লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
গভীর রাত। বাগদাদের এক শারাবখানা থেকে টলতে টলতে বেরোলেন মাতাল। বাড়ি ফিরবেন। চলতে চলতে পথিমধ্যে তার নজর পড়লো এক টুকরো কাগজের দিকে। কাগজটাতে হাতে তুললেন। দেখলেন, সেখানে লেখা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। খুব যত্ন করে পরম শ্রদ্ধায় বাড়ি নিয়ে চললেন কাগজটিকে। বাড়ি এনে কাগজ হতে ধুলাবালি পরিষ্কার করে আতর মেখে রেখে দিলেন বাড়ির কোনো উঁচু আর পবিত্র জায়গাতে। মর্যাদা দিলেন প্রভুর নামকে।
ঐ রাতেই বাগদাদের এক দরবেশ স্বপ্ন দেখলেন যে, আল্লাহ পাক তাঁকে বলছেন, “তুমি ঐ মদ্যপায়ী মাতাল কে বলো, সে যেমন করে আমার নামের সম্মান দিয়েছে, তেমনি আমিও তাঁর মনকে পূণ্য সুবাসিত ও পবিত্র করে তুলবো এবং তাঁর মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে তুলবো।”
সংশয়ে পড়লেন দরবেশ। এক মদ্যপ মাতালের জন্য আল্লাহর এমন ভালোবাসা! তিনি খুঁজতে বেরোলেন মাতালকে। বাড়ি যেয়ে শুনলেন, সে বাড়িতে নেই। শহরের শারাবখানায় নেশায় ভুর হয়ে পড়ে আছে! অগ্যতা দরবেশ পৌঁছলেন সে শারাবখানায়। মাতালকে ডেকে কিছুটা প্রকৃতস্থ করে বললেন, ‘তোমার সুসংবাদ আছে।’ মাতাল জানতে চান, ‘কার তরফ থেকে? দরবেশ জবাব দেন, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ বুকটা কেঁপে ওঠে মাতালের। সোজা হয়ে বসে সে। আগ্রহ ভরে শুনতে চায় সুসংবাদটি কি? দরবেশ মাতালের কাছে বর্ণনা করেন স্বপ্নের আদ্যোপান্ত!
স্বপ্নের বর্ণনা শুনে অস্থির হয়ে ওঠেন মাতাল। নেশা কেটে যায়। ভিতরে বয়ে যায় প্রভুপ্রেমের এক অনির্বচনীয় অনুভূতির আবেশ। মুহুর্তে পরিবর্তিত হয়ে যান তিনি। চিৎকার করে ওঠেন। অন্যান্য মাতাল বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি চললাম। তোমারা আমায় আর দেখতে পাবে না। আমি শুরু করলাম আমার প্রভুর পথে যাত্রা।”
লোকালয় ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে যান তিনি। নিমগ্ন হন গভীর উপাসনায়। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন যুগশ্রেষ্ঠ সাধক। বিখ্যাত তাপস। নাম তার বিশর হাফি (র)। ইলমে মারেফতের দীক্ষা গ্রহণ করেন তৎকালীন সুবিখ্যাত আউলিয়া তারই মামা হযরত আলী ইবনে হাশরাশ (র) এর নিকট। চলতে থাকে তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন সাধনা।
এতটাই আল্লাহপ্রেমিক ছিলেন হযরত বিশর হাফি (র), তিনি পরবর্তীতে সারাজীবন খালি পায়ে থেকেছেন। কখনো জুতা পরিধান করেননি। যার কারণেই তাঁর নাম হয় হাফি তথা নগ্নপদ। তাঁকে আজীবন খালি পায়ে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন, “যেদিন প্রথম আমার সাথে আমার প্রভুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেদিন আমি খালি পায়ে ছিলাম। সে দিনের মর্যাদা রক্ষার্থে আমি আর পায়ে জুতা পরিধান করিনি। তাছাড়া, প্রভু বলেছেন, জমিন কে তিনি আমাদের জন্য বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন। তাঁর দেয়া বিছানাতে তো আর আমি জুতা পায়ে চলতে পারি না।” জানা যায়, বিশর হাফি (র) এর মর্যাদা এতদূর ছিল যে, তিনি সারাজীবন খালি পায়ে চলার কারণে, তিনি যে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতেন, পশুপাখিরাও সে রাস্তায় কখনো মলমূত্র ত্যাগ করতো না।
আধ্যাত্মিকতার উচ্চ আসনে আসীন হযরত বিশর হাফি (র)। বিস্ময়কর ছিল তাঁর চিন্তামগ্নতা। তিনি প্রভুপ্রেমে এতোটাই বিভোর ছিলেন যে, সবসময় আত্মসমাহিত হয়ে থাকতেন। একদিন তিনি বাসায় ঢুকছেন, দরজার ভিতরে এক পা আর বাহিরে এক পা। এমন সময় কিছু একটা ভাবতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। এভাবেই রয়ে গেলেন সারারাত। আবার একবার তিনি বোনের বাড়ি গেছেন। সিড়িতে উঠছেন। এমন সময় তাঁর ভিতরে শুরু হলো কোনো এক বিষয়ে চিন্তা। ঠায় সারারাত দাঁড়িয়ে রইলেন সিড়িতে।
একবার বিশর হাফি (র) গেলেন একটি নির্জন ঝরণার ধারে। যেখানে বসে ছিলেন প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত আলী জুরজানী (র)। হযরত বিশর হাফি (র) তাঁর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করলেন। হযরত আলী জুরজানী (র) বললেন, “গরীব দুঃখীকে ভালোবাসো। ধৈর্য ধারন করো। প্রবৃত্তিকে শত্রু মনে করো। প্রবৃত্তি যা চায়, তার বিপরীত কাজ করো। আর নিজের বাড়িকে কবরের চেয়েও মালপত্র মুক্ত রাখো। তাহলে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তোমার কোনো কষ্ট হবে না।”
হযরত বিশর হাফি (র) এতো উচ্চ পর্যায়ের আউলিয়া ছিলেন যে, তিনি খালি পায়ে হাটার কারণে বাগদাদের কোনো পথে পশুপাখি মলত্যাগ করতো না। হঠাৎ একদিন একটি পশু রাস্তায় মলত্যাগ করলো। সাথে সাথে হায় হায় করে কেঁদে উঠলেন পশুটির মালিক। বললেন, বিশর হাফি (র) নিশ্চয় ইহলোক ত্যাগ করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো সত্যিই তাই। প্রভুর মহান প্রেমিক প্রভু সন্নিধানে গমন করেছেন।
রচনাকাল – 23/02/2019
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী