প্রবন্ধ – সচল সারমাস্ত; শায়ের ই হাফত জাবান

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী

সংক্ষিপ্ত তথ্য :
নাম – আবদুল ওয়াহাব ফারকী
প্রচলিত নাম – সচল সারমাস্ত
পিতার নাম – মিয়া সালাউদ্দিন
জন্ম – ১ জানুয়ারী ১৭৩৯
ওফাত – ১ জানুয়ারী ১৮২৯
জন্মস্থান – পাকিস্থানের সিন্ধুতে অবস্থিত রানীপুর দারাজায়।

সিন্ধুর মহান অতিন্দ্রিয়বাদী সাধক ওলী শাহ আব্দুল লতিফ ভিটাই এর সাথে দেখা করতে এসেছেন একটি বালক। ডাকনাম সচল, লোকে সারমাস্ত বলে ডাকে। বালকটি কিয়ৎকাল অবস্থান করলেন লতিফ ভিটাইয়ের সঙ্গে। বালকটির মেধা, দূরদর্শিতা, জ্ঞানানুরাগ দেখে ও বালকটির অন্তর্নিহিত সত্যের দীপ্তিময় প্রভা অবলোকন করে শাহ লতিফ ভিটাই বললেন, “যে কড়াই আমি সিদ্ধ করেছি, এ বালক তার ঢাকনা খুলে ফেলবে।”

নাম তার সচল সারমাস্ত। সচল বা সাচল অর্থ সত্যবাদী এবং সারমাস্ত অর্থ আনন্দময়। একদম ছোটবেলা থেকেই অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক প্রবণতার কারণে তাকে এই খেতাবগুলো দেয়া হয়েছিল। তার পিতৃপ্রদত্ত নাম আবদুল ওয়াহাব ফারুকী।

পাকিস্থানের সিন্ধুর রানীপুরের কাছে খয়েরপুরের দারাজা গ্রামে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল ওয়াহাব ফারুকী। পিতার নাম মিয়া সালাহউদ্দিন। ছোট বেলাতে পিতাকে হারান তিনি। তার চাচা পীর খাজা আবদুল হক তাকে লালন পালনের দায়িত্ব নেন। চাচা আবদুল হকের নিকটই আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভ করেন তিনি। তাকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করেন। বয়ঃকালে মামাতো বোনের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। দুবছর পরই তার স্ত্রী মারা যায়। আর কখনো বিয়ে করেননি তিনি।

জিবন যাপনে ছিলেন একজন পরম ‍ঋষি। নির্জনতা ও নিরবতা পছন্দ করতেন তিনি। নিজ গ্রাম থেকে কখনো বাহিরে যাননি। পোশাক আশাক বা খাদ্যাভাসে ছিলেন খুবই সাধারণ। প্রিয় খাবার ছিল ডাল ও দই। ঘুমাতেন শুধু কাঠের একটা বিছানায়। লম্বা কোমল চুল ও সুতীক্ষ মায়াবী চক্ষুযুগলের সারমাস্তকে দেখলেই হৃদয়ে একটা অনাবিল শান্তির ফোয়ারা প্রবাহিত হতো।

সারাজিবন জাগতিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে একটি বিনম্র তপস্বী জিবনযাপন করার পর ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ৯০ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। পিতা ও চাচার রওজার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তৎকালীন খয়েরপুরের শাসক মীর রুস্তম আলী খান সেখানে মন্দির সদৃশ অত্যন্ত সুদৃশ্য মাজারটি নির্মাণ করে দেন। প্রতিবছর ১২ ই রমজান হতে দীর্ঘদিন ব্যাপী সেখানে ওরশ উদযাপিত হয়।

সচল সারমাস্ত কে “শায়ের ই হাফত জাবান” বলা হয়। সাতটি ভাষায় কবিতা লিখেছেন তিনি। আরবি, সিন্ধি, সরাইকি, পাঞ্জাবি, উর্দু, ফার্সি ও বেলুচি ভাষায় অতিন্দ্রিয় রহস্যময় কবিতাসমূহ রচনা করেছেন তিনি। মহর্ষি মনসুর হাল্লাজ, মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী (র) এর ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। তাঁর কাব্যদর্শনে বহু জায়গার মনসুরের “আনাল হক” বা ইবনুল আরাবীর “ওহদাতুল ওজুদ” এর স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তৎকালীন সিন্ধু সাহিত্যের প্রচলিত প্রায় সকল ঘারানাতেই কবিতা লিখেছেন সারমাস্ত। কাফি, বাইত, গজল, মসনবী, সি হারফিস, মুস্তাজাদ, হামদ, ঝুলনা, ঘরোলি, মুসাদ্দাস, দিওয়ান ই আশকার ও দরদ নামা সহ নানান ধারায় রয়েছে তার রচনা।

আগা সুফি তার প্রথম গ্রন্থ। গ্রন্থটি সিন্ধুর শিকারপুরে ১৯৩৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। সচল সারমাস্ত এসব ঐশী প্রেরণা সম্বলিত কালাম সমূহ বিশেষ ভাবোন্মত্ত অবস্থায় লিখতেন। যখন তার অভ্যন্তরে ঐশী কালামের প্রেরণা উপস্থিত হতো, তিনি বিমোহিত অবস্থায় থাকতেন। তার নয়ন যুগল থেকে অবিরাম ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। মাথার চুলগুলো শক্ত হয়ে দাড়িয়ে যেতো, তিনি ধ্যানমগ্নতার মধ্যে বলে যেতেন তার শায়েরী গুলো। তার অনুসরারীরা সেগুলো লিখে রাখতো। যখন তার ভাবোন্মত্ত অবস্থা কেটে যেত, তিনি তার উচ্চারিত কালামগুলোকে অস্বীকার করতেন। নিজের উচ্চারিত কালামকে নিজের কাছেই অপরিচিত মনে হতো। কবিতার মধ্যে থাকতো নানান দূর্বোধ্য ও রহস্যজনক আলাপ।

লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
সম্পাদক – আপন খবর
চেয়ারম্যান – আপন ফাউন্ডেশন
03/01/2024

আপন খবর