পত্রিকা – আদম কাবায় সেজদা এবং কিছু কথা ০২

লেখক – কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী

এজন্যই আদম কাবায় আল্লাহ আছেন। এই কাবা পাঁচ নূরের তৈরী তথা আদমই হলো নূর আল্লাহ। বিমূর্তের মূর্ত আল্লাহ তথা লাছানির ছানি আল্লাহ তথা বেমেছালের মেছাল আল্লাহ (মাছালু নূরীহি… মিছবাহুন)। তথা নূর আল্লাহ তথা আদমকে সেজদা না করে ইবলিশ পথভ্রষ্ট হলো । আর এখন পনের আনা মানুষকে যেভাবে পথভ্রষ্ট করে চলেছে এবং আদম কাবায় আল্লাহকে সেজদা না করার জন্য শত-সহস্র মত, যুক্তি, বুদ্ধি, ফতোয়া সে তুলে ধরছে! কোথা তে এবং কেমন করে সে এ সমস্ত বিষয়গুলো তুলে ধরছে? তার অবস্থান এই মানুষেরই অন্তর জগতে ছুদুর নামক স্থানে (অছওয়াছিল খান্নাছ)। শেরেকির পচা-দূর্গন্ধটিও এখানে আছে বলে ফতোয়ার ডিগবাজী খেলছে, সেই সঙ্গে জাহান্নামে যাবার প্রচন্ড ভয়টিও দেখাচ্ছে। আর অন্ধ মূর্খ নাদানেরা সেই ফাঁদে পড়ে তাদের অজান্তেই পথভ্রষ্ট হচ্ছে এবং পথভ্রষ্ট করার শিক্ষার জন্য হাজার হাজার আরবী পাঠশালাও খুলেছে।

আল্লাহকে ছাড়া সেজদা দেয়া হারাম এটা সত্য, তবে তা হবে মুর্শিদ বা আদম কাবাকে অভিমুখ করে। যেমন, আরবে পাথরের কাবাকে অভিমুখ করে সেজদা করা হয়। মক্কার কাবা ঘর হলো হাকিকি কাবারই প্রতীক। আল্লাহপাকের মূল সিফাতের মারেফত হলেই চিনা যাবে আল্লাহর সুরতেই আদম বা মানুষ সৃষ্টি। এই ইলমে মারেফত দ্বারা চক্ষু খুলে যাবে এবং দিব্যদৃষ্টি অর্জন হবে। কাজেই আল্লাহর চোখ দ্বারাই আল্লাহকে দেখতে হবে, শুধু মানবীয় চোখে তাকে দেখা যাবে না (লা তুদরিকুল আবছারু)। আল্লাহপাক জানাচ্ছেন, হে রাছুল, আমার বান্দারা জিজ্ঞেস করবে আল্লাহ কোথায়? আপনি বলে দেন, আল্লাহ তোমার কাছেই আছে। আরও পরিষ্কার করে বলছেন, আল্লাহ তোমার সাথেই আছেন। তাহলে অনুমান কল্পনায় বিমূর্ত আল্লাহকে আসমানে সাব্যস্ত করা কুফরী।

আল্লাহকে সৃষ্টি থেকে কোথায় আলাদা স্যাব্যস্ত করা যাবে না, করলে তা হবে শেরেকি। ইবলিশ ই প্রথম এই শেরেকি টা করছে আর করছে তার অনুসারীরা তথা যারা ইবলিশের মতবাদে আক্রান্ত হয়ে আছে তথা নফসে আম্মারার গুণ খাছিয়তে আবৃত হয়ে আছে। এই পথে এবং মতে ইবলিশ অধিকাংশকেই পথভ্রষ্ট করতে পারছে (সুরা আনআম – ১১৬)। আল্লাহ আমার সাথেই আছেন, এর ভেদ রহস্য একমাত্র মানুষই বুঝতে পারে এবং তাকে দেখতে পায়। মানুষেরই এক নাম হলো মুহাম্মদ আর মুহাম্মদ হলো আল্লাহ মোজহার তথা মুহাম্মদ সৃষ্টি হলো আল্লাহর চেহারার নূর হতে। সেজন্য বলা হয়েছে, খালাকতু মুহাম্মাদান মিন নুরে ওয়াজহি। অর্থাৎ আমার চেহারার নূর হতে মোহাম্মদকে সৃষ্টি করেছি। অন্ধ-মূর্খ-নাদানেরা এ হাদিসের হাকিকত বুঝতে না পেরে মিথ্যা বা জাল হাদিস বলে প্রচার করছে। জানা প্রয়োজন যে, আল্লাহ এবং তাঁর হাবিব মুহাম্মদ একই নূর।

হাদিস কুদসীতে বলা হচ্ছে, আনা মিন নূরীল্লাহ ওয়াল খালকু কুল্লিহিম মিন নূরীহি। অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর হতে এবং সমস্ত সৃষ্টি আমার নূর হতে। এর মানে সমস্ত সৃষ্টিই হলো নূরে মোহাম্মদীর ঝরণার প্রবাহিত রূপ তথা কুললানা মুহাম্মদ। তার মধ্যে মানুষ মুহাম্মদ সৃষ্টির বিশেষ বৈশিষ্টের অধিকারী। এ মুহাম্মদই নবুয়ত লাভ করেছে তথা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডময় সুরের ভাবমর্ম মুহাম্মদের জলিতে এসে সুরা কালামে কোরান স্বরূপ জহুর হচ্ছে। ঈমানদারগণ তথা মুহাম্মদের অনুসারীগণ মুহাম্মদ হতে আল্লাহর কালাম শ্রবণ করে ইনছানে পরিণত হচ্ছে। কিসসা কোরানের তার দলিল হলো, আর রহমান।আল্লামাল কোরআন।খালাকাল ইনছান। অর্থাৎ রহমান। তিনি কোরান শিক্ষা দেন। সৃষ্টি করেন ইনছান। এই কোরান হলো আরবী কোরান, কিচ্ছা কোরান নয়।

কিচ্ছা কোরান আসমানী কোরান নয়, আসমানী কোরান হলো আরবী কোরান। আরবী কেরান হলো ইনছান কোরান। ইনছানের বুনিয়াদ হলো ইনছাফ আর ইনছানের পবিত্র গুণ খাছিয়ত হলো ইনছানিয়াত- যা জাতপাক আল্লাহর পবিত্র সিফাত। কিচ্ছা কোরানে তাই বলা হয়েছে, ফিতরাতাল্লাহিল্লাতি ফাতারান নাসা আলাইহা। অর্থাৎ আল্লাহ যেই প্রকৃতির ওপর মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তাহাই তো তাদের জন্য আল্লাহর প্রকৃতি বা ফেতরাত। বিশ্বাস ভক্তি যোগে আল্লাহর কালাম শ্রবণে পর্দাবৃত মানুষ পর্দামুক্ত হয়ে ইনছান রূপে গড়ে ওঠে। এটা একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব যারা আল্লাহর কালামকে আল্লাহর নিকট হতে শ্রবণ করে নেয়। যিনি এই কালাম প্রকাশ করেন তিনি রহমান, আল্লাহর মূর্তরূপ তথা গুরু তথা আদম বা মুর্শিদ। তুমি জেনে রাখো এবং জানো যে, আল্লাহ নিজেই হলো কালাম। তবে মতলেক কালাম, সেই কালাম আদমে বা তাঁর খলিফার মাধ্যমে নাতেক হচ্ছে। আল্লাহপাক ছাড়া কেহ কোরান শিক্ষা দিতে পারে না।

যারা বলছে আমরা কোরান শিক্ষা দেই তারা কুফরি করছে। ঈমানদারগণ সেই কালাম আল্লাহর কালাম বলে শনাক্ত করে এবং তা শ্রবন করে হেদায়াত প্রাপ্ত হচ্ছে। যারা কিচ্ছা কোরান শ্রবণ বা পাঠ করছে তারা অন্ধ অনুমানেই থেকে যাচ্ছে এবং পথহারা হচ্ছে। তবে কিচ্ছা কোরানের ভেদ যারা আরবী কোরান থেকে বুঝে এবং চিনে নিচ্ছে তারা অনুমান কল্পনার বৃত্ত হতে বের হয়ে বাস্তবে বর্তমান খোদা দর্শন করে পথ প্রাপ্ত হচ্ছে । মারেফাত মানে বাস্তবতা। অনুমান কল্পনা হতে বের হয়ে চিরবর্তমানে কায়েম হয়ে যাওয়া।

যেমন, মাওলানা রুমী, তিনি কিচ্ছা কোরানের ভেদ তাঁর মুর্শিদ শামস তাবরীজের নিকট যখন চিনে নিয়েছেন তখন দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করলেন, ‘হাম জেকোরা মগজে রাবার দাস্তা, উস্তে খাঁ পেশে ছাগা আন দাখতাম’ অর্থাৎ আমি কোরানের মগজ উঠিয়ে নিয়েছি (আরবী কোরান চিনে নিয়েছি তথা কোরানের মুহকামাত বুঝে নিয়েছি তথা কোরানের বাস্তবতা চিনে নিয়েছি)। আর অস্তি চর্ম শৃগাল কুকুরের জন্য রেখে দিয়েছি। (যারা কোরানের মুহকামাত বুঝেনি তথা কিচ্ছা কোরানকেই আসল কোরান বুঝেছে তাদেরকে তিনি কুকুর সম্বোধন করেছেন)। যারা কোরানের মুহকামাত বুঝে নিজের মধ্যেই খোদাকে শনাক্ত করেছেন তথা চিনে নিয়েছেন তারাই হচ্ছেন পর্দামুক্ত মানুষ তথা আল্লাহর বান্দা তথা আবদুহু ওয়া রাছলুহু। এরা বহু হয়েও এক এবং আল্লাহর সাক্ষী তথা নূর আল্লাহ ।

এরাই হলো রব রহমান, যারা ঈমান এনেছে তাদের কাবা-কেবলা তথা লক্ষ্যস্থল তথা দিক। এই কাবাতে তাওয়াফ করে খোদার পরিচয় নিতে হবে তথা খোদাকে শনাক্ত করতে হবে। এই আল্লাহর ঘর কাবাতে যারা সেজদা করেনা তারাই হলো লানত প্রাপ্ত এবং কাফের তথা পর্দাবৃত। খফি মুহাম্মদরে ঘর এই মানব দেহ, এই ঘরের মধ্যে আরো চারজন – আলী, ফাতেমা, হাসান এবং হুসাইন; এরাই হলো ঘরের অধিবাসী তথা আহলে বাইয়্যেত। আর মুহাম্মদ (সা) কে নিয়ে হলো পাকপাঞ্জাতন (কোরান)। এই পাকপাঞ্জাতন কে? আল্লাহর হাস্তি হলো পাকপাঞ্জাতন আর পাকপাঞ্জাতনের নাস্তি হলো আল্লাহ। এখানে তিনি ‘আমরা’ বলে কোরানে জানাচ্ছেন (ওয়া নাহনু আকরাবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওরিদ)।

এই পাকপাঞ্জাতনের পাঁচ অজুদ নিয়ে মানব দেহই হলো একত্বের নিদর্শন। এখানেই খোদা ধরা দিলেন আর জ্ঞানীগণ চিনে নিলেন তাদের খোদাকে, বের হয়ে আসলেন অনুমান কল্পনায় খোদা বিশ্বাস হতে, চলে আসলেন আয়নাল ইয়াকিনে। দেখতে পেলেন আল্লাহ আর খোদা প্রভেদ হয়েও অভেদ হয়ে আছে মানব রূপে এসে। আরো চিনতে পেলেন আল্লাহ আলিফ লাম লাম হা এই চার অক্ষর নিয়ে মানুষের সাথে মিশে আছেন তথা মুহিত হয়ে আছেন (আলা কুল্লে শাইয়্যিম মুহিত)। এখান থেকেই আল্লাহপাকের জ্যোতির প্রকাশ ঘটছে (সুরা নূর ৩৫ নং আয়াত)। বে-মেছাল নূর তাঁর নূরের মেছাল দিলেন (মাছালু নূরীহি), দরশন যোগ্য করলেন এবং তাতে তাঁর নূরের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, ঈমানদারগণ চিনে নিলো এবং দেখে নিলো তাঁর খোদাকে। বললো, আমি একমাত্র আল্লাহর ই ইবাদত করি এবং তাঁরই সাহায্য চাই। (ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাইন)। ‘আরশে আলা’ তে খোদার ধ্যানে দিদারে ঈমানদারগণ কায়েম হলো তথা সেরাতুল মুস্তাকিমে কায়েম হয়ে গেলো।

সমস্ত মহাপুরুষগণ এ সিরাতুল মুস্তাকিমেই প্রতিষ্ঠিত আছে। এখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ঈমানদারগণের প্রার্থনা। মুমিনের ক্বলব আল্লাহর সিংহাসন, এ ক্বালব বুকের মাঝে নয়। ক্বলব তিনটি পর্যায়ে রয়েছে – যা তিন আরশ বলে সাব্যস্ত রয়েছে। এ তিন আরশে একেরই তিন রূপ -মুহাম্মদ, রাছুল, আল্লাহ।

আপন খবর