লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
হযরত ওয়াসে (র) ছিলেন তাঁর যুগের বিখ্যাত সাধক ও ধর্মপ্রাণ আউলিয়া। জ্ঞানী হিসেবে সে যুগে ছিল তাঁর অনেক সম্মান। সারাজীবন কৃচ্ছসাধনার দ্বারা তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি সারাজীবন নিজেকে সমানভাবে ব্যাপৃত রেখেছিলেন প্রভুর উপাসনায়।
হযরত ওয়াসে (র) প্রভুর দরবারে মোনাজাত করতেন, “হে প্রভু, আপনি আপনার প্রিয় বন্ধুগণের ন্যায় আমাকে অভাবগ্রস্থ করে রেখেছেন। জানিনা আমার কোন গুণে সন্তুষ্ট হয়ে আপনি আমাকে এ নেয়ামত দিয়েছেন।” তাঁর এ মোনাজাতেই স্পষ্ট হয়, দারিদ্রতাকে তিনি কত মহৎ মর্যাদা সম্পন্ন করে দেখতেন।
সংযম সাধনা
সারা জীবন তিনি কঠোর সংযম সাধনা মধ্য দিয়ে পার করেছেন। আহার পানীয় প্রভৃতি ব্যাপারে তিনি ছিলেন দারুণ উদাসীন। সারাজীবন তিনি শুধু শুকনো রুটি পানিতে ভিজিয়ে সেটা আহার করেই কাটিয়েছেন। এমনও অনেক দিন যেতো তাঁর যে, কোনো খাবারই পড়তো না তার পেটে।
খাজা হাসান বসরী (রা) এর সাথে সখ্যতা
খাজা হাসান বসরী (রা) এর সাথে মিত্রতা ছিল তাঁর। মাঝে মাঝেই যেতেন খাজা হাসান বসরী (রা) এর দরবারে। বিখ্যাত সাধিকা রাবেয়া বসরী আল আদাবিয়া (র) এর দরবারের মাঝে মাঝে যেতেন হযরত ওয়াসে (র)। তাছাড়া প্রখ্যাত সাধক হযরত কাতিবা (র), মালেক ইবনে দীনার (র) এর সাথেও সখ্যতা ছিল হযরত ওয়াসে (র) এর। হযরত খাজা হাসান বসরী (রা) হযরত ওয়াসে (র) সম্পর্কে বলতেন, “তাঁর মতো ভাগ্যবান ব্যক্তি আর নেই, যিনি পেটে ক্ষুধা নিয়ে সকালবেলায় বিছানা থেকে উঠেন আর ক্ষুধা নিয়েই রাতের বেলা বিছানায় যান। আর এতো কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও প্রভূর উপাসনা হতে বিমুখ হন না।”
পরমুখাপেক্ষী আর পরনির্ভরশীর না হওয়াকেই হযরত ওয়াসে (র) বলতেন প্রকৃত বাদশাহী। তিনি বলতেন, তুমি যদি বেলায়েতের অধিকারী হতে চাও এবং কারো কাছ থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা না করো আর সৃষ্টিজগতকে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরশীর বলে মনে করতে পারো, তাহলে তোমোকে আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না, কারো প্রতি কোনো কাজে নির্ভরও করতে হবে না। তিনি আরো বলতেন, পার্থিব জীবনের ধন সম্পদ রক্ষনাবেক্ষণ করা অপেক্ষা রসনা সংযত করাই কঠিন।
এক সাধকের প্রশ্নের উত্তর
একবার তিনি গেলেন আর এক বিখ্যাত সাধক হযরত কাতিবা (র) এর নিকট তাঁর দরবারে। তাঁর গায়ে ছিল অত্যন্ত জীর্ণ ও পুরাতন পোষাক। হযরত কাতিবা (র) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এমন পোষাক পরেছেন কেনো?’ চুপ করে থাকলেন হযরত ওয়াসে (র)। হযরত কাতিবা (র) আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি চুপ করে আছেন কেনো?’ এবার হযরত ওয়াসে বললেন, ভাবছি, যদি বলি দরবেশদের পোষাক এমনই অনাড়ম্বর হওয়া উচিত, তাহলে কথায় অহমিকা ফুটে ওঠে। আর যদি বলি দামী পোষাক কেনার সামর্থ্য নেই, তাহলে আল্লাহর প্রতি অভিমান-অভিযোগ প্রকাশ পায়।
হযরত ওয়াসে (র) এর আধ্যাত্মিকতা
একবার এক লোক হযরত ওয়াসে (র) কে জিজ্ঞেস করলো, আপনি সুস্থ মনে আছেন তো? তিনি বললেন, প্রতি মুহুর্তে জীবনের আয়ু ক্ষয় হয়ে চলেছে। পূণ্য বলতে কিছুই নাই, বরং পাপের বোঝা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় কি ভালো থাকা যায়? নাকি মনে প্রাণে সুস্থ থাকা সম্ভব?”
হযরত ওয়াসে বলতেন, “আমি সব জিনিসের মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন দেখেছি।”
তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, আপনি কি আল্লাহকে চিনেছেন? খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে তিনি বললেন, “আল্লাহকে যে চিনেছে, সেই নির্বাক ও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।” যারা আল্লাহ তায়ালার অসীম নূরানী রুপের সন্ধান পান তাঁরা সার্বক্ষনিক রুপের সাধনার নিজেকে মত্ত রাখেন। পার্থিব বিষয়ে আর তাদের খেয়াল থাকে না।
তিনি বলেন, “কেউ কোনোদিন প্রকৃত বিশ্বাসী হতে পারে না, যতদিন না তার মনে আশা ও নিরাশা সমানভাবে বিরাজ করে।”
হযরত ওয়াসে সারাজীবনে বহু ওলী দরবেশদের ও পূণ্যাত্মাদর সংস্পর্শ লাভ করেছেন। তাঁর আধ্যাত্মসত্ত্বা ইলমে মারিফতের অসীম গগনে আলোকদীপ্ত নক্ষত্রের মতো বিরাজ করছে।
রচনাকাল – 19/08/2018
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী