হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
পাক পাঞ্জাতনের প্রথম এবং শেষ ও বিশিষ্ট নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নূর সৃষ্টি সম্পর্কে হাদিসের বর্ণনা দেয়া হলো – জাবের রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে, একদিন আমি (জাবের) হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাছুল! আমার পিতা-মাতা আপনার উদ্দেশ্যে কোরবান হউক! আপনি এই খবরটি আমাকে জানিয়ে দিতে মর্জি ফরমাইবেন যে, আল্লাহপাক সর্বপ্রথম কোন্ বস্তু সৃষ্টি করেছেন? উত্তরে নবীজি বললেন, হে জাবের! আল্লাহ তা’য়ালা সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার পূর্বে তার নিজের নূর হতে নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহ তা’য়ালা এই নূরকে এমন শক্তি দান করলেন যে, সেই নূর আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর ইচ্ছায় যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারতো। ঐ সময় আরশ, কুরশী, লওহ, কলম, মানব-দানব ইত্যাদি কিছুই ছিল না [নূরে মোহাম্মদী ৩৭ পৃষ্ঠা, মাওয়াহিব ১ম খন্ড- ৯ পৃষ্ঠা]।
‘মুসলিম শরীফে’ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, একদিন হযরত জিবরাইল আলাইহিস্ সালামকে কথা প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম তাঁর বয়স সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তদুত্তরে হযরত জিবরাইল আলাইহিস্ সালাম বললেন, আমি শুধু এতোটুকু জানি যে, চতুর্থ আকাশে বা চতুর্থ হিজাবে একটি উজ্জল তারকা সত্তর হাজার বছর পর পর একবার উদয় হতো। অর্থাৎ সত্তর হাজার বৎসর উদিত অবস্থায় এবং সত্তর হাজার বছর অস্তমিত অবস্থায় ঐ তারকাটি বিরাজমান ছিল। আমি ঐ তারকাটিকে বাহাত্তর হাজার বার উদয় হতে দেখেছি। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বললেন, খোদার শপথ, আমিই ছিলাম ঐ তারকা। এ হাদিসটি তাফসীরে রুহুল বায়ানের ৩য় খন্ডে সুরা তাওবার ১২৮ নম্বর ‘লাকাদ জাআকুম মিন আনফুসিকুম’ এ আয়াতের তাফসীরে এবং সীরাতে হলবিয়া ২য় খন্ডে বর্ণিত আছে।
হাকেম বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম নবীজির নাম আরশ মোয়াল্লার উপর লিপিবদ্ধ দেখেছেন। আর আল্লাহপাক আদম আলাইহিস সালামকে এরশাদ করছেন, ‘যদি মোহাম্মদকে সৃষ্টি না করতাম তবে তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।’ আবার তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে, ‘লাওলাকা লা’মা খালাকতুল আফলাক’ অর্থাৎ (হে রাছুল) যদি আপনি সৃষ্টি না হতেন তবে আমি কিছুই সৃষ্টি করতাম না।
হযরত আলী ইবনে হুসাইন ইবনে আলী আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, “আমি (নবী) আদম সৃষ্টির চৌদ্দ হাজার বৎসর পূর্বে আমার প্রতিপালকের নিকট নূর হিসেবে বিদ্যমান ছিলাম”। (‘আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া’ এবং ‘আনোয়ারে মোহাম্মদী’ গ্রন্থসূত্রে বর্ণিত)
হাকেম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (হাকেম) একে সহীহ বলে সাব্যস্ত করেছেন – আল্লাহপাক ঈসা আলাইহিস্ সালামের প্রতি ওহী করলেন, নিশ্চয়ই আমি আরশকে পানির উপর সৃষ্টি করলাম। অতঃপর তা দুলতে থাকলো। অনন্তর আমি তার উপরে লিখে দিলাম “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ” ; অতঃপর তা স্থির হয়ে গেল। সৃষ্টির আদিতেই তাঁর নবুয়ত ঘোষণা হলো আলমে মলকুতে। নূরের কালিতে নূরের কলমে কালেমা আরশ মোয়াল্লায় অঙ্কিত আছে।
ইবনে যানজভীহ্ কাসীর ইবনে মুররা হাযরামী হতে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, “হাশরের দিন হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহ তা’য়ালা আনহুকে বেহেশতের উষ্ট্রীগুলোর মধ্যে একটি উষ্ট্রীর উপর পুনরুত্থিত করা হবে। সে ঐ উষ্ট্রীর পৃষ্ঠ থেকে আযান ফুঁকতে থাকবে। যখন নবীগণ ও তাঁদের উম্মতগণ “আশহাদু আন-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মোহাম্মাদুর রাছুলুল্লাহ” ধ্বনি শুনতে থাকবে, তখন তারা বলবে- আমরাও ঐ সম্বন্ধে সাক্ষ্য দান করি যে, নিশ্চয়ই মোহাম্মদ আল্লাহর রাছুল।” সমস্ত নবী ও তাঁদের উম্মতগণ একত্রে সাক্ষি দিবে যে, নিশ্চয়ই মোহাম্মদই আল্লাহর রাছুল ; এ কথার ভেদ রহস্য জানা দরকার। ভেদ বুঝতে পারলে এ কথার সত্যতা বর্তমানেই পাওয়া যাবে।
‘আহমদ’ ও ‘বায়হাকীতে’ হযরত এরবাজ ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহপাকের নিকট আমি তখন খাতামান্ নাবীয়্যিন নির্বাচিত হয়েছিলাম, যখন আদম আলাইহিস্ সালাম পয়দাও হয়নি।”
‘রাহমার্তু রাহীম’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহপাক হযরত জিবরাইলকে নির্দেশ দিলেন, তুমি হযরত ইসরাফিল কে নিয়ে জমিনে যাও এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নূরে শামিল করার জন্য এক মুষ্ঠি মাটি আহরণ করে নিয়ে আসো। জমিন রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের নাম শুনা মাত্র বিদীর্ণ হয়ে গেলো এবং কর্পূরের ন্যায় এক প্রকার শুভ্র পংক বা মাটি প্রকাশ হয়ে পড়লো। ঐ স্থানটি হলো যেখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামের ‘রঁওজা-ই-আতহার’ অবস্থিত। জিবরাইল সে মাটি নিয়ে নূরের সাথে মিশিয়ে দিলেন। তারপর তা দিয়ে খামির প্রস্তুত করে মেশক, জাফরান, সাম্বল, মায়ে-মায়ীন (পরিদৃশ্যমান প্রবাহিত পানি) ও বেহেশতের কর্পূর মিশ্রিত করলেন। তিনি পবিত্র অস্তিত্বের উপাদানকে মুক্তার ন্যায় স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল করলেন। এরপর তাকে ডুবালেন বেহেশতের নহরে। তারপর তিনি তা দেখালেন সমুদয় আসমান, ফেরেশতা, বেহেশত, জমিন, নদী, নদী-সাগর ও পর্বতমালা-কে। এরপর সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা সকলে তোমাদের রাব্বুল আলামিনের মাহাবুবের উপাদানকে চিনে লও, তিনি গুনাহগারের শাফায়াতকারী এবং আদমের সর্দার (নূরে মুজাসসাম- ১৪৬ পৃষ্ঠা)
মৌলবী আশরাফ আলী থানবী তার ‘নশরুত্তীব’ গ্রন্থের ১২ পৃষ্ঠায় হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত একটি হাদিস তুলে ধরেছেন তা হলো, হযরত জাবের আরজ করলো, ইয়া রাছুলুল্লাহ! কবে আপনি নবী নির্বাচিত হয়েছেন? নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বললেন, আদম আলাইহিস্ সালাম যখন রুহ এবং দেহের মাঝখানে ছিলেন, তখন আমার নিকট হতে নবুয়তের শপথ নেয়া হয়েছে। তিরমিযীর মধ্যে হযরত মায়ছারার বর্ণনায় এভাবে এসেছে যে, “আদম যখন কাঁদা এবং পানিতে মিশ্রিত ছিল তখনো আমি নবী ছিলাম।”
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহপাক যখন সমস্ত মাখলুকাত সৃষ্টি করলেন এবং পৃথিবীকে নীচু ও আকাশকে উচু করার ইচ্ছা করলেন; তখন তিনি তাঁর সৃষ্টি করা নূর হতে কিছু নূর নিয়ে বললেন – হে নূর, তুমি আমার হাবীব মোহাম্মদ হয়ে যাও। অতঃপর এই নূরে মোহাম্মদী হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের সৃষ্টির পাঁচশত বৎসর পূর্বে আরশ মোয়াল্লায় প্রদক্ষিণ করেছিল এবং বলতেছিল ‘আলহামদুলিল্লাহ’। তখন আল্লাহপাক বললেন- হে দোস্ত, এই জন্যইতো আমি আপনার নাম মোহাম্মদ রেখেছি [নূরে মোহাম্মদী- ৪৬ পৃষ্ঠা, নুজহাতুল মাজালিশ]
রাছুলপাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে যে, “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরী” অর্থাৎ আল্লাহপাক প্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিসটি আবদুল্লাহ ফারেস মাক্কী বরযালজী তার ‘কিস্সাতুল মাওলুদ’ কিতাবের শরাহ-তে বর্ণনা করেছেন। এ নূর হলো আল-কাদীম। সকল সৃষ্টির আদি হলো এ নূর। সৃষ্টির প্রথম অস্তিত্ব প্রকাশ হিসেবে এ নূর প্রকাশ। আর এ জন্য তা হলো সর্ব পুরাতন তথা কাদীম। এ নূর হতেই সৃষ্টি হলো মোহাম্মদ এবং এ নামের অংকনে অংকিত হলো মানুষের সুরত। তাঁর আসমানী নাম ‘আহামদ’ (মুজতবা) এবং জমিনে তাঁর নাম মোহাম্মদ (মোস্তফা)। তিনি আল্লাহর নিকটই মোহাম্মদ তথা আল্লাহপাক নিজেই তাঁর প্রশংসাকারী। যখন তিনি ‘আহামদ’ তখন তিনি প্রশংসাকারী। কারন, নূরের জগতে যখন তাঁর অস্তিত্ব প্রকাশ পায়, তখনই তিনি আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় এবং প্রশংসা করে বলেছেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ দ্বারাই আল্লাহপাকের আঠার হাজার মাখলুকাত সৃজন হয়ে চলছে এবং তিনিও তাঁর সৃজনের মাঝেই স্থিত। ওয়াহেদ আল্লাহ, আহাদ, আহামদ এবং মোহাম্মদ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ তেই নিহিত আছে। ‘তানাজ্জুলাত-ই-খামছা’ আলহামদুলিল্লাহর-ই গোপন ভেদ-রমুজাত এবং বিশেষ এক অবস্থায় তিনিই মোহাম্মদ তথা প্রশংসিত। এ জন্যই হাশরের দিন তাঁর পতাকার নাম হবে ‘লেওয়া-ই-হামদ’ এবং তিনিই হলেন ‘মাহমুদ’।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, রাছুল করিম সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলছেন, “তোমরা কি আশ্চর্যান্বিত হও না যে, কি প্রকারে আল্লাহ আমাকে কোরাইশগনের গাল (গালিগালাজ) ও লানত হতে মুক্ত রেখেছেন। তারা গাল দিয়ে থাকে ‘মুজাম্মাম’ (অতি নিন্দিত) কে, তারা লানত করে থাকে ‘মুজাম্মাম’কে। অথচ (আল্লাহর নিকট) আমি মোহাম্মদ।” মোহাম্মদী স্তরকেই বলা হয় ‘মাকামে মাহমুদ’ তথা প্রশংসিত স্তর বা মাকাম। দ্বীনে মোহাম্মদী হলো তা-ই যে দ্বীনের মাধ্যমে ‘মাকামে মাহমুদে’ অধিষ্ঠিত হওয়া যায়। আর মোহাম্মদ ব্যতিত এ মাকামে কারো প্রবেশাধিকার নেই। এ স্তরে আল্লাহপাকের পরিচয় এবং দিদার লাভ হয়। এ জন্যই দ্বীন ইসলাম মিল্লাতে ইব্রাহীমের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে। মিল্লাতে ইব্রাহীম হলো খোদাকে দেখে বিশ^াস করা। যাদের দিব্যদৃষ্টি আছে তাঁরা চিনে কে মোহাম্মদ রাছুল। যিনি আসমানে ‘আহামদ’ এবং তিনিই শেষে জমিনে মোহাম্মদ এবং এ মোহাম্মদের মাঝেই গোপন আছে খোদার মহিমাময় নাম তথা ‘ইসমে আজম’। হাদিস কুদসীতে আল্লাহপাক বলেন, “নিশ্চয়ই আমি আমার ওপর কসম করেছি যে, যার নাম ‘আহামদ’ তাকে আমি দোযখে দাখিল করবো না এবং যার নাম ‘মোহাম্মদ’ তাকেও না।” মনে রাখতে হবে কোনো মানুষের নাম আহামদ বা মোহাম্মদ রাখলো তার সেজন্যই আল্লাহপাক তাকে জান্নাতে দিয়ে দেবেন তা অবশ্যই নয়। ‘আহামদ’ আর ‘মোহাম্মদ’ এর ভেদ জানলে উক্ত হাদিসের মর্ম বুঝা যাবে। আর উক্ত হাদিসের ভেদ তারাই জানতে পারে যারা দ্বীনে মোহাম্মদীতে দাখেল হয়েছে বা দ্বীন ইসলামে দাখেল হয়েছে তথা ওলীয়ম্ মুর্শিদের নিকট আনুগত্য স্বীকার করছে।
হাদিস কুদসীতে আল্লাহপাক বলছেন, “খালাকতু মোহাম্মাদান মিন নূরে ওয়াজিহিয়ান্” অর্থাৎ আমি মোহাম্মদকে সৃষ্টি করেছি আমার চেহারার নূর হতে [সিররুল আসরার – ৩ পৃষ্ঠা]।