প্রবন্ধ – প্রভুপ্রেম – পরমপ্রাপ্তির একমাত্র উপায়

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

জগতের একমাত্র অস্তিত্বশীল সত্ত্বাই হলো প্রভুসত্ত্বা। প্রভুসত্ত্বা বাদে প্রতিনিয়িত আমরা যা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করি বা প্রত্যক্ষ করি, সবই আমাদের বিকারগ্রস্ত মনের কল্পনাপ্রসূত মিথ্যা আবিষ্কার ব্যতিত অন্য কিছু নয়। সংসারের মোহমায়া আমাদেরকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধে যে, স্বতঃপ্রাপ্ত প্রভুসত্ত্বাকে আমরা পাই না, চিরনিত্য প্রভুসত্ত্বা কে আমরা দেখি না, সদাবর্তমান পরমকে তথা প্রভুপ্রেম কে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। প্রভুগুরুর মহত্ত্ব উপলদ্ধি করতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে মুক্ত হতে হবে সকল জাগতিক বন্ধন থেকে। তবেই আমাদের অনুভবের সীমানায় আসবে সে পরম মহিমান্বিত সত্ত্বা।

আমরা জগত থেকে সারাজীবন যা অর্জন করি, তার সব কিছু থেকেই আমাদের ভোগ করতে হয় বিচ্ছেদের যন্ত্রনা। আমাদের জাগতিক সকল প্রাপ্তিই এক একটা বিচ্ছেদের বার্তা নিয়ে আসে। জগত থেকে আমরা যত অর্জন করি, আমরা তত বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে মরি। কিন্তু পরম সত্ত্বা তো নিত্যপ্রাপ্ত। তাঁকে অর্জন করা যায় না। তিনি সবসময়ই আমাদের ভিতর বাহির পরিবেষ্টন করে আছেন। কখনো আমরা চিরবর্তমান সে মহিমাময় সত্ত্বাটিকে অনুভব করতে পারি, কখনো পারি না। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, পরম সত্ত্বা নিত্যপ্রাপ্ত হওয়ায়, একবার যদি আমরা হৃদয়ের কালিমা দূর করে তাঁর সঙ্গে মিলিত হই, তাহলে তাঁর থেকে আর কখনো আলাদা হতে হবে না। পরমের সঙ্গে কখনো বিচ্ছেদ হবে না। আমাদের ভুল হচ্ছে এটাই যে, আমরা অস্তিত্বকে জাগতিক ভাবে গ্রহণ করে নিয়েছি।

প্রভু প্রাপ্তির পথে সবচাইতে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, প্রভু আপনাকে তাঁর অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবেন। প্রভুর সবচাইতে উদার পুরষ্কার এটিই যে, যদি কেউ তাঁর যথার্থই তাঁর ভক্ত হয়, তবে তিনি সে ভক্ত তে তাঁর অভিভাবক করে নিবেন। আপন অস্তিত্বের সকল মহত্ত্ব কে ফুটিয়ে তুলবেন সেই ভক্তটির মধ্যে। এই উদারতা কেবল প্রভুপ্রেম দ্বারাই সম্ভব।

পরম প্রভু চিরকালে প্রজ্জলিত সূর্য সম দীপ্তিময়। তাই তার উত্থান পতন বা জন্ম মৃত্যু বলে কিছু নেই। শুধু তিনি তাঁর ভক্তের আহ্বানে প্রকট হন মাত্র।

ভগবান চিরন্তন। অভাব কেবল সেই ভক্তের, যে ভক্ত তাঁকে সদা সর্বদা দেখবে। তিনি সদা বর্তমান। অভাব তো তাঁকে গ্রহণ করার মানসিকতার। প্রভু স্থান কাল পাত্রের অতিতে শ্বাশত কালে বিরাজ করেন। মানবীয় অস্তিত্বে তিনি সর্বদা তাঁর রুপ গুণ কে প্রকাশিত ও বিকশিত করে থাকেন। আমরা যদি বিশ্বাসী হই মানবীয় মহত্ত্বে, তবেই আমরা লাভ করতে পারবো সেই নিত্যপ্রাপ্ত পরম সত্ত্বা কে। আর যদি মানুষতত্ত্ব অস্বীকার করে স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়াই বিশ্বময়, নিরাশ হওয়া ব্যতিত পথ থাকবে না।

যখন কাম কামনার মেঘে আচ্ছন্ন হয় আমাদের চেতনা, তখনই আমরা হারিয়ে ফেলি সেই জ্যোর্তিচ্ছটা। যখনই নয়ন থেকে অপসারিত হয় জাগতিকতার পর্দা, তখনই আমাদের নয়নে প্রস্ফুটিত হয় সে অনন্ত মহিমা। প্রভুকে খোঁজা একদম অবান্তর। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে হৃদয় মন হতে সমস্ত জঞ্জাল অপসারন করা। নয়নের পর্দা সমূহ দূরীভূত করা। তবেই সে শ্বাশত অস্তিত্ব তথা প্রভুসত্ত্বা এমনিতেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ভিতর বাহিরে। কারণ ভিতর বাহির তথা সর্ব-অস্তিত্বে একমাত্র তিনিই অস্তিত্বশীল।

যখন আমরা ভগবান লাভ করার জন্য সাধনায় লিপ্ত হই, আমাদের মনে হয়, প্রভু কতদূর! যখন ধীরে ধীরে হৃদয় আলোকিত হয়ে উঠে, হৃদয়ের কালিমা দূর হতে থাকে, ধীরে ধীরে আমার অস্তিত্বে নিকটবর্তী হতে থাকে পরম প্রভু। তারপর আমরা আমাদের অস্তিত্বজুড়ে অনুভব করি প্রভুপ্রেম, অনাদীকালের শ্বাশত মহিমা। তারপর আমরা আমাদের সকল ইন্দ্রিয়ে একমাত্র তাঁকেই লাভ করি। চোখে শুধু তাঁকেই দেখতে থাকি, কানে শুধু তাঁরই মনহারিনী সুর শুনতে থাকি। সর্ব উপলব্ধিতে সেই তখন আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

পরাধীনতার নিগঢ় ভেঙে যখন আমরা মুক্ত হতে পারবো, তখনই আমরা প্রভুর মহিমাকে তথা প্রভুপ্রেম কে অঙ্গে ধারণ করার উপযুক্ত হবো। তিনিতো প্রেমের দায়ে ভক্তের ভক্তির নিকট ওতপ্রোতভাবে বাধা। তিনি সকল পারলেও, ভক্তের বাধন চ্ছিন্ন করতে পারেন না। ভক্তির দ্বারে বাঁধা তিনি। ভগবানে একাত্মতা সে প্রেমকে আরো গভীরতা এনে দেয়। বন্ধনকে করে আরো শক্তিশালী।

আমি তাঁর… এ মহান উপলদ্ধিই পারে সকলকে প্রভু সমীপবর্তী করতে। জগত বিমুখতাই পরম প্রাপ্তির একমাত্র উপায়। একাগ্র প্রেম তথা ভক্তি সাধনার মধ্য দিয়ে লাভ করা যেতে পারে মহাপ্রভুকে।

প্রভুগুরু সকলের সহায় হোক।

রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর