ছালমা আক্তার চিশতী
একজন মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে তার আত্মসম্মানবোধের উপর ভিত্তি করে। যার আত্মসম্মান নেই, তার মাঝে ব্যক্তিত্ব নেই। আত্মসম্মান একটি ক্ষণস্থায়ী/ধ্বংসশীল, অপরটি চিরস্থায়ী। একটি দুনিয়ার, অপরটি আখেরাতের। একটি অকল্যাণের/লাঞ্ছনাময়, অপরটি কল্যাণের/মর্যাদাময়। মানুষের আত্মসম্মান নষ্ট হয় দুনিয়ামুখী চিন্তা-চেতনার দ্বারা। অহংবোধ হতে যে আত্মসম্মানের প্রকাশ ঘটে, তা ক্ষনস্থায়ী এবং লাঞ্ছনাময়। এর দ্বারা পরকাল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অহংবোধের মূলে রয়েছে ঘোর অজ্ঞানতা। মনুষ্যত্ব হারিয়ে যারা অজ্ঞানান্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাদের দ্বারাই ঘটে যত অঘটন। কারণ, তরিকতে/ধর্মজগতে থাকলে ছয় রিপু/নফসে আম্মারা বা হায়ানী আত্মার অধিকারী মানবরূপী পশুদের দ্বারা নির্যাতিত হতে হয়। ওরা বহু লেজের অধিকারী। তা না কাটতে পারলে হাশরের দিন সেই লেজগুলো লোক সমাজে প্রকাশিত হবে এবং হবে জাহান্নামী। বাহিরের রূপটি মানবরূপ কিন্তু ভিতরে রয়েছে ভয়ঙ্কর পশু-প্রবৃত্তি। তাই তাদেরকে বলা হয় নরপশু। ওরাই হলো শয়তানের বান্দা। কারণ, ওরা শয়তানের ধর্মে দাখেল হয়ে আছে। মানবদেহে নফস আম্মারা হলো শয়তানের/খান্নাছের অবস্থানের জায়গা। এই অবস্থানটি দুই রকম। মানুষের ভিতর থেকেও হতে পারে, আবার বাহির থেকেও হতে পারে। ভিতরের পশুত্বটি যখন বাহিরে আসে তখনই সে হয় মুক্তিকামী মানুষের জন্য প্রকাশ্য শত্রু (কোরান দ্রঃ)। এ ধরণের প্রকাশ্য শত্রুদের ব্যক্তিস্বার্থের বলি হচ্ছে মুক্তিকামী মানুষ বা সাধারণ মানুষগুলো। ওরা তাগুতের পূজা করছে বা বাছুর পূজা করছে (কোরান দ্রঃ)। এ ধরণের বিচিত্র দুনিয়ামূখী মানবরূপী পশুদের জাগতিক ধন-সম্পদের মোহে বা মনের মাঝে লালিত অসুরত্ব/পশুত্বের কারণে অন্ধ হয়ে অন্ধকার কবরে বাস করছে- এটি তাদের মগজে ঢুকছে না (সুরা হুমাযা, ১-৪)। অন্ধ-বধির বোকারা বসে আছে দেহ ত্যাগের পরে মাটির অন্ধকার কবরে বাস করবে বলে। মোল্লাদের কুশিক্ষার ফল ইহা। আরব বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক মেয়েদের বায়াত সম্পর্কে তাঁর রচিত “রাসূলের (স.) যুগে নারী স্বাধীনতা” কিতাবের ৪৬২ পৃঃ বলছেন – “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মেয়েদের বাইয়াত গ্রহণ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। প্রথম ইঙ্গিত- নারীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব এবং সে নিছক পুরুষের অধীন নয়, বরং পুরুষের মত তাকেও বাইয়াত করতে হয়। দ্বিতীয় ইঙ্গিত, মেয়েদের বাইয়াত ইসলামের বাইয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য। এ বিষয়ে নারী ও পুরুষ সমান। পুরুষরাও অনেক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হুবহু মেয়েদের বাইয়াতের ভাষায় বাইয়াত করতো।”
মাটির কবরে মানুষ যাবে না, যাবে মানুষের দেহটি। নানা ফেরকার মোল্লাদের কামড়াকামড়িতে (ইয়াজুজ-মাজুজ) ইসলাম ধর্ম ৭৩ তালির পোশাক পড়ে জোকার সেজেছে। মূর্খ মোল্লাদের রচিত বিধানের কারণেই নারীগণ ভেদ-বিভেদ, বৈষম্যের শিকার হয়ে আছে সমাজে। একদল অন্ধ-বধির-মুর্দা নারীগণও তা মেনে নিয়েছে। ওরা মনে করছে কিছু শাস্ত্র আওড়ালেই ভুরি ভুরি ছোয়াব মিলবে! পাবে জান্নাত! সেখানে নারী দেহ ভোগ করতে পারবে,- এ ধরনের অলীক কিচ্ছাই তাদেরকে অন্ধ-বধিরে পরিণত করছে। সেদিন বুঝবে তাদেরকে অলীক ছোয়াবের কিচ্ছা শুনিয়ে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু ফিরে আসার সুযোগ হবে না। ইসলাম বাস্তব ধর্ম। অনুমান-অলীক কিচ্ছার ধর্ম ইহা অবশ্যই নয়। তাদের এ দশা কেনো ? কারণ, ওরা অন্ধকার কবরে বাস করে চিৎকার করছে, তারা তাদের নিজের তকদির পরিবর্তন করতে চাচ্ছে না তাই। ওরা খোদার নিকট প্রার্থনা করতে জানে না, চাইতে জানে না। আল্লাহ বলেন, তুমি চাওয়ার সাথে সাথেই আমি তোমাকে দিয়ে দিব। কিন্ত না তাগুতের/বাছুর পূজারীরা/বস্তুবাদীরা চাওয়া বলতে, ধন-সম্পদ, পুত্র-কন্যা, ব্যবসা-বানিজ্য, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি হতে মুক্তির জন্য দোয়া চাইছে। ওরা দোয়া করতেই জানে না। এ ধরণের লোকগুলো দ্বারাই ধর্ম জগত বিকৃত হয়। ঈমানদারগণ (যারা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে ঈমান এনছে) এ ধরনের ধর্মান্ধ দৈত্য-দানবদের দ্বারাই নির্যাতিত, সমালোচিত, বাঁধাগ্রস্ত হয়ে থাকে সমাজে, বিশেষ করে নারী সমাজ। ঘরে বাইরে রয়েছে তাদের অবস্থান। প্রবাদ বাক্য রয়েছে – “নিজের চরকায় তেল না দিয়ে অন্যের চরকায় তেল দেওয়া।” অশুদ্ধ মানুষের স্বভাব এইরূপই হয়, যারা মানুষরূপী পশু তাদের স্বভাব হয় এইরূপ। গুরু ভজন করতে গিয়ে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, ধর্মান্ধ দৈত্য-দানবদের মোকাবেলা করতে হয়। আমার দাদা গুরু দেওয়ান শাহ্ রজ্জব আলী চিশতি নিজামী একটি গানের মাঝে বলছেন “থাকলে লোক লজ্জা কুল কলংকের ভয়, রজ্জব কয় যাইসনে সেই খানে।” লালন সাইজি বলছেন “যায় যাবে ছাই জাত কুল মান তাতে ক্ষতি নাই, যদি আমার প্রাণ বন্ধুরে পাই।”
মহাপুরুষগণ জাগতিক জগতের মান-মর্যাদাকে/জাত-কুলকে অস্বীকার করে চিরস্থায়ী জাতের/মান-মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। ইতিহাসে তার হাজার হাজার নজীর রয়েছে। এইরূপ বহু কথা জ্ঞানীরা বলছেন। এর মানে অশালীন চলাফেরা বা অশালীন পোশাক পড়া নয়। যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদেরকে সম্মান করতে পারে না তারা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে লানত/অভিশাপ প্রাপ্ত। নারীদের গুরুর নিকট যাওয়া পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে মেনে নিতে পারে না। কারণ, অন্ধ মূর্খরা মনে করে নারীদের কবর, হাশর, মিজান, পুলছিরাত, বেহেশত বা দোযখ নেই। যুগে যুগে নারীরা এই পুরুষ শাসিত অন্ধ-মূর্খ সমাজের কাছে নির্যাতিত হয়ে আসতেছে। কারণ, পুরুষরা মনে করে নারীরা শোকেসে সাজিয়ে রাখার পুতুল। যখন তার দরকার মনে হবে তখন সে শোকেস থেকে বের করবে, আবার যখন তার দরকার নেই তখন শোকেসের ভেতরে ভরে রাখবে। জেল খানার ন্যায় সেই মেয়েটির জীবন। ভোগবাদী পুরুষদের এই হলো চরিত্রের হাল। চেয়ে দেখুন আফগানিস্তানের কুখ্যাত মৌলবাদ তালেবানদের দিকে। ওরা নারী লোভী ধর্মান্ধ দৈত্য-দানব। বিধবা বা কুমারী মেয়েদেরকে ঘর হতে জোর করে বের করে নিয়ে বিয়ে করছে। কুলীন-অকুলীন নেই, সম-অসম নেই, যাকে পছন্দ হচ্ছে/মনে চাচ্ছে তাদেরকেই জোর করে ধরে নিয়ে বিয়ে করছে। বন্য পশুর মতো নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তাতে এক বিভীষিকাময় চিত্র ফুটে উঠেছে আফগানিস্তানের মধ্যে (যুগান্তর)। তাদের এ ধরনের শাস্তি পাবার কারণ হলো তারা নারী। অথচ বোখারী ও মুসলিমের হাদিস হতে জানা যায়, হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাছুল স. বলেন, “বিধবা নারীর নির্দেশ ও কুমারীর অনুমতি ব্যতিরেকে বিবাহ দেয়া যাবে না।” নারী তাদের নিকট শুধু ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের ধর্মান্ধ দৈত্য-দানবেরা আবার মুসলমানও দাবী করছে, মেয়েদের পর্দার দোহাই দিচ্ছে আবার দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের লীলা খেলাও চালাচ্ছে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলছেন “পৃথিবী একটি সম্পদ তার উত্তম সম্পদ হচ্ছে নেককার নারী।” (বোখারী ও মুসলিম, রাছুল সা.-এর যুগে নারী স্বাধীনতা, প্রথম খন্ড।)।
অন্ধ-মূর্খ গোয়ার গোবিন্দের দল শুধু কাপড়ের পর্দা হিজাব দ্বারাই নারীদের মর্যাদা নির্ণয় করছে, গুণ-খাছিয়ত দ্বারা নির্ণয় করার শক্তি তাদের নেই। নারীদের জন্য পর্দার কঠোরতা বা বাড়াবাড়ি পুরুষ জাতির দূর্বলতা বা অধঃপতন হতে সৃষ্টি। যদিও শুধু জৈবিক দেহের নারী-পুরুষ দ্বারা ধর্ম জগতের বিচার বিশ্লেষন চলে না। হযরত রাবেয়া বসরী (র.) বলছেন “যারা দুনিয়ার প্রেমি সেই লোকগুলো পুরুষ হলেও সে নারী আর যেই মানুষটি আল্লাহর প্রেমিক সে জৈবিক দেহের নারী হলেও সে পুরুষ।” পুরুষ হওয়াটা অনেক বড় সাধনার বিষয়। জৈবিক দেহের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করাটাই হচ্ছে সাধনা। “নারী কখনো বেহেশতে যাবে না”- রাছুলের এ কালামকে অন্ধ-বধির আলেম মোল্লারা জৈবিক দেহের নারী বুঝিয়ে মুসলিম সমাজকে ধ্বংস করছে, পথভ্রষ্ট করে চলছে, অথচ হাকিকত হলো ওরা নিজেরাই নারী ; সে ভেদ বুঝেনি। মোহ যা চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাঁধাস্বরূপ এসে দাড়িয়ে থাকে নারীত্ব। যেমন – মিষ্টি ধরলে হাত আঠা হয়ে যায়, সেই আঠা ধোয়ার জন্য পানির প্রয়োজন হয় ঠিক তেমনি মোহ দীলকে দুনিয়াবি চিন্তা দ্বারা আবৃত করে রাখে, সেই আবরণ দূর করতে হলে দীলের মাঝে অনুরাগ তৈরি করতে হবে, মুর্শিদের বিশ্বাস-ভক্তি-প্রেম হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। মুর্শিদের জাত আর খোদার জাত এক বুঝতে হবে, এক দেখতে হবে, নয়তো কালেমা পড়লে শেরেক হবে। মুহাম্মদ রাছুলই হলেন একমাত্র মুর্শিদ, চিনে নিতে হবে তাঁর পরিচয় কি ? তিনিই যুগে যুগে বর্তমান, হেদায়েতকারী। আল্লাহর সৃষ্টিতে মুর্শিদই একমাত্র মুক্তির কান্ডারী-কালেমাতে ইহাই দেখানো হয়েছে। যারা কালেমা জানে তারা এ ভেদ-রহস্য অবশ্যই জানে এবং চিনে মুর্শিদ/গুরু কে ? আর অন্ধ-মূর্খরা তার সমালোচনা করে-ইহাই জাহান্নামী হওয়ার প্রমাণ। তবেই দুনিয়া থেকে আখেরাতে প্রবেশ করতে পারবে। একজন নারীকে তুচ্ছ ভাবাটাই ভুল, নিজেই নারী তার প্রমাণ। খোদার নিকট জৈবিক নারী পুরুষ প্রভেদ নেই। কিছু নিচু মনের (অসভ্য-পশুত্ব স্বভাবের) মানুষদের দ্বারা নারীরা নিজ গন্তব্যের/আখেরাতের পথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে থাকে। যাদের মনে গুরু দেয়া অনুরাগ শক্তি রয়েছে তারা ঐ সমস্ত নরপশুদের/শয়তানের বান্দাদের শত ধোকা-প্রবঞ্চনায়ও ঈমান হারাবে না। কারণ, তাদের অন্তরাত্মার মাঝে অনুরাগস্বরূপ গুরু বাস করে। তারা ঈমানে কামেল হয়ে আছে। শয়তানের শত চক্রান্তেও তাদের ঈমান হারাবে না। মানবরূপী শয়তান সব সময়ই ঈমানদারদের পিছনে লেগে আছে। মানবরূপ না ধরে শয়তান মুক্তিকামী মানুষ বা ঈমানদারকে ধোঁকা দিতে পারে না, ইহাই তার সহজ পথ। এরাই হলো প্রকাশ্য শত্রু (কোরান দ্রঃ)।
যার ঈমান আছে সে-ই গুরুতেই খোদা দর্শনকারী হয়, যারা কিছু পায়নি তারা তাদের ঈমানের দূর্বলতার কারণেই পায়নি। কবি জালাল খাঁ বলছেন, “পীরের ছুরতে খোদা আছেন এই জগতে, না থাকিলে নাই তোমার বিশ^াসের কারণ। বিশ্বাস বিহনে পাবে না এই জীবনে, রয়ে সয়ে থাকলে পাবে প্রভু নিরাঞ্জন।” যারা চেতন মানুষ সে জৈবিক দেহের পুরুষ হোক বা নারী হোক সে আত্মার নূরকে চিনতে পারে তাই সে দৃঢ় মনোভাব নিয়ে চলে। দেহের নূর আর আত্মার নূর এক নয়, তা চেনা দরকার। যেমন লবন পরিমাণ মত হলে তরকারির স্বাদ অক্ষুন্ন থাকে, আর যদি ভাতের ও তরকারির মাঝে পরিমানের চেয়ে বেশি লবন দেওয়া হয় তবে সেই খাবার খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পরে। ঠিক তেমনি একজন নারীর স্বাধীনতার উপর অহরহ যদি হস্তক্ষেপ করে সে জাগতিক জগতে যতো আপনজনই হোক না কেন তার প্রতি তিক্ততা এসে যাবে।