জীবনী – আউলিয়াকূল শিরোমণি ইমাম জাফর সাদিক (র)

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

প্রভূর অমর প্রেমের ধামের শাশ্বত বার্তা বহন করে প্রতি যুগের কিছু বিশেষ পূণ্যাত্মা ভূমিষ্ট হন এ মাটির পৃথিবীতে। তাঁরা তাদের আলোকিত আত্মার জ্যোতির্চ্ছটায় আলোকিত করে তোলেন এ মহীমন্ডলকে। তারা সরাসরি প্রভূ কর্তৃক মনোনীত ও প্রেরিত। মহানবী (সা) এর পূর্ব অবধি আগত এ সকল পূণ্যাত্মাদেরকে আমরা বলি নবী বা রাসুল এবং বেলায়েতের যুগ তথা নবী করিম (সা) পরবর্তী যুগে আগত সকল পূণ্যাত্মা দেরকে আমরা বলি অলী আউলিয়া তথা জ্ঞানী বা পবিত্র মানুষ। তারা জগতে আবির্ভূত হয়ে পতিত মানবজাতিকে দেখান সরল সুপথ। পঙ্কিলতা থেকে সকলকে টেনে তোলেন জান্নাতী জীবনে। তারাই যুগের অলী মুর্শিদ। তেমনি একজন পূণ্যাত্মা হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (র)।

বেলায়েতী জামানার অন্যতম একজন আউলিয়া হলেন ইমাম জাফর আস সাদিক (র)। মহানবী (সা) এর আদর্শের ধারক ও বাহক ছিলেন ইমাম জাফর আস সাদিক (র)।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

মাওলা আলী (আ) এর বংশধর তিনি। রাসুল (সা) এর পরিবারের অন্তর্ভূক্ত তিনি। বারো ইমামের অন্যতম ইমাম জাফর আস সাদিক (র)। তাঁর কুনিয়াত ছিল আবু মুহাম্মদ। তৎকালীল জ্ঞান বিজ্ঞানে ছিল তাঁর অসামান্য বুৎপত্তি। ধর্মের গুঢ় রহস্যে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পরিপূর্ণ একজন সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন তিনি। তাঁর এলমে মারেফত জগতে বিলিয়েছে অসামান্য আলোক।

৮৩ হিজরীর ১৭ রবিউল আউয়াল পবিত্র মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহন করেন তিনি। সাদেক তাঁর উপাধি। তাঁর পিতার নাম ইমাম মুহাম্মদ বাকের (র) এবং মাতার নাম উম্মে ফরওয়া (র)। নবী বংশ সাইয়্যেদ বংশ ছিল তাঁর। বংশ ধারা নিন্মরুপ – হযরত মুহাম্মদ (সা) – হযরত আলী (আ) – ইমাম হোসাইন – (আ) ইমাম জয়নুল আবেদীন (র) – ইমাম বাকের (র) – ইমাম জাফর সাদেকর (র)।

মুসলিম জাহানের ইমাম

পিতা এবং পিতামহের নিকট থেকে মোহাম্মদী ইসলামের সকল বিষয় শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ধর্মের গুঢ় রহস্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন তিনি। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি মুসলিম জাহানের ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। ইমাম জাফর সাদিকের জ্ঞান ছিল নবুয়তের জ্ঞান এরই উত্তরাধিকার।

তিনি বলতেন, “আমার কথা আমার পিতা ইমাম বাকের (র) এরই কথা, তাঁর কথা আমার দাদা ইমাম জয়নুল আবেদীন (র) এরই কথা, আমার দাদার কথা হযরত ইমাম হোসাইন (আ) এরই কথা, ইমাম হোসাইন (আ) এর কথা আমীরুল মু’মিনীন মাওলা আলী (আ) এরই কথা আর মাওলার কথা স্বয়ং রাসুল (সা) এরই কথা, এবং রাসুল (সা) এর কথা মানেই মহান আল্লাহ পাকের কথা।” তিনি আরো বলতেন, “আমাদের তথা রাসুল (সা) এর আহলে বাইয়াতের কাছে রয়েছে অতীত,ভবিষ্যতের জ্ঞান আর অন্তরে সঞ্চারিত খোদায়ী জ্ঞান তথা ইলহাম।”

জ্ঞান ও অবদান

তাঁর সময়কালে মুসলিম জাহানে ধর্মীয় জ্ঞানে সবচাইতে প্রাজ্ঞ ছিলেন তিনি। ধর্ম, কোরান দর্শন, সহ আধ্যাত্মবাদের সকল শাখায় ছিল তাঁর পূর্ণ দখল। তিনি অনেক বিখ্যাত পন্ডিতকে ধর্ম জ্ঞান শিখিয়েছেন। বিখ্যাত ফকীহ মুহাম্মদ বিন মুসলিম, যুরারেহ, শাস্ত্রবিদ হিশাম, বিশিষ্ট পন্ডিত মুফায্যাল, বিশ্বশ্রুত পন্ডিত জাবির আল হাইয়্যান এর মতো বহু অনুগামী ছাত্র ছিল তাঁর।

ধর্ম প্রচার

তৎকালীন সময়ে ইলমে তাসাউফ তথা ধর্মের প্রকৃত হাকিকত তথা সত্য প্রচারে সারাজীবন নিজেকে ব্রতী রেখেছিলেন তিনি। বিশ্বশ্রুত ওলী বায়েজিদ বোস্তামী, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ সহ অনেকেই তাঁর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। হযরত ইমাম জাফর সাদের এর নিকট থেকে ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করে ইমাম আবু হানিফা বলেছেন, “আমি যদি ইমাম জাফর আস সাদিকের নিকট জ্ঞান অর্জন না করতাম, তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।”

প্রজ্ঞা ও ধর্মবোধ

ইমাম জাফর আস সাদিক ছিলেন দিগন্ত প্রসারী চিন্তাশক্তি, দূরদর্শী জ্ঞান আর সীমাহীন প্রজ্ঞার অধিকারী। তিনি তাঁর সময়ে প্রচলিত জ্ঞানের সকল শাখায় পূর্ণ জ্ঞান রাখতেন। সারাজীবন তিনি তাঁর ইমামতের সুধা বিলিয়ে দিয়েছেন সর্বসাধারনের জন্য। তাঁর অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা তখন লোকজনের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। ধর্মবোধে তিনি ছিলেন সুউচ্চ মহিমাময়।

ওফাত

হযরত ইমাম জাফর সাদেক একটানা ৩৪ বছর মুসলিম জাহানকে নেতৃত্ব দেয়ার পর ১৪৮ হিজরীর শাওয়াল মাসে ওফাত লাভ করেন। আব্বাসিয় খলিফা আল মনসুরের দেওয়া বিষে শাহাদাত বরণ করেন এই মহান জ্ঞানতাপস ও ইমাম। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। মদিনার জান্নাতুল বাকীতে পিতা ইমাম বাকের (র) এবং পিতামহ ইমাম জয়নুল আবেদিন (র) এর মাজারের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

রচনাকাল – 06/09/2019
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর