লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
যা মানুষের জন্য কল্যাণকর তাই মানুষের বিধান হওয়া উচিত। মানুষের তরে যতগুলো বিধান ক্রিয়াশীল থাকবে তার অভ্যান্তরীন দর্শন-কেই আমি বলবো ধর্ম। যা থেকে উৎসারিত হয় মানব-প্রেম, মানব-সেবা, মহত্তম কার্য সাধনের আকাঙ্খা। অতএব ধর্ম এমন একটি নিয়ামক যেখানে থাকে জীবন ও জীবনোত্তীর্ণ সকল বিষয় সমুহের সঠিক সমাধান ও পথ নির্দেশনা। যার আলোকে প্রতিটি ধার্মিক গঠন করে নেয় তার জীবন-ব্যাবস্থা। যার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয় মানবতা মানব ধর্ম । যা একটি অত্যন্ত সুন্দর প্রক্রিয়া হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
তাহলে ধর্ম জগতে এত অস্থিরতা, হানাহানি, বিশৃঙ্খলা, মতভেদ – কেনো?
কারণ, আসলে ধর্মের বিধান সমুহের অভ্যন্তরীন দর্শন আমরা বুঝিনি। যদি বুঝতে সক্ষম হতাম, তাহলে আচারনিষ্ঠতার চেয়ে আমাদের কাছে বেশি প্রাধান্য পেত জীবন-চিন্তা তথা জীবন-দর্শন যা ধর্মের প্রতি পলে-পলে আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্মের মূল আলোচনা বা কর্মপরিকল্পনা হলো মানবতা। জগতের চতুর্থ মাত্রা ইনছানিয়াত বা মনুষ্যত্ব যা চতুর্থ আসমানে অবস্থিত। অর্থ্যাৎ মানুষ হল সৃষ্টি জগতে সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতি, সকল সৃষ্টি জীবের চুড়ান্ত পরিণত রূপ। যেখানে ঘটেছে স্রষ্টার সর্ব্বোত্তম স্বভাবের বিকাশ। যার বলেই মানুষ ইনছান তথা নিজেই বিচারক।
তাহলে মানুষের কর্মপরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত? শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন হয়ে যদি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠত্বকে বিসর্জন দিয়ে নোংরা পঙ্কিলতায় নামি, তাহলে আমাদের আত্মসম্মানের চরম অবমাননা। আমরা বস্তুজগতের চতুর্থ মাত্রা বাতাসের গুণশক্তির পূর্ণ অধিকারী। এখন আমাদের গতি থাকবে উর্দ্ধে, আরো উর্দ্ধে। আমরা জয় করবো সপ্ত-আকাশ। আমাদের পায়ের ধূলি গায়ে মেখে ফেরেশতারা লাভ করবে নব-জীবন ।
কিন্তু হায়! আমরা করছি কি? আমাদের কি মানুষ বলা যায়? আমাদের শক্তির প্রয়োগ আমরা করছি কোথায়? আজো আমরা ব্যাস্ত শৃগাল-কুকুর-শকুন-সাপ স্বভাবে। কোথায় আমাদের মুক্তি?
এ পথ প্রদর্শণের নিমিত্তেই যুগে যুগে আসেন মহামানবগণ। কালে কালে অখন্ড কাল তারা প্রতিষ্ঠিত করেন আত্মচেতনা ও আত্মিক শুদ্ধতা’ র গগনস্পর্শী গম্বুজ। আমরা যারা আজো আবদ্ধ পশুত্বে বা জড় স্বভাবে তাদের একমাত্র কর্তব্য তখন অন্ধ বিশ্বাসে সেই সমস্ত মহাপুরুষদের অনুকরণ করে যাওয়া। পবিত্র একজন মানুষকে ভালোবাসা, তার জীবন তরীতে নিজের জীবন চেতনা বেঁধে দিয়ে আত্মিক শুদ্ধতায় নিমগ্ন হওয়া।
জগৎব্যাপি বিরাজিত অনন্ত রহস্য সাগরের মন্থিত মণি-মুক্তা স্বরুপ একজন পবিত্র মানুষ। যিনি অখন্ড চেতনায় সমগ্র জগৎকে তার পরম আত্মোপলব্ধি’র দর্শনে একীভূত করে অনুভব করেন ও প্রকাশ করে থাকেন। তখন একমাত্র সত্য তিনি। তার মাধ্যমেই জগতে প্রচারিত হয় মানবতা মানব ধর্ম।
সমগ্র বিশ্বের একমাত্র সত্য হলো মানুষ তত্ত্ব। একমাত্র মানুষ তত্ত্বে নিহিত প্রকৃত সত্য।
মানুষের খোদা বিশ্বাস বড়ই নড়বড়ে, তার কারণ, যেখানে মানুষ বিশ্বাসের অপূর্নতা সেখানে খোদা বিশ্বাসের স্থান কোথায়? মানুষ ব্যতিত খোদাকে যেখানেই কল্পনা করা হোক সেখানেই তো প্রতিষ্টিত হবে অবিশ্বাস। যার থেকে জন্ম নেবে অবিশ্বাসীর দর্শন। মুসলিম আজ অধঃপাতে তার কারণ এখনো মুসলিম সমাজ বাকীতে বিশ্বাসী, নগদ প্রত্যাশী নয়। আজও হচ্ছে না মানুষ-দর্শন বিধায়ই অধরা থেকে যাচ্ছে খোদা-দর্শন।
আত্মপ্রতিষ্ঠার মূলসূত্র মানুষতত্ত্বে আস্থা স্থাপন। তা না হলে বস্তুমোহে চিরদিনই আবদ্ধ থাকতে হবে পশুত্বের ভোগলিপ্সায়। মানুষ-তত্ত্বই একমাত্র সত্য। কারণ, মানুষই পরম সত্ত্বার চুড়ান্ত প্রকাশ। আল্লাহর জাতপাক প্রকাশের আধার। নুরে মোহাম্মদীর লীলাক্ষেত্র।
মানবতার বৈশিষ্ট গুলোই ধর্ম। মানবতাই ধর্মের বিধায়ক। ধর্ম যদি মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করে তবে তা পরিত্যাজ্য। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র সহ সকল বিভেদ বৈষম্য তথা সমস্ত খন্ডিত চেতনার উদ্ধে উঠাই তো মানবতার প্রথম ধাপ। ধর্ম কেমন তা নির্ভর করে একজন মানুষের মানব সত্ত্বা কেমন তার উপর। মনুষ্যত্ব পরিপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হলেই পুরোপুরি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। অতএব আমাদের উচিত সকল অজ্ঞানতা অন্ধবিশ্বাসের উর্দ্ধে উঠে মানবতাবাদ বা মানব ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
সমগ্র সৃষ্টিজগতের অস্বিত্ব নির্ভরশীল একটা মানব অস্তিত্বের ওপরে, যা হলো সত্যের ধারক ও বাহক।
সত্যম-শিবম-সুন্দরমের অবয়ব একজন মানুষ। পৃথিবীতে একাধিক ধর্মের অস্বিত্ব থাকা অসম্ভব একমাত্র সহজাত শ্বাশত সত্য মানব ধর্ম ব্যাতীত।
আল্লাহ-ভগবান-গড বা ঈশ্বর বলে পৃথক কিছু থাকতে পারে না মানব সত্ত্বায় বিরাজিত সকল কারণের আদি কারণ পরম সত্ত্বা স্রষ্টার মানব রূপ ব্যতীত।
পবিত্র মানুষ ই একমাত্র পবিত্র সত্ত্বা যার লয়-ক্ষয়, বিনাশ বা পরিবর্তন নাই, নাই কোনো অংশীদার।
অপবিত্রতার গুণ খাছিয়তে আবৃত বা পবিত্রতার পথে উত্তোরন্মূখ মানুষের জন্য একমাত্র আরাধ্য, একমাত্র পূজ্য হলো একজন পবিত্র মানুষ (নিত্য মানুষ, সহজ মানুষ, দিব্য মানুষ, আলেক মানুষ, অধর মানুষ, সোনার মানুষ, সরল মানুষ, মনের মানুষ)। যিনি বিষয় মায়ায় আবদ্ধ পাপীদের পশুত্ব থেকে টেনে তুলবেন মনুষত্বে।
পৃথিবীতে মানুষ বা মানব হলো একক জাতি। এদের জন্ম এক, পরিনতি এক, স্রষ্টাও একক/একাকার ও অভিন্ন। অতএব জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে একাধিক ধর্মবিশ্বাস অথবা একই ধর্মে মতোবিরোধ শুধু অযোক্তিকই নয়, অবান্তরও বটে।
একক মানব গোষ্ঠীর একক ধর্ম হলো মানব ধর্ম, শান্তিবাদ (ঔম বা ইসলাম)। এর প্রধান স্তম্ভ গুলো হলো বিশ্বস্ততা, সততা, সমতা, একতা, পরিশ্রম, ত্যাগ, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য ইত্যাদি। এই স্তম্ভ গুলো দাঁড় করাতে হবে মিথ্যা, লোভ, হিংসা-অহংকার (শিরক/পাপ) ত্যাগের মাধ্যমে।
তথাকথিত ধর্মের সকল বিষবেড়াজালের উর্দ্ধে উঠে আমাদের সকলের উচিত মানুষ হওয়া। মনুষ্যত্বই একমাত্র পবিত্র বিধান এবং এক ধর্ম।
আল্লাহর স্পষ্ট আদেশ, স্পষ্ট বিধান প্রত্যাখ্যান করে অগনিত মানব সমাজ প্রতিনিয়ত দলে দলে ধ্বংসশীল অনিত্য মোহবদ্ধ দজ্জাল চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছে। দজ্জাল দল আজ ধর্মের মুল বিষয় বা উদ্দ্যশ্য ভুলে ব্যাস্ত মানুষকে মানবতার তথা মনুষ্যত্বের সিংহাসন থেকে টেনে পশুত্বের কদর্যতায় নিয়ে ফেলার জন্য। ফলে গোড়ামি, সংকীর্ণতা, অজ্ঞানতা, বিভেদ বৈষম্যের বিষবাস্পের উদ্গীরনে মুসলমান সমাজের একাংশ ভুলে যাচ্ছে সুস্পষ্ট মুক্তি পথের দিশা, গোপন করছে মহান স্রষ্টার নিদর্শন। ভুলে যাচ্ছে রূপক, প্রতীক অনুসরণ বা সাজসজ্জাই মুক্তির পথ নয়, মুক্তির পথ হলো আত্মিক শুদ্ধতা বা পবিত্রতা অর্জন করা। (ফালা ইয়ানজু ইল্লা মান আতাল্লাহা বি ক্বালবিন ছালিম)- যে পবিত্র অন্তকরণ নিয়ে আসবে সেই মুক্তি পাবে। (সুরা আশ শুরা- ৮৯)
এখনই সময় দীর্ঘদিনের চলমান এজিদি অত্যাচার, জুলুমের অবসান ঘটানোর। রুহুল্লাহকে জাগ্রত করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে মুখোশধারী, বেশধারী দজ্জালদের। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ফিৎরাতাল্লাহ তথা দ্বীনে মোহাম্মদী।
সত্য সমাগত, মিথ্যা অবশ্যই নিক্ষিপ্ত। সুদীর্ঘ কালের মরণ ছোবলে আবৃত দ্বীনে-মোহাম্মদীর বিজয়-কেতন পতপত করে উড়ছে, বিরুদ্ধবাদী দের জমাকৃত আবর্জনার স্তুপ ঠেলে দুলে দুলে উঠছে মোহাম্মদী-পতাকা। নূরে মাহদীর সাত্ত্বিক রৌশনে জগৎকে আলোকিত করার এইতো সময়! সকল অজ্ঞানতা, ভেদজ্ঞান, সংকীর্ণতা, গোড়ামীর উর্দ্ধে ইনছানিয়াতকে অধিষ্ঠিত করতে হবে। আমিত্ব তথা রিপুময় কলুষিত জগৎ পারায়ে আমাদেরকে পৌঁছতেই হবে সচ্চিদানন্দময় অমর ধামে। যেখানে নেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, যেখানে সবাই অবস্থান করে একত্ত্ব তথা তাওহিদের প্রেমময় মাকামে।
রচনাকাল – 21/02/2015
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী