প্রবন্ধ – মানুষ ও মনুষ্যত্ব – মানুষতত্ত্বের সহজ পাঠ

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

মানুষ দর্শন বা মানুষতত্ত্ব পাঠই জগতের সার। জগতের সকল রহস্যাবলীর এক সুশৃঙ্খল ভান্ডার এই মানুষ। জগতের সকল রহস্যের সমাধান এই মানুষ। আপনত্বে জগতের সকল তত্ত্ব কে ধারণ করে এই মানুষ। তাই মানব মহত্ত্ব অনন্ত ও অসীম। এই মানবীয় অস্তিত্বের অভ্যন্তরে মহান মহিমাময় সত্ত্বা জাতপাক রাব্বুল আলামিন প্রকাশ করেন তাঁর অনন্ত সৌন্দর্যকে। তিনি স্বয়ং প্রকাশিত ও বিকশিত হন এই মানুষের হৃদয় কমলে। মানুষ ব্যতিত তাঁর প্রকাশিত হওয়ার অন্য কোনো মাধ্যম নেই।

এই মানুষের ভিতরে অহর্নিশী বিরাজ করেন প্রভু। তিনি মানুষকে পরম মমতায় সৃজন করেছেন নিজেকে প্রকাশ করার মানসে। তাই তো মানুষ তাঁর কাছে এতো মূল্যবান। এতো আদরের। মানুষকে তিনি উপাধি দিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধি। সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করেছেন মানুষকে। করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত। চরমভাবে মানুষ সাপেক্ষ প্রভু মানুষকে কেন্দ্র করেই নিয়ত আবর্তিত হন তাঁর নির্ধারিত মানবসীমায়।

মানব মহত্ত্বের অনুসন্ধানই প্রকৃত ধর্ম। যারা মানুষ মহত্ত্বে অবিশ্বাসী, মানুষ রেখে নিরাকার কোনো কাল্পনিক প্রভুর ইবাদত করে চলেছে, তারা নিরেট গন্ডমূর্খ। মানুষ কে রেখে অনুমানে তথা কল্পনায় স্রষ্টার উপাসনার করার নামই মৌলবাদ। প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবীয় অস্তিত্বে বিরাজিত প্রভুকে খুঁজে বের করা। তাঁর শরণ নেয়া।

সকল মানুষের ভিতরে প্রভু বিরাজ করলেও সকল মানুষের ভিতরে তিনি জাগ্রত নন। বেশিরভাগ মানুষ মানব মহত্ত্বে অবিশ্বাসী হয়ে অস্বীকার করছে মানুষে বিরাজিত প্রভুকে। তারা বৃথা ইবাদত করে চলেছে আকাশে বাস করা কোনো এক কিম্ভুতকিমাকার বা নিরাকার অদৃশ্য সত্ত্বার। প্রভুজ্ঞানে জ্ঞানী হলে তারা দেখতে পেতো, প্রভু আসমানে নয়, মানবের হৃদাকাশে অধিষ্ঠিত।

অপবিত্র মানুষগণ নোংরামির আবরণে ঢেকে রাখে প্রভুকে। অবিশ্বাসের দেয়াল ভেদ করে উদয় হতে দেয় না বিশ্বাসের সূর্য কে। তারাই ধ্বংস পথের যাত্রী। তারাই চলেছে আসফালাস সাফেলিনের পথে। আর যারা দিব্যজ্ঞানী, অদৃশ্য নিরাকার প্রভুর ইবাদত ছেড়ে করছে মানব মহত্ত্বের আরাধনা, তাঁরাই মুক্তির পথের অভিযাত্রী।

যারা সাধনার বলে আপনত্বে বিরাজিত প্রভুকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন, তারাই জ্ঞানী মানুষ। যারা হৃদয়ের দরজা খুলে বাইরে নিয়ে এসেছেন মহিমাময়ের অপূর্ব নূরের কিরণকে, তারাই আল্লাহর ওলী। তাদের ভিতর বাহির তখন প্রভু নূরে নূরান্বিত। তাদের অন্তকরণে সদা বিরাজ করে প্রভুর নূরের স্রোত। আল্লাহর স্বভাবে স্বভাবিত তাঁরা। তাঁরা প্রভুগুণ কে আপনত্বে ধারণ করে নিয়েছেন। প্রভুর স্বভাব আর তাঁদের স্বভাব তখন এক ও অভিন্ন। তখনই তাঁরা প্রভুর প্রতিনিধি। তখন ই তাঁরা অলীআল্লাহ। তখনই তারা মুর্শিদ বা রাসুল। যারা প্রভুগুনে গুণান্বিত হয়ে প্রভুর নাম ধারণ করে পতিত মানুষদেরকে উদ্ধার করে থাকেন।

যে দিব্যজ্ঞানী মানুষটির ভিতর বাহিরে প্রভু বিরাজ করেন, যে নিত্যধামের বাসিন্দা মানুষটি প্রভুর সকল স্বভাবসমূহকে ধারণ করে থাকেন, তখন এই মানুষটিই পরিণত হন প্রভু প্রাপ্তির উছিলায়। প্রভু সন্ধানী যারা, তাদের কর্তব্য হলো এই পবিত্র মানুষটির ইবাদত করা। কারণ, এই মানুষটি তখন প্রভুগুণে গুণান্বিত। প্রভুর এক নাম মুর্শিদ। এই নাম ধারন করে পবিত্র মানুষটি তাঁর ভক্তকূল কে তথা মুসলমানদেরকে ‍উদ্ধার করে থাকেন। যারা এই পবিত্র মানুষের চরণে নিজেকে উৎসর্গ না করে, তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাঁরাই মুক্তিপ্রাপ্ত, যারা পবিত্র মানুষের ভজনার মাধ্যমে নিজের স্বভাবে সেই মহিমান্বিত প্রভুর গুণগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।

মানুষের সেবা করেই মানুষ হওয়া যায়। আমরা তো মনে করি, মানবসুরত ধারী সকলেই মানুষ। আমাদের চিন্তাটি মারাত্মক ভুল। মানবসুরতে আসলে কেউ কেউ মানুষ। যারা সাধনার বলে মানবীয় গুণে তথা প্রভুগুণে গুণান্বিত হয়েছে, শুধু তারাই মানুষ। বাকীরা সবাই মানব সুরতে পশু। সেই পশুরা যদি মানুষের সাধনায় মানুষ হতে পারে তবেই মুক্তি। নচেৎ তাদের আবদ্ধই থাকতে হবে হায়ানাতের দূভের্দ্য কারাগারে। মানুষের সাধনায় মানুষ হওয়াই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা।

মানুষ, মানুষ হয়ে ‍উঠুক। জয় হোক মনুষ্যত্বের। জয়গুরু।

রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর