লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
ধর্মজগতে একজন মানুষ যখন গুরুমুখী আত্মসাধনার মাধ্যমে আত্মপরিচয় লাভ করে মাকামে মাহমুদায় স্থিত হন, তখন তাকে আমরা মুমিন বা ওলী বলে থাকি। যিনি জগতে খোদায়ী কর্তৃত্ব প্রকাশের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর মাধ্যমেই জগতে খোদায়ী রহমত বন্টন করা হয়। তিনিই স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত “খলিফা”।
একজন আল্লাহর ওলী তথা মুমিনকে কিভাবে চেনা যাবে? উপমহাদেশের তাসাউফ শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাতা, সুফিতত্ত্বের একনিষ্ঠ প্রচারক, শ্রেষ্ঠতম সুফিবাদী লেখক, ঝাউগড়া বেনজীরিয়া চিশতীয়া দরবার শরীফের মহান মুর্শিদ কেবলা হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী মুমিন তথা ওলীর পরিচয় বর্ণনা করেছেন তাঁর একটি কালামে। তিনি বলেছেন, “যিনি খোদাকে দেখেন, খোদার পাকজাতে বাস করেন, খোদার কালাম শুনেন, খোদার কথা বলেন, তিনিই মুমিন, ওলী।”
উল্লিখিত বাণীতে আমরা ওলীর চারটি পরিচয় জানতে পেলাম।
১. যিনি খোদাকে দেখেন
২. যিনি খোদার পাকজাতে বাস করেন
৩. যিনি খোদার কালাম শোনেন
৪. যিনি খোদার কথা বলেন
আলোচনাটির মূল অনেক গভীরে প্রোথিত। যা মূলত মানুষ ও খোদার অখন্ডতা তথা মানুষে খোদার চিরকালীন প্রবাহমানতার প্রকাশক এবং খোদার মানুষময়তার বর্ণনা। আমি সেদিকে আলোচনা প্রলম্বিত না করে সংক্ষেপে বাণীটির একটা দালিলিক কাঠামো তৈরীর চেষ্টা করবো মাত্র।
১ – খোদাকে দেখা
প্রভু দর্শন ব্যতীত ইনছান হওয়া সম্ভব নয়। খোদাকে দেখে খোদায়ী স্বানিধ্যে থেকে খোদায়ী গুণে বিভূষিত হওয়ার নামই ইসলাম। ধর্মের মূল আলোচ্য বিষয়টিই হল খোদাকে পূর্ণরূপে জানা, দেখা ও খোদাকে অন্তর্বাহ্যে ধারণ করা। সকল ইবাদতের মূল বিষয়ও এটি। সালাতের পূর্বশর্ত খোদাকে দেখা। দর্শনশূণ্য নামাজীকে হুশিয়ার করা হয়েছে খোদ কোরানে (সুরা মাউন)। যারা খোদাকে দেখে নি তারা পরকালে অন্ধ হবে মর্মে আয়াত নাযিল হয়েছে কোরআনে (সুরা বণী ইসরাইল)। খোদাকে দেখেই মানুষ খোদাময় হয়। খোদার প্রতিনিধি হয়। খোদার দর্শন অস্বীকার কারীরা হাকিকত শূণ্য এক আজগুবি অসার ধর্মবিধানের বেড়াজালে বন্দী।
খোদা দর্শন প্রসঙ্গে কিছু দলিল – দুনিয়াতে যে অন্ধ থাকবে সে পরকালেও অন্ধ হবে (সুরা বনী ইসরাইল 72)। আল্লাহপাক মুসা (আ) কে বলছেন, তুমি আমাকে দেখতে পাবে যদি পাহাড় তার স্বস্থানে অটল থাকে। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, দেখা যাবে, যদি পাহাড়টি স্থির থাকে ( সুরা আরাফ 143)। আরো আয়াত – সুরা আল কিয়ামাহ 22, 23, সুরা ইউনুস আয়াত 26, সুরা কাহাফ আয়াত 110, সুরা কাফ আয়াত 35, সুরা মুতাফফিফিন আয়াত 15। রাসুলুল্লাহ (সা) খোদাকে দেখেছেন – দারে কুতনী হাদীস নং 286, 287, 227, তিরমিযি হাদিস নং 3233, 3234, 3235, সুনানে কুবরা লিন-নাসায়ী হাদিস নং 11473, মুজামুল আওসাত হাদিস নং 5761, মুসলিম শরীফ 177, মাকতুবাতুস সাদী
২ – খোদার পাকজাতে বাস করা
সমগ্র জগতটাই খোদার জাতপাকের স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ। মহান রাব্বুল আলামিনের গুণ-বস্তু সহযোগে সামগ্রিক একটা বিবর্তনের ক্রম-প্রকাশিত রূপটিই এ সমগ্র জাহান। খোদার অস্তিত্বই জগতের একমাত্র অস্তিত্ব। জগতের সকল প্রাণ সেই সুমহান অস্তিত্বের মধ্যেই জিবন্ত। অজ্ঞানতা বশত কেউ কেউ সেই শাশ্বত অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বসে। একজন মুমিন মূলত তাঁর সচেতন চিত্তবৃত্তিতে সর্বদাই খোদার পাকজাতের মধ্যে বাস করেন।
খোদার পাকজাতে বাস প্রসঙ্গে কিছু দলিল – সুরা বাকারা 255, সুরা জারিয়াত 20, 21, সুরা যুমার 67, সুরা আর রহমান 26, 27, সুরা হাদীদ 4, সুরা ক্বাফ 16, সুরা ওয়াক্বিয়াহ 85, সুরা রুম 30। আরো বহু আয়াত দ্বারা প্রমানিত যে, যারা খোদার পাকজাতে বাস করে না, তারা হালাক হবে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
৩ – খোদার কালাম শোনা
খোদা লওহ মাহফুজ থেকে নিরবচ্ছিন্ন পবিত্র কালামের ফোয়াড়া জারি রেখেছেন মুমিনদের জন্য, ওলীদের জন্য। প্রভু স্বয়ং ইনছানকে তাঁর কালাম শিক্ষা দেন (সুরা রহমান)। প্রভুর নিকট থেকেই প্রভুর কালাম শ্রবণ করেই একজন মানুষ হয়ে ওঠেন মুমিন, ওলী।
খোদার কালাম শোনা প্রসঙ্গে কিছু দলিল – সমগ্র কোরান টাই খোদার কালাম যা না শুনলে, না মানলে কখনোই মানুষ হওয়া যাবে না। ধর্মের পূর্বশর্তই হলো খোদার কালাম কে শোনা, মানা, জানা। সুরা বাকারা 2, সুরা আনআম 155, সুরা আল ইমরান 138, সুরা যুখরফ 44, সুরা আলাক 1, সুরা মুযাম্মিল 20, সুরা বণী ইসরাইল 78, 82, সুরা আনফাল 2, সুরা আরাফ 2, 204, সুরা নাহল 89, সুরা যুমার 18, সুরা জিন 1, 2, সুরা আহকাফ 29, 30, সুরা মায়িদা 83, সুরা ক্বাফ 37।
৪ – খোদার কথা বলা
যখন একজন মানুষ তার আপনত্বে বিরাজিত অনন্ত মহিমাকে জাগ্রত করে মুমিনে পরিণত হয়, তখন সে হয়ে ওঠে স্বয়ং মূর্তমান খোদা। সে মানুষটির হাত হয় প্রভূর হাত যা দ্বারা ধরে, সে মানুষটির পা হয় প্রভুর পা যা দ্বারা সে চলে, সে মানুষের মুখ হয় প্রভুর মুখ যা দ্বারা সে বলে (বুখারী)। একজন মুমিন তো জগতের জন্য খোদার রহমত। তাঁর মুখে সর্বদা উচ্চারিত হয় খোদার সুমহান কালাম। যে কালাম শ্রবণে মানুষের চোখের অজ্ঞানান্ধকার কেটে গিয়ে আলোর ফোয়াড়া তথা সিরাতাল মুস্তাকীম জারী হয়। সে মহামানব সর্বদা খোদায়ী প্রেমে নিমজ্জিত থেকে আপন জবানে খোদার কথা বলতে থাকে। তারাই মূলত জগতের বুকে খোদার প্রতিনিধি। তাদের দ্বারাই যুগে যুগে আবাদ হয় এ ভ্রমান্ড।
খোদার কথা বলা প্রসঙ্গে কিছু দলিল – সুরা আল ইমরান 104, 110, 187, সুরা নাহল 43, 125, সুরা আম্বিয়া 7, সুরা হামিম সাজদা 33, 34, সুরা ইউসুফ 108, বুখারি হাদিস নং 3461, সুরা মায়েদা 19, 67, সুরা বালাদ 17, সুরা তওবা 71, সুরা নিসা 165, সুরা আহযাব 39।
মূলত সমগ্র কোরআনের প্রতিটি বাণীতে সেই মানুষের কথাই বলা হয়েছে যে মানুষটি খোদাকে দেখে, খোদার পাকজাতে বাস করে, খোদার কালাম শোনে, খোদার কথা বলে। সেই মানুষের আনুগত্য এতায়াতেই পালিত হবে ধর্ম। অপেক্ষাকৃত দূর্বল ঈমান যাদের, তাদের জন্যই মূলত সামান্য কয়েকটি কোরানিক বাণী বা হাদিসের প্রমাণ উপস্থাপন করা হলো।
একজন ওলী জগতের জন্য সর্বোচ্চ নিয়ামত। যার মাধ্যমেই খোদা তায়ালা বিশুষ্ক ধরিত্রীর বুকে রহমতের তথা খোদাজ্ঞানের অমৃত সিঞ্চন করে থাকেন। তাই যুগে যুগে ধর্মজগত পরিচালিত হয় ওলী-মুর্শিদদের দ্বারা। তারাই ধর্মের ধারক ও বাহক। তাদের চরণ পরশেই তাপিত হৃদয়ে বেজে ওঠে হেদায়াতের সঞ্জীবনী সুর। প্রভু আমাদেরকে তাঁর অনন্ত রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দিক।
জয় হোক মহাসত্যের।
রচনাকাল – 28/08/2023
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী