জীবনী – জালালউদ্দিন রুমী : আধ্যাত্মিকতার প্রবাদ পুরুষ

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

হৃদয়ের ভাষায় কথা বলতেন যিনি –

হৃদয়ের আলো দিয়ে আকাশ কে ছুঁতে পারা এক অমর কবি জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমী (Rumi)। চেতনার আরশীতে যিনি আপনার শাশ্বত রুপ অবলোকন করে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়, তিনি মাওলানা রুমী। সুফিবাদ তথা ইসলামী আধ্যাত্মবাদকে যিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যের পাতায় পাতায়, তিনিই জালালউদ্দিন রুমী।

হৃদয়ে পরম সত্ত্বার মহত্তর উপলদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে নিজে বার বার ছাড়িয়ে গেছেন মাওলানা রুমী। আপন খবরের আজকের আয়োজনে থাকছে পার্সী সাহিত্যের অমর কবি ও আধ্যাত্মবাদের অমর কন্ঠস্বর রুমীর জীবন দর্শন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা।

জন্ম –

বর্তমান আফগানিস্তানের বলখ শহরে (খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য) ফার্সী ভাষী পিতামাতার ঘরে জন্ম নেন মাওলানা রুমী। তার জন্মভূমি টি ছিল বালখ্ সাম্রাজ্যের বালখ্স নদীর তীরে যার বর্তমান নাম তাজাকিস্তান। বলখে ৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭ সালে জন্মগ্রহন করেন তিনি।

নাম ও উপাধি –

তাঁর পুরো নাম জালালউদ্দিন মুহাম্মদ বলখী বা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমী। ইংরেজীতে তিনি পরিচিত রুমী (rumi) নামে। তাকে মাওলানা রুমী, মৌলভী রুমী বা আল্লামা রুমী নামেও ডাকা হয়। তিনি মোল্লা-ই-রুম নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।

শিক্ষাগ্রহণ –

জালালউদ্দিন রুমী ছোটবেলা থেকেই অনন্য মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ধর্মশাস্ত্রবিদ এবং গবেষক। পন্ডিত পিতার তত্ত্বাবধানে তিনি ছোটবেলা থেকেই ধর্মশাস্ত্রে ও ধর্মের বিবিধ বিষয়ে বিশদ জ্ঞান অর্জন করেন। রুমীর জীবনে রুমীর পিতা ছাড়াও সবচাইতে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন সুফি দর্শনের অমর দুই ব্যক্তিত্ব ও যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়া ও কবি ফরিদুদ্দিন আত্তার এবং হাকিম সানায়ী ।

জীবন যাপন –

রুম সালতানাত এর পারস্যে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। যখন মোঙ্গল রা মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে তখন রুমীর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ তাঁর পুরো পরিবার এবং একদল শিষ্য নিয়ে পশ্চিমাভিমূখে রওনা হন। তারা নিশাপুর হয়ে বাগদাদ যান। তারপর দামেষ্ক, মালাত্যেয়া, এরজিকান, শিবাস, কায়সেরী ও নিগদি পাড়ি দেন।

আত্তারের সাথে সাক্ষাৎ –

নিশাপুরে ‍রুমীর সাক্ষাৎ হয় বিখ্যাত আউলিয়া ও লেখক ফরীদুদ্দিন আত্তার এর সাথে। যিনি রুমীর সম্বন্ধে ভবিষদ্বানী করেন এবং রুমীকে তাঁর রচিত ‘আসরারনামা’ বইটি উপহার দেন। কারামানে রুমী গওহার খাতুন এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দুটি সন্তান হয় তাদের। সুলতান ওয়ালাদ এবং আলাউদ্দিন চালাবী। প্রথম স্ত্রী মারা গেলে রুমী দ্বিতীয় বিবাহ করেন এবং পুত্র আলিম চালাবী এবং কন্যা মালাখী খাতুনের জন্ম হয়। ১২২৮ সালে আনাতোলিয়ার শাসক কায়কোবাদের আমন্ত্রণে রুম সালতানাতের পশ্চিমাঞ্চল কোনিয়াতে তারা স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন।

শামস তাবরীজির সাথে সাক্ষাৎ –

মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী তৎকালীন ধর্মীয় জ্ঞানে গুণে অদ্বিতীয় রুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি কোনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুরু হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। সেখানকার সহস্র ছাত্র তার নিকট থেকে ইলমে শরিয়ত শিক্ষা নিচ্ছিল। ধর্মীয় বাহ্যিক বিদ্যা বা পুঁথিগত বিদ্যায় তিনি সকলের সম্মান অর্জন করে দোর্দন্ড প্রতাপে রাজত্ব করছিলেন কোনিয়ার জ্ঞান জগতে।

রুমীর চিরাচরিত এ জীবনকে একদম উলটপালট করে দেয় শামস তাবরীজির আগমন। শামস তাবরীজ হলেন রহস্যময় এক ওলী, ‍দিনি তাবরীজির সূর্য নামে খ্যাত। ইলমে মারিফতে অপার পারদর্শীতা তাকে যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়ায় পরিণত করেছিল। তবুও শান্তি ছিল না তাঁর মনে।

সারা জীবন তিনি পথে পথে খুঁজে ফিরেছেন সেই অজানা ব্যক্তিকে, যার কাছে শামস উজার করে দিবেন তাঁর সারাজীবনের অর্জিত সব জ্ঞান রহস্য। কে সে প্রেমিক? যিনি ধারণ করবেন শামসের অন্তর্জগতে বিরাজিত অমূল্য সব মণি মাণিক্যের বহর? সেই অজানা প্রেমিকের উদ্দেশ্যে তিনি সারাজিবন পথে পথে ঘুরে কাটান।

অবশেষে একদিন দৈববাণী শুনতে পান তিনি। অদৃশ্যের কণ্ঠস্বর তাকে বলছে, “শামস, কোনিয়ায় চলে যাও। সেখানে তোমার কাঙ্খিত প্রেমাস্পদ বিরাজ করছেন।” মুহুর্ত মাত্র বিলম্ব না করে শামস রওয়ানা হলেন কোনিয়ায় পানে।

মিলিত হলো চন্দ্র এবং সূর্য। শামসের পরশে শাস্ত্রবিদ রুমী ধীরে ধীরে পরিণত হলেন প্রেমিক রুমীতে।

আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে –

শামস তাবরীজের সাথে দীর্ঘকাল ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ করেন রুমী। ভ্রমন করেন আত্মার অমর প্রেমের ধামসমুহে। আহরণ করেন ধর্মজগতের সকল রত্ন। পরিণত হন খাঁটি প্রেমিকে। পূর্বের শরিয়তের আলেম রুমী এবং গীত বাদ্যের তালে তালে নৃত্ত করতে থাকেন এবং উপলব্ধি করতে থাকেন স্রষ্টার প্রেম রহস্য কে।

শামস কে হারানো –

শামস তাবরীজির সংস্পর্শে প্রথিতযশা আলেম রুমী পরিণত হলেন পাগলপ্রায় প্রেমিক দরবেশে। পরিবারের কিছু সদস্য সহ তৎকালীন সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিষয়টা খুব সহজভাবে মেনে নিতে পারলেন না। শামসকে দোষারোপ করতে লাগলেন সবাই।

কোনিয়া থেকে চলে গেলেন শামস। উতলা, পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন রুমী। জীবননাশের আশংঙ্কা দেখা দিলো। পুত্র সুলতান ওয়ালাদ দামেষ্ক থেকে খুঁজে নিয়ে এলেন শামসকে। আবার শুরু হলো গুর ভক্তের প্রেমলীলা। নির্জনে তারা বিচরণ করতে লাগলেন মারিফতের অনন্ত সমুদ্রে।

ফের ক্ষেপে উঠলো সমাজ। রুমীর এক পুত্রও যোগ দিলেন তাদের সাথে। রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হলো শামস তাবরীজকে।

মণি হারা ফণীর মতো উন্মাদ হয়ে গেলেন রুমী। পথে পথে আকুল হয়ে কেঁদে বেড়ান তিনি। একসময় হৃদয়ে উন্মোচিত হয় ঐশী রহস্যের ফোঁয়াড়া। অনুভূত হয় শামস সত্ত্বার জ্যোতির্ময় উপস্থিতি। বলে উঠেন,

“আমি কেনো তাঁকে খুজবো?
সে আর আমি তো এক জনই!
তাঁর অস্তিত্ব তো বিরাজ করে আমারই মাঝে
আমি নিজেকেই নিজে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

লেখালেখির সূচনা –

শামস তাবরীজের বিরহজনিত বেদনা থেকেই মূলত উৎসারিত হয় রুমীর লেখালেখি। প্রিয় শিষ্য হুসামুদ্দিনের অনুপ্রেরণায় শুরু করেন মসনবী রচনা। মসনবী ফার্সী সাহিত্যের শুধু নয়, বিশ্ব সাহিত্যের সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। যাকে ফার্সী ভাষায় ২য় কোরান বলে অভিহিত করা হয়।

অবদান –

রুমীর অবদান মূলত কাব্য সাহিত্যে। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই চতুষ্পদি কাব্যসাহিত্য ও গজল। তাছাড়া আছে কিছু পত্রাবলীল সংকলন।

আধ্যাত্ম চেতনা –

গভীর আধ্যত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। ধর্মীয় ভাববাদ কে প্রসারিত করতে তাঁর অবদান ছিল সর্বোচ্চ। মরমী পথ পরিক্রমণে তার দেশনাবলী সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক।

পরিশেষ –

আধ্যাত্মজগতের উজ্জল নক্ষত্র মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী রহস্য জগতের দিক নির্দেশক হয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। ১২৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর রুম সালতানাতের কোনিয়াতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কোনিয়াতেই তাঁর রওজা মুবারক অবস্থিত।

রচনাকাল – 10/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর