প্রবন্ধ – অনুরাগ সাধনা র দ্বারা ভগবৎ প্রাপ্তি (সাধনমার্গ)

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

সাধনার মূল কথাটিই হলো অনুরাগ। ভক্ত হৃদয়ে যদি থাকে পূর্ণ অনুরাগ তবে সাধনা আপনা আপনিই হবে। আর অনুরাগ না থাকলে সাধনা জোর করে করতে হয় যা কখনোই ফলপ্রসু হয় না। অনুরাগে সাধনা স্বতঃ হয়। যা নিজ থেকে হয়, তাই আসল। আর যা জোর করে করতে হয়, তা অবশ্যই নকল। আমরা সাধনাও করতে চাই, আবার জাগতিক রিপু সমূহের বন্ধনেও আবদ্ধ থাকতে চাই! কাম কামনা, মোহ, লোভ সহ নানাবিধ জাগতিকতা যতক্ষন আমাদের মধ্যে আছে, ততক্ষন আমাদের প্রভুতে অনুরাগ জাগবে না। অর্থাৎ, জগতের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে যত সাধনাই করা হোক না কেনো, সবই বৃথা। কোনো কাজে দিবে না।

হৃদয়ে প্রভুর প্রতি যদি অনুরাগ থাকে তাহলে প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহুর্তে প্রভুকে মনে পড়বে। জোর করে স্বরণ করতে হবে না। যদি ভগবানকে প্রচেষ্টার দ্বারা স্বরণ করতে হয়, তবে বুঝতে হবে অনুরাগ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান নেই। একমাত্র জাগতিকতা আমাদেরকে অনুরাগ সাধনা তথা প্রভুস্বরণ থেকে দূরে নিয়ে যায়। যা আমাদেরকে প্রভু স্বরণ বা প্রভুর সংযোগ হতে বিচ্যূত করে, তার সবই পরিত্যাজ্য।

প্রকৃত সাধনা সেটাই, যেটা নিরন্তর ঘটতে থাকে। আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার প্রভেদ সাধক যত বুঝতে পারে, সাধনা তাঁর জন্য তত সহজ হয়ে যায়। সাধনা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডীভূত ব্যাপার নয়। এটি চিরন্তন ব্যাপার।

সাধনা তো এমন যে, যতক্ষন আমরা ভগবানের সাধনায় লিপ্ত থাকবো, ততক্ষন আমরা জগত কে কিঞ্চিৎমাত্রও মনে রাখবো না। আর যতক্ষন জগতের কাজের মধ্যে আবদ্ধ থাকবো ততক্ষণ কিঞ্চিৎ সময়ের জন্যের ভগবানকে ভুলবো না। তবেই স্বার্থক হবে আমাদের সাধনা। সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে সকল কিছুর উর্দ্ধে রাখার নামই হলো ভজনা। আমাদের সাধনার দ্বারা যখন আমরা কোনো উন্নততর অবস্থা প্রাপ্ত হই, তখনই আমাদের সাধনার প্রতি সন্তোষ চলে আসা উচিত নয়। বরং ক্রমাগত তৃষ্ণা নিয়ে সাধনার পথে পথে এগিয়ে যাওয়াই প্রকৃত সাধকের লক্ষণ। ধীরে ধীরে যখন আমাদের চেতনা থেকে অবলুপ্ত হবে জাগতিক সকল রিপুসম্পৃক্ত বাসনাসমূহ, যখন চিত্ত হতে নিবৃত্ত হবে সকল লোভ ও চাওয়া, তখনই সাধক ‍হৃদয়ে পূর্ণ হবে সাধনা।

ধর্ম দু প্রকার হয়ে থাকে। স্বধর্ম আর পরধর্ম। যে ধর্ম আমাদেরকে নিজেকে চিনতে বা নিজেকে লাভ করতে শেখায়, আত্মমুক্তির বিধানাবলী প্রদান করে, যে ধর্ম আমাদেরকে ভগবৎমুখী করে তাই স্বধর্ম। আর যে ধর্ম আমাদেরকে জগতের মোহে বন্দী করে, সংসারের দিকে নিয়ে যায়, তাই পরধর্ম।

স্বধর্মের সাধনার দ্বারা যখন আমাদের ‘স্ব’ উন্মোচিত হয়, তখনই মূলত আমরা সাধকে পরিণত হই। আমরা দু ধরনের সম্পর্কে লিপ্ত হই। প্রথম সম্পর্কটা হলো আমার স্ব” এর সাথে আমার সম্পর্ক। অন্যটি হলো, যা আমার নয়, সে সব জড়পদার্থের সঙ্গে আমার আসক্তিযুক্ত সম্পর্ক। স্ব’ এর সাথে সম্পর্ক তৈরী হলেই জড়ের সম্পর্ক তিরোহিত হবে। আর যদি আমারা অনিত্য বস্তুর মোহে আবদ্ধ হয়ে পড়ি, তবে আমাদের ভোগ করতে হবে মোহবন্ধনের জ্বালা।

অনিত্য সংসারে থেকেও সংসারে নির্লিপ্ত থাকতে হবে। জগতের সকল কার্যনির্বাহ করা আমার কর্তব্য। কর্তব্য জ্ঞানে সে সকল কর্মাবলী সম্পাদন করতে হবে। কিন্তু পরম এর কাজ করা একান্ত নিজের। এ কাজ নিষ্পন্ন করতে হয় স্ব” এর একান্ত প্রেরণায়।

ভক্ত যদি একান্ত ভক্তিচিত্তে আকুল প্রাণে আহ্বান করে প্রভুকে, প্রভুর সাধ্য নেই দূরে থাকার। যদি কোনো ভক্ত ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে দৃঢ় আকুলতা ও অনুরাগ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে তবে সে সফল হবেই। হৃদয়ে উদ্দেশ্য যদি হয় খাঁটি, তবে যে কাজটাই করা হোক না কেনো, সকল কাজই ইবাদতে পরিণত হবে।

সাধনা কোনো সাধারণ কর্ম নয়। যে সকল ক্রিয়াকলাপের দ্বারা চিত্তে ভগবানের জন্য আকুলতা তৈরী হয়, তাই সাধনা। যে সমস্ত ক্রিয়াকলাপের কারণে প্রভুতে আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়, তাই সাধনা।

সফল হোক সকলের “স্ব” এর সাধনা। প্রভু মূর্ত হয়ে উঠুক সকলের হৃদয়ে।

রচনাকাল – 20/10/2020
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর