লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
আমরা স্বভাবত মায়া মোহের জালে আটকে পড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ি সংসারের বিষয় যাতনার মধ্যে। সংসারের কঠিন শৃঙ্খলে জড়িয়ে ফেলি নিজেকে। সংসার কারাগারের দূর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে আর বাইরে আসা হয়ে ওঠে না। আর লাভ করা হয় না মুক্তির স্বাদ। যতক্ষন আমরা সংসারে থাকি ততক্ষন আমরা পরাধীন। আর সংসারের মায়াত্যাগ করে যখনি আমরা আশ্রয় নেই প্রভুর নিকট তথা আত্মসমর্পন করি প্রভুতে, তখনই আমরা লাভ করি স্বাধীনতা।
সাধকের লক্ষন হচ্ছে, সে একমাত্র ভগবান বিনা অন্য কারো আশ্রয় নিবে না। জগতের সকল আশ্রয়ই পরাধীনতা। ভগবানে আশ্রিত হলেই তথা প্রভুতে আত্মসমর্পন করলেই পূর্ণরুপে জানা যাবে ভগবানকে। ধর্মপথের কামিয়াবি হলো একমাত্র প্রভুতে লিপ্ত থাকা। আর প্রভুতে লিপ্ত থাকা সম্ভব হয় প্রভুতে শরণ নেয়ার মাধ্যমে।
জগতের সকল ঝড়-ঝর্ঞ্ঝাট, সকল বাধা বিপত্তি তো জাগতিক মানুষের জন্য। যখনই সাধন নিজেকে অর্পন করে প্রভুর রাতুল চরণে, তখন সে সমর্পিত ভক্তের আর কোনো দুনিয়াবি চিন্তা, দুনিয়ার ভয় বা দুনিয়ার কোনো বিপত্তি থাকে না। কারণ সে ভগবানে সমর্পিত। যে ভগবানে সমর্পিত হয়, সে স্বয়ং ভগবানে অংশ হয়ে যায়। তখনই সে ভগবানের গুণ এবং রূপে সজ্জিত হয়ে সচ্চিদানন্দ ধামে নিত্যকালে বাস করতে থাকে। তখনই সে হয় প্রকৃত পুরুষ তথা মুক্ত শক্তি। সেই সাধক তখন প্রভুবলে বলীয়ান হয়ে জাগতিকতায় আচ্ছন্ন অন্যান্য জীবদের শিক্ষা দেয়।
জগতের আবশ্যিক নিয়মে আমাদের সঙ্গে সদা সর্বদা বিরাজ করে রিপুনিচয় বা প্রবৃত্তি। বেশ কিছু বাজে প্রবৃত্তি আমাদের নিত্যসঙ্গী। যে প্রবৃত্তি বা রিপু গুলো সবসময়ই আমাদেরকে বাজে কাজে প্ররোচনা দেয়। আমাদেরকে প্রভু হতে ফিরায়ে রাখে এবং সদা সর্বদা আমাদেরকে জাগতিকতায় আচ্ছন্ন রাখার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। আমাদের সকল খারাপ ইচ্ছার জন্মদাতা হলো সে রিপুসমূহ। প্রভুপ্রাপ্তির পথে সাধককে সকল ধরনের আপন মনোবৃত্তি পরিত্যাগ করতে হয়। যতক্ষন সাধক চিত্তে আপনাপন ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষন সে হৃদয়ে প্রভুর জ্যোতি বিকশিত হয় না।
যখনই সাধক প্রভুর সমীপবর্তী হওয়ার জন্য আপন ইচ্ছাসমূহকে ত্যাগ করে তখনই প্রভু প্রাপ্তির পথ সুগম হয়ে যায়। নিজ মনোবাঞ্ছা পরিত্যাগ করলেই প্রভুকে লাভ করা সহজ হয়।
আমরা সকলেই কোনো এক সময়ে পরম প্রভুর নিকট ছিলাম। মহৎ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত আমরা এ জগতে পদার্পন করেছি। আমরা পরমপ্রভু অংশ। যদি আমরা জগতে এসে ভুলে যাই আমাদের আদি সেই আশ্রয়কে, সাময়িক সুখে মত্ত হয়ে যদি অস্বীকার করি আমার সেই চিরকালের আশ্রয় কে, এর চাইতে লজ্জার আর কি হতে পারে? আজ অথবা কাল, আমাকে আবার সেই পরম প্রভুর নিকট ফিরে যেতেই হবে। যে আমাদের আদি আশ্রয়, যার কাছে ছিলাম, যার কাছেই যাবো, তার আশ্রয় লাভ কখনোই কঠিন কিছু হতে পারে না।
যে হৃদয় জগতের সকল খারাপ থেকে অবমুক্ত, যে হৃদয়ে জাগতিক আসক্তি নেই, যে হৃদয় ধর্মপথে ব্যাকুল, সে হৃদয়টির জন্য প্রভুতে আশ্রয় লাভ করা একান্তই সহজ।
আমরা জগতে কত রকম কত বস্তুর আশ্রয় নিয়ে থাকি। যা আমাদের নয়, কখনো আমাদের হবে না, তার আশ্রয় নিয়ে কি লাভ? আর যা আমাদের কে ভিতর বাহিরে ঘিরে আছে, যা সর্বদা আমাদেরকে মোহিত করে রাখে, তার আশ্রয় কতই না আনন্দের, কতই না শান্তির!
একদম নিরহঙ্কারী সত্ত্বাটিই প্রভুর আশ্রয় বা শরণ লাভের জন্য একমাত্র উপযুক্ত। ভক্তি বিশ্বাস প্রেম কে সম্বল করে মাধূর্যপূর্ণ বিনয়ী স্বভাবের দ্বারা অতি সহজেই প্রভুর স্বানিধ্য লাভ করা যায়।
প্রভু চিরন্তন, শ্বাশত। অমর। চিরনিত্য। প্রভুতে যে আশ্রয়প্রাপ্ত, সেও অমর, চিরনিত্য। নিত্যের পরশে অনিত্য জীবসত্ত্বাটিও নিত্যে পরিণত হয়। তখনই নশ্বর জীব লাভ করে অবিনশ্বর রূপ। প্রভুর শরণ লাভ করলেই জন্ম মৃত্যুর অধীন জীবসত্ত্বাটি লাভ করে অমর জীবন।
মানুষের একমাত্র বাসনা হওয়া উচিত আত্মসমর্পন এর মাধ্যমে প্রভুতে আশ্রয় ও চির স্থিতি লাভ করা। ভগবান এর শরণ নেয়া। প্রভু আশ্রয়ে বাস করা।
রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী