লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
নবুয়তের ঘরে লালিত পালিত এক মহাপুরুষ হলেন খাজা হাসান বসরী (রা)। নবীপত্নীদের স্তনের পীযূষধারা পানের সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। বেলায়েতের পতাকাবাহক, গুপ্ত জ্ঞানের তোরণ মাওলা আলী (আ) এর নিকট থেকে সরাসরি অর্জন করেছেন জ্ঞান। খাজা হাসান বসরী সেই সৌভাগ্যবান মহাপুরুষ, যার থেকেই প্রবাহিত হয়েছে এলমে তরিকতের ফল্গুধারা। বিশ্বব্যাপী সমধিক প্রচলিত তরিকাদ্বয় ‘চিশতীয়া’ এবং ‘কাদরিয়া’ খাজা হাসান বসরী (রা) থেকেই আগত।
সরাসরি মহানবী (সা) এর সানুরাগ সংস্পর্শধন্য খাজা হাসান আল বসরী (রা)। এলমে মারিফতের দীক্ষা নেন নবী (সা) এর গুপ্তজ্ঞানের ধারক বাহক মাওলা আলী (আ) এর নিকট হতে। তাঁর যামানার সর্বোচ্চ জ্ঞানী হিসেবে তাঁকেই ধরা হতো।
যে ঘটনা বদলে দেয় খাজা হাসান বসরী (রা) এর জীবন –
খাজা হাসান বসরী (রা) এর প্রথম দিককার জীবন ছিল অন্যরকম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত একজন রত্ন ব্যাবসায়ী। রত্ন ব্যাবসার খাতিরে তিনি ভ্রমণ করতেন বিভিন্ন দেশে। ব্যবসায়ীক প্রয়োজনেই তাঁর সম্পর্ক ছিল নানান দেশের আমীর ওমরা আর রাজা বাদশাহদের সাথে।
তৎকালীন বিশ্বের বিখ্যাত সাম্রাজ্য ছিল রোম। সঙ্গত কারণেই রোমের প্রধানমন্ত্রীর সাথে গড়ে ওঠে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
ব্যাবসায়ীক কাজে একবার রোম গিয়েছেন খাজা হাসান বসরী (রা)। মন্ত্রীবর এর নিকট যেতেই তিনি দেখতে পেলেন মন্ত্রীবর কোথায় যেনো যাচ্ছেন। খাজা হাসান বসরী (রা) কে দেখেই মন্ত্রী আহ্লাদিত হয়ে উঠলেন এবংবললেন, ভালোই হয়েছে আপনি আজ এসে। আমরা একটি অনুষ্ঠানে যাবো। চলুন আমাদের সঙ্গে।
ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা হলেন তারা। গন্তব্যস্থানে গিয়ে দেখা গেলো, বড় একটি মাঠে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের। মাঠের এক প্রান্তে স্বর্ণ ও মণিমুক্তা খচিত রেশমি কাপড়ের অত্যন্ত সুন্দর একটি তাবু। সেখানে চলছে অনুষ্ঠান। খাজা হাসান বসরী (রা) দেখতে লাগলেন অনুষ্ঠানের কার্যপ্রক্রিয়া।
প্রথমত একদল সুসজ্জিত সৈন্য তাঁবুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে কি যেনো আবৃত্তি করতে লাগলো। তারপর তারা চলে গেলো। এরপর তাঁবু পরিভ্রমণ করতে এলেন একদল বয়স্ক পন্ডিত মানুষ। তারাও তাঁবুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে কি সব দূর্বোদ্ধ ভাষায় আবৃত্তি করলেন এবং চলে গেলেন। এরপর এলো একদল রুপসী মহিলা। সুসজ্জিত মহিলার কাফেলা টি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তাঁবু পরিভ্রমণ করলো এবং চলে গেলো। আর কি যেনো সব বললো। পরিশেষে এলেন, রোম সাম্রাজ্যের অধিপতি স্বয়ং বাদশাহ এবং তাঁর সম্রাজ্ঞী। তারা সবাই ঢুকলেন তাঁবুর মধ্যে। অশ্রুসজল নয়নে তারা তাঁবু পরিভ্রমণ করলেন এবং কি যেনো সব আবৃত্তি করলেন। তারপর বেড়িয়ে এলেন বাইরে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব দেখছিলেন খাজা হাসান বসরী (রা)। কৌতুহল নিবারণ করতে না পেরে খাজা হাসান বসরী (রা) মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, “আপনাদের এমন আচরণের মর্ম খুলে বলুন আমায়।” মন্ত্রীবর বিস্তারিত সব বললেন খাজা হাসান বসরী (রা) কে।
মন্ত্রী বললেন, আমাদের সম্রাটের এক পুত্র ছিল, যাকে সম্রাট খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে সন্তানটি মারা যায়। বহু নামী দামী চিকিৎসকরাও তাকে সুস্থ করতে ব্যার্থ হয় । তাকে এখানে এই তাঁবুর অভ্যন্তরে কবর দেয়া হয়েছে। রাজপুত্রটির স্বরনে প্রতিবছর এখানে এ অনুষ্ঠান টি হয়
খাজা হাসান বসরি (রা) বললেন, কিন্তু পরিভ্রমণ রত সবাই কি বললেন?
মন্ত্রী বলতে লাগলেন- প্রথম যে সেনাদল দেখেছেন, তারা বললো, হে রাজকুমার! আমরা আমাদের শক্তি সামর্থ্য দিয়ে আপনাকে রক্ষা করতে পারিনি। যদি আমরা পারতাম আপনার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতাম। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আমাদের সকল শক্তি ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
পন্ডিত সমাজ বলে গেলেন, রাজুকুমার! আমাদের পান্ডিত্য যদি আপনাকে রক্ষা করতে পারতো, তাহলে আমরা পূর্ণ চেষ্টা করতাম করার। আপনার ক্ষেত্রে আমাদের পান্ডিত্য, জ্ঞান আর প্রজ্ঞা সবই বিফল । কোনো বিদ্যাই বিধাতার বিধান কে আটকাতে পারে না।
মহিলারা এসে তাঁবু পরিভ্রমণ করে বলে গেলো, যুবরাজ! আপনার বিচ্ছেদ বেদনা অসহনীয়। আপনার জন্য যদি আমাদের কিছু করার থাকতো আমরা তা অবশ্যই করতাম। আমাদের রুপ লাবণ্য আপনার জন্য কোনো কাজেই এলো না। আমরাও আপনার জন্য কিছু করতে অক্ষম হলাম।
অবশেষে সম্রাট সম্রাজ্ঞী বললেন, পুত্র! তোমার পিতার শক্তি, সামর্থ্য, রাজক্ষমতা, বিত্ত বৈভব কত কি! সব ত্যাগ করেও যদি তোমাকে রক্ষা করা যেতো আমি তাই করতাম। আজ তোমার অকাল প্রস্থান তোমার পিতার অক্ষমতাকেই দেখিয়ে দিয়ে গেলো। মহান নিয়ন্তা যিনি, তার নিকট পৃথিবীর সকল ক্ষমতা নিতান্তই তুচ্ছ। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র আমার ! তোমার পিতাও অসহায়।
মন্ত্রীর মুখে পুরো বিবরণটা শুনলেন খাজা হাসান বসরী (রা)। এক গভীর ভাবান্তর দেখা গেল খাজা হাসান বসরীর মধ্যে। তাঁর চেতনায় ফুটে উঠলো পার্থিব-জীবনের অসারতার চিত্র। অর্থ, বিত্ত, বৈভব সকল কিছুর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন তিনি।
খাজা হাসান বসরি (রা) উক্ত ঘটনাটি থেকে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে ছেড়ে দিলেন তাঁর রত্ন ব্যাবসা। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন, সংসার জীবনে আর আসক্ত হবেন না তিনি। বসরায় চলে আসলেন খাজা হাসান বসরী (রা)। শুরু করলেন একাগ্র আধ্যাত্মিক সাধনার জীবন। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন যুগশ্রেষ্ঠ ওলী ও পূর্ণ মানব । ধারণ করলেন দ্বীনে মোহাম্মদীর নিশাণ। সারা জীবন বিলিয়ে গেলেন ইলমে মারিফতের জ্যোতি।
সংসারাশক্তিই মানুষকে ফিরিয়ে রাখে মহান প্রভূ হতে। খাজা হাসান বসরী (রা) মোহমুক্ত হয়ে জগতে প্রতিষ্ঠিত হলেন ধর্ম ও জ্ঞান রাজ্যের বাদশাহতে। তাঁর মাধ্যমেই জগত লাভ করলো তরিকত তথা প্রভূ প্রাপ্তির পথ। দ্বীনে মোহম্মদীর সরল সঠিক সত্য সুপথ।
রচনাকাল – 15/10/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী