প্রবন্ধ – ফুযায়েল ইবনে আয়াজ (র) এর পবিত্র জীবনী

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

“ মরুভূমির দস্যু সর্দার থেকে যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়ায় পরিণত হওয়ার ঘটনা “

মরুভূমির বুকে একদল দস্যু। তাদের কাজই হলো মরুর পথে চলমান কাফেলায় আতর্কিত হামলা চালিয়ে লুট করা। কাফেলার অপেক্ষা করছে তারা। এগিয়ে আসছে কাফেলা। বাণিজ্য কাফেলা। ডাকাতদলের কাছাকাছি আসতেই দস্যুরা আক্রমণ চালালো কাফেলায়। সকলের সমস্ত ধন সম্পদ সব লুট করে নিলো তারা।

কাফেলার এক বণিকের সঙ্গে ছিল প্রচুর টাকাপয়সা। সে পালানোর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে নিজের অর্থ সম্পদ বাঁচানোর জন্য অদূরে দৃশ্যমান একটি তাঁবুতে গিয়ে প্রবেশ করলো। সেখানে সে দেখতে পেলো, জবরদস্ত এক সাধু বসে উপাসনা করছে। জিকিরে মগ্ন সে। বণিক লোকটি সেই সাধুর কাছে তার অর্থ সম্পদ গচ্ছিত রাখতে অনুরোধ করে। সাধু টাকাগুলো তাঁবুর এক কোণে রেখে যাওয়ার জন্য বলে তাকে।

লুটতরাজ শেষ হলে বণিক লোকটি ফিরে আসে দরবেশের তাঁবুতে। গচ্ছিত রাখা টাকাগুলো ফেরত নিতে। এসে যা দেখে তাতে বণিকের চক্ষু চড়কগাছ! সব ডাকাতরা সেই তাঁবুতে বসে লুট করা অর্থ সম্পদ ভাগাভাগি করছে। আর তখনকার ইবাদতকারী সাধু ব্যক্তিটিই হলো ঐ ডাকাতদলের সর্দার!

অনুশোচনার অন্ত রইলো না বণিকের! স্বয়ং ডাকাতের হাতে তুলে দিলেন নিজের সকল ধন! এমন সময় বণিককে দেখে ফেললেন ডাকাত দলের সর্দার। সহজভাবে বললেন, ঐযে আপনার টাকা। নিয়ে যান। ডাকাত সর্দার অন্যান্য ডাকাতদের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার জন্য বললেন, ‘ব্যক্তিটি আমাকে নির্ভরশীল মনে করেছিল, যেমন আমি আল্লাহকে নির্ভরশীল মনে করি। আমি তাঁর ধারনাকে সত্য প্রমাণিত করলাম। আশা করি, আল্লাহও আমার ধারণাকে সত্য প্রমানিত করবেন।’

বণিক লোকটির বিষ্ময়ের অন্ত রইলো না। এ যেন একই সাথে এক দরবেশ এবং ডাকাত! কি করে সম্ভব!

কিছু দিন পর, আরো এক বাণিজ্য কাফেলা যাচ্ছে মরুর পথ ধরে। সেই ডাকাতদলের ভয়ে প্রচন্ড ভীত কাফেলাটি ধীর পায়ে এগোচ্ছে ডাকাতদলের ভয়ংঙ্কর স্থানটি দিয়ে। কাফেলায় ছিল একজন সুললিত কন্ঠধারী কোরআনের হাফেজ। তিনি শুরু করলেন পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত। ডাকাতদল নিকটবর্তী। ডাকাতদের কানে পৌঁছালো কোরআনের হাফেজের মর্মভেদী কোরআন তেলাওয়াত। হাফেজ পাঠ করছেন, “এখনো কি আল্লাহর স্বরণ দ্বারা বিশ্বাসীদের হৃদয় সমূহ ভীত ও জাগরিত করার সময় আসে নি?” কোরআনের শ্লোকটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র কেঁপে উঠলো ডাকাত সর্দারের অন্তরাত্মা। কম্পিত হলো তার সর্ব অস্তিত্ব! হৃদয় মন প্রাণ ব্যাপি বয়ে গেলো খোদাভীতির এক তীব্র আলোর ঝলকানি! অস্তিত্বে প্রবাহিত হলো আধ্যাত্মিক জীবনের এক অমীয় মধুর আবেশ। বদলে গেলেন তিনি। সম্পূর্ণ ভাবে।

বিষ্ময়কর এ মহাতাপস ব্যক্তিটিই হলেন হযরত খাজা ফুযায়েল ইবনে আয়াজ।  ইলমে তাসাউফের এক সুমহান মুর্শিদ ছিলেন তিনি। বহুল প্রচলিত ও পরিচিত ‘চিশতীয়া’ তরিকার ছিলছিলার উর্দ্ধতন অলী ছিলেন তিনি। পরিশুদ্ধ খোদাপ্রেম, ইলমে তাসাউফ এর উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। দ্বীনে মোহাম্মদীর প্রকৃত শিক্ষা, মাওলা আলী (আ) এর বেলায়েত এর ধারক বাহক ছিলেন তিনি। আউলিয়াকূল তিলক হযরত খাজা হাসান বসরী (রা) এর অন্যতম মুরীদ ও খলিফা হযরত খাজা ওয়াহেদ বিন জায়েদ (র) এর ভক্ত ‍মুরীদ ছিলেন তিনি। ইলমে মারেফতের কূলহীন সমুদ্রের এক দক্ষ নাবিক রুপে সারাজীবন মানুষকে বিলিয়ে গেছেন উত্তোলিত মণি মাণিক্য।

দস্যু জীবন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে তিনি শুরু করলেন ধর্মপথে ধাবমান এক দরবেশী জীবন যাপন। চলে গেলেন মক্কায়। আধ্যাত্মিক জীবন সাধনায় অতিবাহিত হতে লাগলো তাঁর দিন। মহাজীবনের সাধনায় নিজেকে উন্নীত করলেন মহাতাপস রুপে। আলোর জগত কায়েম করলেন নিজের চারপাশে। পূর্ব কৃত অপরাধের অনুশোচনায় তিনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন সকলের কাছ থেকে। আলোর অভিসারে পূর্ণরুপে শামিল করলেন নিজেকে।

আলোর লোভে আলোকপিয়াসীরা দলে দলে ভীড় করতে লাগলো ফুযায়েল ইবনে আয়াজ (র) এর চারপাশে। মহাতাপস হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠলেন তিনি। তৎকালীন স্বয়ং বাদশাহগণ পর্যন্ত তাঁর ‍মূল্যবান উপদেশ শ্রবণের জন্য লালায়িত ছিলেন। বাদশাহ হারুন অর রশিদ উপদেশ গ্রহণ করতে হযরত খাজা ফুযায়েল ইবনে আয়াজ (র) এর দরবারে পর্যন্ত যেতেন।

মহাপ্রভুর প্রেমে জগত সংসারের মোহমায়া, লোভ ও সংসারাশক্তি সম্পূর্ণরুপে বলি দিয়েছিলেন তিনি। আল্লাহপ্রেমে বিভোর থাকতেন সবসময়।

মহাসাধক হযরত খাজা ফুযায়েল ইবনে আয়াজ মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান রেখে প্রভু স্বানিধ্যে গমন করেন। এই মহাতাপসের জ্ঞানালোক জগতে বহমান থাকবে চিরকাল, প্রভু প্রেমিকদের হৃদয়ে হৃদয়ে।

রচনাকাল – 12/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর