লেখক – কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
আল হাক্কু মুররুন অর্থাৎ সত্য বড় তিতা হয়। তাইতো সত্য আছে রূপক-প্রতীকের (মুতাশাবেহাতের) আড়ালে। জ্ঞানীগণ রূপক প্রতীকের আড়ালে স্থিত সেই চিরন্তন-শ্বাশত দ্ব্যর্থবিহীন সত্যকে বুঝতে পারেন বিধায় তারা জাতি-গোত্রের ভেদাভেদের বাহিরে অবস্থান করেন এবং তারা হলেন পতিত মানুষের পথপ্রদর্শক। সেই সত্যকে সত্যের পথিক বা সত্যনিষ্ঠ ব্যাক্তি ছাড়া কেউ ধারণ করতে পারে না। সেজন্যই সাধারন মানুষের নিকট রূপক প্রতীকের উপস্থাপন। জ্ঞানীগণ সেই রূপক প্রতীকের সমুজ্জল (মুহকামাত) যা দ্ব্যর্থবিহীন তার ভেদ বুঝেন। সাধারন মানুষ তাইতো জ্ঞানীর সঙ্গ না নিলে, কখনো সেই রূপক প্রতীকের দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে তা কখনো জানতে পারে না। এই জ্ঞানীরাই হলেন মানব মুক্তির দিশারী তথা গুরু বা মুর্শিদ। মানুষ ধর্মজ্ঞানহীন এবং পথভ্রষ্ট হয় যখন কোরানের মোতাশাবেহাতকে তথা রূপক প্রতীককেই ধর্মজ্ঞান মনে করে তথা রূপক প্রতীকের অর্থ করে- যা কোরানে নিষেধ করা হয়েছে।
কোরানের সমস্ত কালাম আছে রূপক প্রতীকের আড়ালে। সেই রুপক প্রতীকের আড়ালে লুক্বায়িত চিরসত্য দ্ব্যর্থবিহীন জ্ঞানময় কালামকে না বুঝে শুধু রূপক প্রতীকের অর্থ করে আলেম মোল্লাগণ সাধারন মানুষকে পথভ্রষ্ট করে চলছে। তারই একটি চিরন্তন শ্বাশত চিরবর্তমান ঘটনা হলো আদমকে সেজদা করা। সাধারন লোকগুলো এর শুধু মোতাশাবেহাতটিই জানে, এর মুহকামাত তথা হাকিকত সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর বিধায় অখন্ডে প্রবাহিত চিরন্তন শ্বাশত বর্তমান ঘটনাটিকে অধিকাংশই অতীত কালের ঘটনা বলে জানে, মানে এবং তাই প্রচার করে। ইহাই অজ্ঞতা-মুর্খতা।
আদম কাবায় সেজদা না করে ইবলিশ কাফের হলো। ইবলিশ আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞা করলো যে পথে আমি পথভ্রষ্ট হলাম (মানে আদম কাবায় সেজদা না করে) বা কাফের বা লানত পেয়ে জান্নাত থেকে বের হলাম আমি তোমার আওলাদে আদমকেও সে পথে পথভ্রষ্ট করবো। আল্লাহ বললেন, তুমি পারবে তবে যারা আমার বান্দা তাদেরকে তুমি কিছুই করতে পারবে না। ইবলিশ কিভাবে পথভ্রষ্ট হলো? সে আদম কাবায় বা মুর্শিদ কাবায় সেজদা করে নি। কিন্তু সে বিমূর্ত আল্লাহকে মানে, সেজদা করে, রাছুল স্বীকার করে, ইহকাল বা পরকালও স্বীকার করে, জান্নাত জাহান্নাম সবই স্বীকার করে এবং আল্লাহর বন্দেগীও বেশি বেশি করছে। আল্লাহর মূর্তরূপ বা আদম কাবায় বা মুর্শিদ কাবায় সে সেজদা করতে রাজি নয় বিধায় আল্লাহপাক তাকে লানত দিয়ে বা ওয়া কানা মিনাল কাফেরীন ঘোষনা দিয়ে তার সমস্ত ইবাদতের ফল অসার ঘোষণা করে দিয়ে জান্নাত থেকে বের করে দিলেন।
আদমের দুটি অবস্থা। একটি জান্নাতে অপরটি দুনিয়ার জীবন। দুনিয়ার জীবনে তিনি পাক পাঞ্জাতনের উছিলা ধরে তওবা করে মুক্তি পেলেন এবং তিনি নবী ও রাছুল হলেন। এই আদমই পতিত মানব জাতির পথপ্রদর্শক বা মুর্শিদ। কাজেই এখন যারা আদম কাবায় বা মুর্শিদ কাবায় সেজদা করা মানে না বা শেরেক বলে চিৎকার করে তারা ইবলিশের বান্দা। ইহাই কুরআনের হুকুম বা বিধান। আদম আল্লাহর প্রতিভূ বা স্থলাভিষিক্ত এবং আদম আল্লাহর সুরতে গঠন এবং আদম বর্তমান। আল্লাহ শুধু নূর, বিমূর্ত নূর, মেছালবিহীন নূর।এ নূর দর্শনযোগ্য নয়। আল্লাহপাক ই আবার তার নূরের মেছাল দিয়েছেন তাকে দেখার জন্য ‘মাছালু নূরীহি কামিশকাতিন ফিহা মিজবাহুন’ বলে। ঐ বিমূর্ত নূরের মেছালই হলো আদম। আল্লাহ প্রয়োগহীন এবং তার প্রায়োগিক অবস্থাই হলো আদম।
কাজেই আদম কাবায় বা মুর্শিদ কাবায় আল্লাহকে দর্শন করতে হবে এবং এখানে সেজদা দিলেই আল্লাহপাক সেজদা পাবেন এবং খুশি হবেন। এই আদম কাবাই হলো ঈমানদারের কাবা কেবলা তথা দিক, যার অভিমুখে আল্লাহকে সেজদা করবে। ইহারই প্রতীক স্বরুপ আরবে পাথরের তৈরী কাবা ঘরকে কেবলা করে আল্লাহ কে সেজদা দিলে তা শরিয়তেই গ্রহনযোগ্য বা স্বীকৃত। হাদিস কুদসী হতে জানা যায়, আল্লাহপাক বলেন, “ইন্নাল্লাহা খালাকা আদামা আলা ছুরাতিহী” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহপাক আদমকে সৃষ্টি করেছেন আপন সুরতের উপরে। সৃষ্টি মানে অবিকল প্রকাশ বা আসলেরই প্রকাশ। এই মানুষের মাঝেই আল্লাহ তাঁর বিমূর্ত নূর মূর্তরূপে প্রত্যক্ষ করে নবুয়ত খতম ঘোষণা করলেন।
যেখানে আল্লাহর নবুয়ত সেখানেই আছে আল্লাহর সুরত। আল্লাহপাক তাঁর স্বীয় সিরাত হতে আদমের সুরত প্রকাশ করলেন বিধায় আদম সুরতেই আল্লাহকে ঈমানদারগণ দর্শন করছেন এবং আল্লাহপাককে দর্শন করে বা নিরিখ করে নূরী কাবা বা আদম কাবার মাধ্যমে আল্লাহকেই সেজদা করে চলেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেহ সেজদা পাবে না। তবে আল্লাহর বিমূর্ত রূপে নয়, সেজদা হবে তাঁর মূর্ত রূপে- ইহাই হলো সেরাতুল মুস্তাকিম। কিন্তু ইবলিশ তার প্রতিজ্ঞানুযায়ী মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে তাই সেরাতুল মুস্তাকিমের মাঝে তথা নূরী কাবায় আল্লাহর ছুরতের নিরিখ প্রতিষ্ঠিত হতে দিবে না।
যদিও ইবলিশ দ্বারা ইহা একটি পরিক্ষা, কারা আদম কাবায় সেজদা করে বা করে না। যারা আদম কাবায় আল্লাহকে সেজদা করছে তারা আল্লাহর বান্দা, তাদের সেজদা কবুল হচ্ছে। আর যারা সেজদা করছে না তারা শয়তানের বান্দা বা অনুসারী, তাদের কোনো বন্দেগী কবুল হচ্ছে না; বরং গলায় পড়ছে লানতের মালা। ইবলিশের এই প্রতিজ্ঞার ফাঁদে পড়েছে পৃথীবির চৌদ্দ আনা মানুষই। বলা যায়, এই পৃথিবীতে ইবলিশেরই এক প্রকার রাজত্ব চলছে এবং ইবলিশ মানবজাতির অধিকাংশকে অচেতন করে রেখেছে। বিধায় তারা বুঝতেই পারছে না যে, তারা ইবলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভুল পথে আছে। তারা ভাবছে ঠিক পথেই আছে, যেমন ভেবেছিলো ইবলিশ যে আমিই আদম কাবায় আল্লাহকে সেজদা না করে একমাত্র আল্লাহকেই (বিমূর্ত আল্লাহকে সেজদা করে) সঠিক পথে আছি! এই শ্রেণীর উপাসকগণের উপাসনার ধারাটি হলো, তারা শুধু আনুষ্ঠানিকতাকেই একমাত্র ইবাদত মনে করে। যেমন, ওয়াক্তিয়া নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিই একমাত্র ইবাদত! আসলে এ সমস্তই হলো আসলের প্রতীক, উপমা বা মেছাল তথা মুতাশাবেহাত তথা খন্ড কালের ইবাদত, অখন্ড কালের নয়।
এ সমস্ত ইবাদত সময়ের দুই স্তর অতিক্রম করতে পারে না। মানুষের ইবাদত হলো খন্ড কালের ইবাদত হতে অখন্ড কালে স্থিতি লাভ করা তথা দায়েমীতে কায়েম হয়ে যাওয়া তথা নিজেই নামাজ-রোজা হয়ে যাওয়া এবং এবং নিজের নামাজকে হেফাজত করা। মানুষ ইবাদত করবে কার এবং কোথায়? আল্লাহ মানুষে(অহুয়া মায়াকুম আইনামা কুনতুম; ওয়া নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওরিদ)। কাজেই মানুষ নিজের মধ্যে নিজের আল্লাহকে চিনে নিজের মধ্যেই তাঁর ইবাদত করবে। এজন্য দেখা যায় নামাজ আদায় করার প্রথমে সেজদার জায়গায় লক্ষ্য, তারপর রুকুতে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে, সেজদায় নাকের মাথায় এবং তাশাহুদ পাঠ করার সময় ক্বালবের দিকে লক্ষ্য করতে হয় মানে নামাজ মানুষ নিজেই।