লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
রাত্র গভীর। পৃথীবি নিশা যাপন করছে নিশ্ছিদ্র ঘুমে। মহাপ্রতাপশালী এক বাদশাহ এর জমকালো রাজ দরবার। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। জেগে আছে শুধু স্বয়ং বাদশাহ্। হেরেমে হাতির দাতের পালংকের স্নিগ্ধ-সুকোমল বিছানায় জেগে আছেন তিনি। উপাসনা করছেন। আল্লাহর প্রতি পরম আকুলতায় দীর্ঘদিন যাবত তনুমন নত হয়ে আসছে তাঁর । সর্ব অন্তকরণে লাভ করতে চাইছেন আল্লাহকে। কিছুতেই যেনো শান্তি পাচ্ছেন না। তাইতো এ গভীর নিশার প্রার্থনা!
এমন সময় শাহী প্রাসাদের ছাদের ওপর শোনা গেলো কার যেনো ত্রস্ত পায়ে ধুপধাপ আওয়াজ। এতো রাতে তো ছাদে কারো থাকার কথা নয়!
কে? কে ওখানে? জিজ্ঞেস করলেন বাদশাহ।
আমার উট হারিয়ে গেছে! তাই উটটিকে খুঁজছি। জবাব এলো।
ধমকিয়ে উঠলেন বাদশাহ – মূর্খ কোথাকার! প্রাসাদের ছাদে কখনো উট থাকে নাকি?
জবাব এলো ছাদ থেকে, “প্রকৃত মূর্খ তো তুমি বাদশাহ! ছাদে যেমন উট থাকে না, তেমনি তোমার বিত্ত বৈভব বেষ্টিত জমকালো রাজপ্রাসাদের হেরেমে সূবর্ণখচিত হাতির দাতের পালঙ্কের কোমল বিছানাতেও আল্লাহ থাকে না।”
প্রবল তোলপাড় খেলে যায় বাদশা‘র চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাইতো, এতো বিলাস-বিত্তের মধ্যে কি করে আমি পরম প্রভু কে লাভ করবো? বাকী রাত নির্ঘুম কাটে বাদশাহর।
রাজদরবারে বসে আছেন বাদশাহ। সান্ত্র-মন্ত্রী পাত্রমিত্র পরিবেষ্টিত দরবার। হঠাৎ কোত্থেকে এক মহাতেজস্বী সুপুরুষ নির্ভিক পদচারণে প্রবেশ করলেন রাজদরবারে। সোজা গিয়ে দাড়ালেন বাদশাহ এর সম্মুখে। প্রশ্ন করলেন বাদশাহকে,
এখানে আপনার আগে কে বাস করতো?
আমার পিতা। জবাব দিলেন বাদশাহ।
তার আগে?
পিতামহ।
তার আগে?
প্রপিতামহ।
তারা আজ কোথায়?
কেউ নেই।
এই পৃথিবী, এই বিত্ত বৈভব, এই রাজদরবার আসলে কারো নয়। সবাই আসে, ক্ষণকাল পর চলে যায়। আপনিও এসব ছেড়ে একদিন চলে যাবেন, বাদশাহ!
প্রবল ঝড়ে তছনছ করে দেয় বাদশাহর হৃদয়। চলে যায় আগন্তুক। দাবানল জ্বেলে দিয়ে যায় বাদশাহর এর ভিতরে বাহিরে। ধর্মপথের তৃষ্ণা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে বাদশাহ এর অন্তকরণ।
জঙ্গলে শিকার করতে যেযে দলছুট হলেন বাদশাহ। একাকী জঙ্গলে শুনতে পেলেন এক গুরুগম্ভীর আহ্বান। “সাবধান হও বাদশাহ, মৃত্যু আসার পূর্বেই জেগে ওঠো।”
ভেস্তে যায় বাদশাহ এর ভিতর বাহিরের সমস্ত দেয়াল। দুচোখ বেয়ে নেমে আসে তপ্ত অশ্রুর বিগলিত স্রোত! অন্তকরণে বাজতে থাকে প্রভুর আহ্বান! জেগে ওঠো! ফিরে আসো!
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেন না বাদশাহ। মুহুর্তের করুণাবারির ঢল এসে ভাসিয়ে দেয় বাদশাহর অস্তিত্বকে। বাদশাহও পরম ভক্তিভরে নিজেকে শামিল করেন সে অনাদী কালের শ্বাশত স্রোতে। সোনার অঙ্গ থেকে খুলে ফেলেন সকল রাজকীয় পোষাক। খুলে ফেলেন সকল অলংকার। গায়ে জড়িয়ে নেন রাখালের বেশ। চটের ছালা। বিদায় জানান রাজত্ব, প্রাসাদ, বিত্ত, বৈভব, বিলাস বাসনা আর অতীত জীবনকে। আর বাদশাহী নয়, আর তখত-ই-তাউস নয়, এবার ধ্যানমৌন সন্ন্যাসীর জীবন। আল্লাহ প্রাপ্তির পথে ধাবমান এক তাগী দরবেশী জীবন। দীনাতিদীন ফকিরের জীবন।
বাদশাহ ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (র)। বলখ সাম্রাজ্যের সুমহান অধিপতি! নিবিড় নির্জন জঙ্গলে বসে কাটাতে লাগলেন তার তপস্যার শ্বাপদ সংকুল পথে অবিরাম যাত্রা। প্রভুপ্রাপ্তির পথে নিবিড় তপস্যা। ইলমে মারেফতের কঠিন আর দুর্গম পথে অভিযাত্রা। ইলমে তরিকতের গুপ্তজ্ঞানের তালিম লাভ করলেন বিখ্যাত অলী হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়াজ (র) এর নিকট থেকে। অবিরাম সাধনার মধ্য দিয়ে হয়ে উঠলেন এক আলোক বিতরণকারী প্রদীপ্ত জ্যোতির্ধারা।
পরবর্তী জীবনে তিনি মক্কায় চলে যান। গভীর সাধনায় আর ইলমে মারেফতের কূলহীন সমুদ্রে ডুবে কাটাতে থাকেন সময়। মক্কায় তিনি দরবেশী জীবনযাপন করেন। জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। সকল বিসর্জন দিয়ে আল্লাহপ্রেমে ডুবে থাকেন দিনরাত। জগত সংসার তাঁর কাছে তুচ্ছ। সকল মায়া মোহ অতিক্রম করে তিনি সদা পরমের প্রেমে লিপ্ত।
তিনি আর কোনো দিন সংসারে ফেরেন নি। ক্ষুদ্র সংসার ত্যাগ করে সমস্ত জগতটাই হয়ে উঠেছিল তাঁর সংসার। প্রভুর উপাসনা আর শিষ্যদের ধর্মজ্ঞান শিখিয়ে অতিবাহিত করতে থাকেন জীবন। শুদ্ধপ্রেমের প্রেমিক হয়ে স্রষ্টার অপার প্রেমের দরিয়ার ভাসতে থাকেন নিরবধী। সকল কিছুর ই অমুখাপেক্ষী তিনি।
স্ত্রী আর পুত্র বলখ থেকে মক্কায় আসেন তাঁর খোঁজ করতে। সংসারে ফিরিয়ে নিতে। পুত্র মায়াজাল বিস্তার করে পিতাকে টানতে চান সংসারে। প্রভুপ্রেমিক ইব্রাহিম আদহামের কি আর সংসারে মতি আছে। তিনি তো আল্লাহপ্রেমে নিবিষ্টচিত্ত! একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুকের গহীন থেকে। চোখের সামনে ঢলে পড়েন প্রিয় পুত্র। দেখতে দেখতে দেহ থেকে বেড়িয়ে যায় শেষ নিঃশ্বাস! সকল বন্ধন অতিক্রম করে যিনি পরম সত্ত্বার বন্ধনে বেধেছেন নিজের অস্তিত্বকে, তাকে সংসারে বাধার চেষ্টাটাই ধৃষ্টতা।
বাদশাহীর বিনিময়ে দরবেশী খরিদ করে ইব্রাহিম ইবনে আদহাম সামান্য রাজ্যের বাদশাহ থেকে পরিণত হন পরকালের বাদশাহ তে। মারেফত এর সমুদ্রে অনেক বড় নাবিক হয়ে বিলিয়ে বেড়ার মুক্তির অমিয় সুধা। সারাজীবন তাঁর বহু অলৌকিক কীর্তিতে ভরপুর। তরিকতের এক অন্যতম ঝান্ডাবাহক তিনি । তাঁর থেকে জগতে প্রচারিত আছে আদহামিয়া ঘারানা।
শেষ জীবনে পরিপূর্ণ নির্জনতায় ডুবে যান তিনি। তাঁর ওফাত তারিখ বা স্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন তিনি বাগদাদে ওফাত নেন, আবার কেউ বলেন শামদেশে। তরিকতের এক প্রদীপ্ত মশালের প্রজ্জলনকারী বাদশাহ ইব্রাহিম ইবনে আদহাম স্ব মহিমায় চির ভাস্বর হয়ে দীপ্তিমান আছে জগতের ধর্মাকাশে।
রচনাকাল – 16/12/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী