লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
বসরা শহর। সে শহরেই বাস করতেন এক নামকরা সুদ ব্যবসায়ী। ব্যবসায় তিনি সিদ্ধহস্ত। শহরজোড়া তাঁর প্রচুর খাতক। বিরাট কারবার। অত্যন্ত কঠোর চিত্তের ব্যবসায়ীটি সারাদিন বাড়ি বাড়ি ঘরে সুদ আদায় করেন। কাউকে বিন্দুমাত্রও ছাড় দেন না তিনি।
একবার এক ব্যক্তির বাড়িতে গেলেন সুদ আদায় করতে। বাড়ির মালিক তখন বাড়িতে ছিলেন না। তার স্ত্রী জানালো মালিকের অনুপস্থিতির কথা। আর বাড়িতে টাকাকড়ি না থাকার কথাও জানালো মহিলাটি। কিন্তু খালি হাতে ফিরে গেলে তো চলবে না! কড়াকড়ি শুরু করলেন সুদ ব্যবসায়ী। কঠোর বাক্যে জানালেন, তাকে সুদ দিতেই হবে। টাকা না থাকলে যা আছে তাই দিতে হবে। দিতেই হবে। অগ্যতা স্ত্রী লোকটি বললো, দেবার মতো ঘরে কিছুই নেই, তবে রান্না করার জন্য শুধু একটি ছাগলের মাথা আছে। যদি ঋণের সুদ হিসেবে সেটি নিতে চান, তাহলে আমি ছাগলের মাথাটি দিতে পারি। মহাজন তো তাতেই খুশি। ছাগলের মাথাটি নিয়ে ফিরলেন বাড়ি।
বাড়ি ফিরে গিন্নিকে বললেন, ছাগলের মাথাটি ভালো করে রান্না করতে আর রুটি তৈরী করতে। অন্য খাতকের বাড়ি থেকে একই ভাবে এনে দিলেন আটা, জ্বালানী প্রভৃতি। রান্না হলো। খেতে বসলেন সুদ ব্যবসায়ী। এমন সময় দ্বারে হাঁক দিলো ভিখারী। খাবার চাই। রুঢ় ভাষায় ভিখারীকে তাড়িয়ে দিলেন সুদ ব্যবসায়ী। স্পষ্ট জানালেন, এখানে কিছুই পাবে না। অন্যত্র যাও। খাওয়া শুরু করবেন, এমন সময় অদ্ভুত কান্ড। ব্যবসায়ীর গিন্নি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, খাবার পাত্র ভরা শুধু রক্ত আর রক্ত! মাংস গেলো কোথায়? পেয়ালা ভর্তি তাজা রক্ত! ভয়ে ভয়ে স্বামীকে দেখালেন খাবার পেয়ালা। তাজা রক্তে ভর্তি।
অবাক কান্ড। কি থেকে কি হলো? ভাবনার রেখা ফুটে উঠলো সুদ ব্যবসায়ীর কপালে। ভাবতে ভাবতে ভাবান্তর দেখা দিলো ব্যবসায়ীর মনে। হঠাৎ বুঝতে পারলেন তিনি, কেনো তার খাবার রক্তে পরিণত হলো! ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো তাঁর। বুঝতে বাকী রইলো না, এতদিন ধরে সুদের নামে মানুষের রক্ত চুষে খেয়েছেন তিনি। তাই তো আজ তাঁর খাবার পেয়ালায় তাজা রক্ত! এ যে তাঁরই এতদিনের কুকর্মের ফল।
হৃদয়ে জ্বলে উঠলো অনুতাপের আগুন। এতদিনের কুকর্মের অনুতাপ একসাথে পোড়াতে লাগলো তাঁর হৃদয়। প্রচন্ড অনুশোচনা আর এতোদিনের সুদ ব্যবসার প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে ফিরে এলেন আলোর জগতে। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনো সুদ ব্যবসা করবেন না তিনি। প্রতিজ্ঞা করলেন, বাকী জীবনটা কাটাবেন ধর্মের পথে।
পরদিন তিনি ছুটলেন, লোকজনের কাছ থেকে আসল টাকাটা তুলতে। রাস্তায় বেড়োতেই খেলারত একদল ছোট ছেলেরা তাঁকে দেখে বলে উঠলো, ওই দেখ, সুদখোর আসছে। চল, এখান থেকে কেটে পড়ি। নইলে সুদখোরের সংস্পর্শে আমরাও পাপী হয়ে যাবো। দগ্ধ হতে লাগলো ব্যবসায়ীর অনুতপ্ত হৃদয়। লজ্জায় মিশে যেতে লাগলেন মাটির সাথে। নিজেকে নিজে দিতে লাগলেন ধিক্কার। মনে মনে বললেন, আর এ পথে নয়। খাতকের পথে আর গেলেন না তিনি। পথ পরিবর্তন করে চলতে লাগলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী সাধক এবং যুগের ধর্মনেতা হযরত খাজা হাসান বসরী (রা) এর দরবারের দিকে। অনুতপ্ত হৃদয়ে কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন তিনি। আর্জি জানালেন তাওবা পড়ানোর।
খাজা হাসান বসরী (রা) তওবা করালেন ব্যবসায়ী কে। দিলেন মূল্যবান কিছু উপদেশ। ধর্ম পথের নির্দেশনা। ব্যবসায়ী ফিরে এলেন নিজ বাড়িতে। শুরু করলেন তাঁর ধর্মজীবন। কঠোর সাধনা। লোকজনের সকল লেনাদেনা মওকুফ করে দিলেন তিনি। একনিষ্ঠ মনে শুরু করলেন ধ্যান সাধনা। শহরসুদ্ধ লোক তো অবাক!
ধীরে ধীরে সাধনায় উন্নতি ঘটলো ব্যবসায়ীর। অন্তরে প্রকাশিত হলো প্রভূর নূরের কিরণ। পরিণত হলেন মহাতাপসে। সর্বক্ষণ নিমগ্ন থাকে প্রভূর উপাসনায়। সংসারাশক্তি আর বিন্দুমাত্রও রইলো না মনে। আল্লাহপ্রাপ্তির পথে উৎসর্গ করলেন নিজেকে। পরবর্তীতে খোদাপ্রাপ্তির পথ দেখালেন অসংখ্য পথিককে। খাজা হাসান বসরী আল আনসারী (রা) এর গুপ্তজ্ঞানের ফল্গুধারায় অভিষিক্ত হয়ে নিজেকে পরিণত করলেন আর এক মহীরুহে। তাঁর সিলসিলা থেকেই পরবর্তীতে জগতে প্রকাশিত হলো অন্যতম তরিকা “কাদরীয়া”।
তিনিই বিখ্যাত আউলিয়া হযরত খাজা হাবীব আজমী (র)।
ইরানের আজম নামক এলাকার লোক ছিলেন বলে তাঁকে আজমী বলা হয়। ফোরাত নদীর কূলে বাস করতেন তিনি। দ্বীনে মোহাম্মদীর প্রকৃত জ্ঞানালোক মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি জীবনভর। হযরত খাজা হাবীব আজমীর সিলসিলা হতেই পরবর্তীতে জগতকে নূরানী আলোয় আলোকিত করেন খাজা বায়েজিদ বোস্তামী (র), খাজা জুনায়েদ বাগদাদী (র), বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানী (র) সহ অসংখ্য অলী আউলীয়া।
রচনাকাল – 07/07/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী