হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
কোরানুল করিমের সূরা কাহাফের ২১ নম্বর আয়াতের শেষাংশ হলো, “কালাল্লাজীনা গালাবু আলা আমরেহীম লানাত্তা খেজান্না আলাইহীম্ মাসজেদান্” অর্থাৎ তাদের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এ বিষয়ে বললো, তাদের গুহার মধ্যে অবশ্যই আমরা একখানা মসজিদ তৈরী করবো। এ আয়াতের টিকার মাসআলায় ‘কানজুল ঈমান’ ও ‘খাজাইনুল এরফান’ তাফসীরের ২য় খন্ডে ৫৩৯ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, মাজার ও মাজারের পাশে মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ এবং মাজার জিয়ারত সুন্নত। রঁওযা বা মাজারে অবস্থিত ব্যক্তিকে একমাত্র উপাস্য জেনে জিয়ারত করা হারাম। রঁওযা বা মাজার জিয়ারত করা মানে নিজেকে রঁওযা বা মাজারে পরিণত করার শিক্ষা গ্রহণ করা।
হায়ানীয়াত দূর হলেই ইনছানিয়াতের জাগরণ ঘটে, আর তখনই ঐ মানুষটি মাজার (জিয়ারতের স্থান) বা রঁওযায় পরিণত হয়ে যায়। একজন রাছুল-আউলিয়ার মাজার বা রঁওযা (যেখানে সমাধি) জিয়ারত হতে এ শিক্ষাই নিতে হবে এবং তাঁর নিকট দোয়া প্রার্থী হতে হবে। দোয়া করতে হবে “হে আল্লাহ ! আমার কবরকে রাছুলের রঁওযার নিকটবর্তী করে দাও”। যারা নিজেকে মাজার বা রঁওযায় পরিণত করার শিক্ষা নেয় না, তারা করছে কবর পূজা। যা পূর্ববর্তী নবীগণের অনেক উম্মতগণ করেছিলো বিধায় নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, “তোমরা পূর্ববর্তীদের ন্যায় আমার কবরকে পূজা করিও না”। কিন্তু জিয়ারত নিষেধ নয়। যেমন হাজি সাহেবেরা এবং যাদের সামর্থ আছে তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক জিয়ারত করে থাকে। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, “আমার রঁওযাকে ঈদ বানিয়ো না”- এ হাদিস সর্ম্পকে হাফেজ ইবনে মুনযের বলেন, সম্ভবত; হাদিসের উদ্দেশ্য অধিক পরিমাণে জিয়ারতে উদ্বৃদ্ধ করা অর্থাৎ আমার কবর জিয়ারতকে ঈদের মতো বানিয়ো না, মানে বছরে একবার দু’বারের বেশী জিয়ারত করতে আসবে না, অধিক পরিমানে জিয়ারতে আসবে।
রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের রঁওযা মোবারক জিয়ারত করা ওয়াজিব এবং সে উদ্দেশ্যে সফর করাও ওয়াজিব। এ জিয়ারতের জন্য হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের শাফায়াত অবধারিত বলে সহীহ হাদিসে বিধৃত আছে। ইমাম তকিউদ্দীন সুবকী (৭২৭ হিজরী) তাঁর লিখিত ‘সিফাউল সিকাম’ কিতাবের সূত্রে অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা আঃ জলিল সাহেবের লিখিত ‘আহকামুল মাজার’ কিতাবের ৩৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, শুধু রওযা শরীফের উদ্দেশ্যেই সফর করা এবং জিয়ারত করা উত্তম ইবাদত এবং নৈকট্য লাভের উত্তম পন্থা (মূল কিতাবের ৪৩ পৃষ্ঠা)। যদি রঁওযা জিয়ারতের মাধ্যমে নিজের হায়ানী আত্মা বা নফস আম্মারার ফেল ত্যাগ করে ইনছানিয়াতে স্থিত হতে পারে তবেই হবে উত্তম ইবাদত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ। রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, “যে ব্যক্তি কেবল আমার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার রঁওযা শরীফে আসবে এবং আগমনের মধ্যে আমার জিয়ারতই তাকে উদ্বুদ্ধ করবে, তাহলে পরকালে তার জন্য শাফায়াতকারী হওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়বে”(তিবরানীর মো’জামে কবির এবং দারকুতনীর আমালী গ্রন্থ)। জানা দরকার, ইহকাল এবং পরকাল এক সাথেই আছে। ইহকাল ত্যাগ করলেই পরকাল প্রাপ্ত হওয়া যায়। শাফায়াত হবে পরকালে অর্থাৎ চৈতন্যের জগতে। এখানেই মুক্তির জগত। এই বিষয়ে রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম অনেক কথাই বলেছেন। যেমন –
১। “মান যারা কবরি, আজাবাত্ লাহু শাফায়াতি” অর্থাৎ রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম এরশাদ করছেন, যে ব্যক্তি আমার রঁওযা জিয়ারত করেছে, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজেব হয়ে গেছে।
এ হাদিসটি ‘দারে কুতনী’ এবং ‘বায়হাকী’ ও অন্যান্যগণ বর্ণনা করেছেন। ইমাম সুব্কী বলেছেন যে, এ হাদিসটি ‘হাসানুন’-এর উচ্চ মর্যাদা পেয়ে ‘সহীহুন’ বা বিশুদ্ধতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
২। “মান যারা কব্রি, হালাত লাহু শাফাাতি” অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার রঁওযা জিয়ারত করলো, তার জন্যে আমার শাফায়াত হালাল হয়ে গেলো।
এ হাদিসটি ইমাম আবু বকর আহমদুল বায্যার স্বীয় ‘মসনদে’ নকল করেছেন। পূর্বোক্ত হাদিস হতে এ হাদিসটির মধ্যে ‘আজাবাত’ এর পরিবর্তে ‘হালাত’ শব্দটি রয়েছে বিধায় এ হাদিসটি আলাদাভাবে আবারো তুলে দেয়া হলো। এ হাদিসটিকে উক্ত হাদিসের মোতাবেয়াত (অনুগামী) এবং সবুত বা প্রমাণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
৩। “মান জায়ানি যায়েরান্ লা ইয়া’মালুহু হাজাতুন্ ইল্লা যিয়ারাতি কানা হাক্কান আলাইয়া আন্ আকুনা লাহু শাফিয়ান্ ইয়াওমাল্ কিয়ামতে” অর্থাৎ যে ব্যক্তি জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমার কাছে এলো এবং এ কাজে সে জিয়ারত ছাড়া নিজেকে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলো না, তাহলে আমার উপর জরুরী হবে যে, আমি কেয়ামতের দিন তার শাফায়াতকারী হবো।
এ হাদিসটি তিরবানী ‘মো’জমে কবীর’-এর মধ্যে, দারেকুতনী ‘আমালী’-এর মধ্যে এবং আবু বকর ইবনুল মুক্রী ‘মো’জাম’-এর মধ্যে সহীহ্ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
৪। “মান্ হাজ্জা ফযারা কব্রি বা’দা অফাতি ফাকাআন্নামা যারানি ফি হায়াতি” অর্থাৎ যে ব্যক্তি হজ্জ করলো, অতঃপর আমার ওফাতের পর আমার (কবর) রঁওযা জিয়ারত করলো, সে যেন আমার জীবদ্দশাতে আমার সাথে সাক্ষাৎ করলো।
এ হাদিসটিকে দারে কুতনী তাঁর ‘সুনানে’ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম সুবকী এ রেওয়ায়েতের সনদের উপর বাহাছ করে সমস্ত আপত্তি খন্ডন করে বিরুদ্ধবাদীদের চমৎকার জবাব দিয়েছেন। এ ইবারতটি আবু আহামদ ইবনে আদী ‘কামিল’-এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। অনেক মুহাদ্দেসীন তো এ রেওয়ায়েতটিতে ‘সহেবাণী’ শব্দটি বৃদ্ধি করেছেন, যার অর্থ এটাই যে, “ঐ জিয়ারতকারী সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভ করবে”।
৫। “মান্ হাজ্জাল বাইতা, ওয়ালাম্ ইয়াযুরনী ফাকাদ জাফানী” অর্থাৎ যে ব্যক্তি বায়তুল্লায় হজ্জ সম্পন্ন করলো, অথচ আমার সঙ্গে জিয়ারত করলো না, সে ব্যক্তি আমার প্রতি অন্যায় বা যুলুম করলো।
এ রেওয়ায়েতটি ইবনে আদী তাঁর ‘কামিল’-এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এ রেওয়ায়েতের সনদে ‘আন-নো’মান ইবনে শিবলিন্’ রয়েছে, তার সম্বন্ধে ইমাম সুবকী বলেছেন, তাকে ইমরান ইবনে মুসা ‘ছিকা’ (মো’তাবর, বিশ্বস্ত) বলেছেন এবং মুসা ইবনে হারুন তাকে ‘মুত্তাহিম’ (দোষারোপকারী) বলেছেন। মতান্তরের শেষে সিদ্ধান্ত হলো তাকে বিশ্বস্ত বলেই সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৬। “মান্ যারা কব্রি আও মান্ যারানি কুন্তো লাহু শাফিয়ান্ আও শাহিদান” অর্থাৎ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম হয় (মান্ যারা কব্রি) বলেছিলেন অর্থাৎ আমার কবরের জিয়ারত করেছে, না হয় বলেছিলেন (মান্ যারানি) অর্থাৎ যে আমার জিয়ারত করেছে, আমি তার শাফায়াতকারী হয়ে গেলাম অথবা এ কথা বলেছেন, তার সাক্ষী হয়ে গেলাম।
এ হাদিসটিকে আবু দাউদ তায়াল্সি তাঁর ‘মুসনাদ’-এর মধ্যে রেওয়ায়েত করেছেন।
৭। “মান্ যারানি মোতাআম্মেদান, কানা ফি জাওয়ারি ইয়াওমাল্ কিয়ামতে” অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এবং নিয়ত করে আমার জিয়ারত করবে, সে কেয়ামতের দিন আমার হেফাজতে থাকবে।
যদিও এ রেওয়ায়েতের সনদে হারুনকে আয্দি অগ্রহণযোগ্য দলিল বলে পেশ করেছেন, কিন্তু ইবনে হাব্বান তাকে ‘ছেক্কাহ’ বা মো’তাবার-এর মধ্যে গণ্য করেছেন। আর ইবনে হাব্বানের মর্যাদা আয্দি হতে অনেক উপরে।
৮। “মান্ যারানি বা’দা মওতি ফাকাআন্নামা যারানি ফি হায়াতি” অর্থাৎ নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লাম বলছেন, যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার জিয়ারত করলো সে যেন আমার জীবদ্দশাতেই আমার সঙ্গে জিয়ারত করলো।
এ বর্ণনাটি দারে কুতনী প্রভৃতিরা বর্ণনা করেছেন। কিছু কিছু সনদে এ শব্দগুলো বেশী রয়েছে, “ওয়ামান্ মাতা বে আহাদিল্ হারামাইনে, বোয়েছা মিনাল্ আ’মেনীনা ইয়াওমাল কিয়ামতে”। অর্থাৎ যে ব্যক্তি হারমে মক্কা অথবা হারমে মদিনাতে মৃত্যুবরণ করলো, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির প্রশান্ত অবস্থায় পুনরত্থান হবে।
৯। “মান্ হাজ্জা হাজ্জাতাল্ ইসলামে ওয়া যারা কব্রি ওয়া গাজা গাজওয়াতান্ ওয়াছাল্লা আলাইয়া ফি বাইতিল মকদেসে লাম্ ইয়াস্আল্হুল্লাহু আয্যা ওয়া জাল্লা ফিমা ইফতারাদা আলাইহি” অর্থাৎ যে ব্যক্তি ফরজ হজ্জ আদায় করলো এবং আমার রঁওযা জিয়ারত করলো এবং সে জেহাদ করলো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসে গিয়ে আমার উপর দুরূদ পাঠালো, আল্লাহপাক তার কাছে অন্যান্য ফরজসমূহের বিষয় কোনো প্রশ্ন করবে না।
হাফেজ আবুল ফতহুল আয্দি এ রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন।
১০। “মান্ আতাল্ মদিনাতা যায়েরান্ লি আজাবাত লাহু শাফায়াতি ইয়াওমাল কিয়ামতে, ওয়ামান্ মাতা ফি আহাদিল হারামাইনে, বোয়েছা আমেনান্” অর্থাৎ যে ব্যক্তি মদিনায় আমার জিয়ারতের জন্য এলো, তার জন্যে আমার শাফায়াত কিয়ামতের দিন ওয়াজিব হয়ে গেলো। আর যে ব্যক্তি দু’টি হারামের মধ্য হতে কোনো একটি হারামে মৃত্যুবরণ করলো, তাকে কিয়ামতের দিন আরামের সঙ্গে পুনরুত্থান করা হবে।
এ হাদিসটি ইয়াহইয়া আল হুসাইনী “আখবারুল মদিনাতে” উল্লেখ করেছেন।
১১। “মান্ লাম ইয়াযোর কবরি, ফাকাদ জাফানি” অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার রঁওযা জিয়ারত করলো না, সে আমার সঙ্গে বে-ইনছাফি করলো।
এ হাদিসটি ইবনুন নাজ্জার “আদ্-দুররাতুস সামিনা” কিতাবের সূত্রে “সেফাউস সেকামের” ২৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে।
১২। “মান্ যারানি বিল্ মদিনাতে মুহ্তাসেবান্ কুনতো লাহু শাহিদান্ ওয়া শফিয়ান্”। অর্থাৎ যে ব্যক্তি পূণ্যার্জনের নিয়তে মদিনায় আমার সঙ্গে জিয়ারত করলো, আমি তার সাক্ষী এবং সুপারিশকারী হবো।
অন্য একটি রেওয়ায়েতে আছে, “মান্ যারানি মুহতাসেবান্ এলাল্ মদিনাতে কানা ফি জেওয়ারি ইয়াওমাল কিয়ামাতি” অর্থাৎ যে ব্যক্তি পূণ্যার্জনের নিয়তে মদিনা পর্যন্ত এসে আমার জিয়ারত করলো, সে কিয়ামতের দিন আমার হেফাজতে থাকবে।
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর এ বর্ণনাটি তিনটি সনদের মাধ্যমে বর্ণনা করার পর ইমাম সুবকী বলেছেন, এ সনদ তিনটি মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে আবি ফদিকের উপর নির্ভরশীল এবং তিনি “মুত্তাফেকুন” আলায়হি- এর তরিকায় সনদ হিসেবে পেশ করার যোগ্য। এ হাদিসগুলো “সেফাউস্ সাকামের” ২০-২৬ পৃষ্ঠা হতে তুলে দেয়া হলো।
১৩। যে ব্যক্তি মূল উদ্দেশ্যরূপে আমার জিয়ারত করে, সে কিয়ামতের দিন আমার পড়শী হবে।
১৪। যে ব্যক্তি মক্কায় হজ্জ করার পর আমার উদ্দেশ্যে আমার মসজিদে আসে তার জন্যে দু’টি মকবুল হজ্জ লেখা হয়। এখানে রাছুল সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলায়হি ওয়াছাল্লামের জিয়ারতকে মকবুল হজ্জের সমান বলা হয়েছে। (হৃদয় তীর্থ মদীনার পথে- ১৪৪ পৃষ্ঠা)।