দেড় কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিমে মওসুল শহরে হযরত জরজীজ আলায়হিস সালামের মাজার বিদ্যমান, তিনি তৎকালীন শাম দেশের দা-দিয়ানা বাদশাহ্’র জামানার পয়গাম্বর ছিলেন।
ইরাকের মওসুল শহরের হযরত জরজীজ আলায়হিস সালামের মাজারের ৪/৫ শত গজ উত্তর-পশ্চিমে হযরত দানিয়েল নবী আলায়হিস সালামের মাজার রয়েছে, জর্ডানে আম্মান শহরের অনতিদূরে এক পাহাড়ের চূড়ায় নবী হযরত শোয়াইব আলায়হিস সালামের মাজার শরীফ রয়েছে, সিরিয়ার দামেস্কে হযরত ইয়াহ্ইয়া নবী আলায়হিস সালামের মাজার শরীফ বিদ্যমান আছে, বায়তুল মোক্বাদ্দাসের সীমানার বাইরে কিছুটা পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড়ের উপর হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের মাজার রয়েছে, হযরত দাউদ আলায়হিস সালামের মাজার শরীফটি বারো হাত লম্বা, বায়তুল মোক্বাদ্দাস হতে ১০/১৫ কিঃ মিঃ দক্ষিণে গিয়ে প্রধান সড়কের প্রায় ২/৩ কিঃ মিঃ পশ্চিমে হযরত মুসা আলায়হিস সালামের মাজার বিদ্যমান, তাঁর মাজার শরীফ এগারো হাত লম্বা, বায়তুল মোক্বাদ্দাস হতে ৫০ কিঃ মিঃ দক্ষিণে হেবরণ শহরে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম, হযরত ইসহাক আলায়হিস সালাম, হযরত ইউসুফ আলায়হিস সালাম, হযরত সারা আলায়হিমাস সালামসহ কয়েকশ নবীর মাজার শরীফ রয়েছে, ফিলিস্তিনের “আল খলীল” শহর থেকে ৬ মাইল দূরবর্তী লূত উপসাগরের কূলে হযরত লুত আলায়হিস সালামের মাজার শরীফ বিদ্যমান আছে, শেরে খোদা, আমিরুল মুমিনীন, মহানবীর আহলে বাইয়্যেতের প্রধান হযরত আলী ইবনে আবি তালিব আলায়হিস সালাম এবং নবী হযরত নূহ আলায়হিস সালামের মাজার ইরাকের নজফ শহরে বিদ্যমান আছে, কারবালার ময়দান হতে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত নজফ শহরের প্রায় ৯/১০ মাইল এলাকাব্যাপী বিস্তৃত এক কবরস্থানের পশ্চিম পাশে প্রসিদ্ধ নবী হযরত ছালেহ আলায়হিস সালাম এবং হযরত হুদ আলায়হিস্ সালামের মাজার শরীফ রয়েছে, তারা যথাক্রমে সামুদ এবং আদ্ গোত্রের মাঝে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালামের রঁওযা অদ্যাবধি নিজ নিজ স্থানে বিদ্যমান আছে।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু যখন বায়তুল মুক্কাদ্দাস বিজয় করেন তখন বায়তুল খলিলের মধ্যে উক্ত স্মৃতিগুলো বিদ্যমান ছিলো এবং তিনি বড় আবেগের সাথে রঁওযাগুলো জিয়ারত করেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু সেখান থেকে ফিরে এসে রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা, আলে রাছুল ও সাহাবাগণের মাজার বা রঁওযাগুলো পাঁকা করেছিলেন। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম পশ্চিম দিকে মাথা মোবারক এবং পূর্ব দিকে পা মোবারক দিয়ে শায়িত আছেন। কারণ, এখান থেকে দক্ষিণ দিকেই কাবা শরীফ অবস্থিত আছে। তখন থেকে ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের রাজত্বকাল পর্যন্ত রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা ঐ ভাবেই বিদ্যমান ছিলো। এরপর খলিফা ওয়ালিদের নির্দেশে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু একে ভেঙ্গে চিত্রাঙ্কিত পাথর দ্বারা পুনঃ নির্মাণ করেন। আর এর বাহিরে অপর একটি দালান তৈরী করেন।
৫৫০ হিজরীতে জামালউদ্দীন ইস্পাহানী নামক এক মহান ব্যক্তি যার দান খয়রাতের কথা মদিনা শরীফের দিক-দিগন্তে মুখরিত ছিলো, তিনি রঁওযা শরীফের চারিপাশে চন্দন কাঠের একখানা জালি তৈরী করেছিলেন। এ সময় মিশরের উজির ইবনে আবিল হাইজার শরীফ সাদা ‘দীবা’ বা একপ্রকার সূক্ষ্ম রেশমী কাপড়ের তৈরী গিলাফ পাঠান, যার মধ্যে লাল রেশমী ফুল অংকিত ছিলো এবং তাঁর উপর সুরা ইয়াছীন লেখা ছিলো। খলিফা মুস্তাজী বিল্লাহর নির্দেশে তিনি এই গিলাফ রঁওযা শরীফের উপর পড়িয়ে দিয়েছিলেন। ৬৭৮ হিজরীতে ‘কলাউল ছালেহী’ রঁওযা শরীফের উপর সবুজ গম্ভুজ যা মসজিদের ছাদ থেকেও বেশি উঁচু, তামার জালি সহ নির্মাণ করেন। এরপূর্বে ছাদ হতে দু’হাতের বেশি উচু ছিলো না। এরপরে শাহ্ ফয়সল এবং বাদশাহ ফাহাদের আমলে এক বিরাট কর্মসূচীর মাধ্যমে হেরামাইন শরীফাইন সংস্কার করা হয়, যা বর্তমানে বিদ্যমান আছে। এ বিষয়ে ‘জজবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ কিতাবে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
মদীনা শহর, তার গম্বুজ ও মিনার দৃষ্টিগোচর হলে তাজিমের জন্য সওয়ারী হতে নেমে পড়বে। সম্ভব হলে মসজিদে নব্বী পায়ে হেটে যাবে। হাদিসে বর্ণিত আছে, আবুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দল মদীনায় পৌঁছে যখন রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামকে দূর থেকে দেখতে পায়, তখন উট বসানোর পূর্বেই তারা উটের পিঠ হতে লাফিয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
চার মযহাবের ইমামগণের মতে নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম এর রঁওযা মোবারকের পবিত্র স্থানটি, যে স্থানটি হুজুর সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের পবিত্র শরীরের সাথে সংযুক্ত, তা সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি বায়তুল্লাহ, বায়তুল মামুর, আরশ-কুরশী, লওহ, কলম হতেও পবিত্রতম। নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের শান, মান-মর্যাদার জন্যই তাঁর রঁওযা মোবারকের এ মর্যাদা এবং তিনি কাবারও কাবা।