ছালমা আক্তার চিশতী
আমাদের সমাজের মাঝে দেখা যায় কিছু লোক তরিকার নাম নিয়ে অনেক তরিকত বিরোধী কর্মকান্ড করে থাকে। যেমন- তারা মনে করে বায়াত না হয়ে পীরমুর্শিদের নাম স্মরণে থাকলেই হবে। এই বিষয়টি তারা বুঝে না যে, তারা কত বড় ধোঁকার মাঝে পরতেছে। কারণ, তাদের মাথাটি দেখতে মানুষের মাথার মতো হলেও তাদের মাথার চিন্তা চেতনা গুলো নিন্মস্তরের, তরিকত শূণ্য। আমার মুর্শিদ তাঁর আলোচনার মাঝে এই উপমাটি তুলে ধরে- গিট্টু ছাড়া কাঁথা সেলাই করা, ঠিক তেমনি দশা হয় এই ধরনের লোকদের।
কোরানের মাঝে সূরা কাহ্ফ ১৭নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন- “আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন সে-ই হেদায়াত প্রাপ্ত হয় ; যাকে তিনি বিপথগামী করেন, সে ওলিয়ম মুর্শিদ (পথপ্রদর্শক) পাবে না।” কারণ, মুর্শিদ নিজেই ঈমান এবং তাঁর নিকট মুরিদ হওয়াটাই হলো ঈমানদার হওয়ার প্রমাণ (আল্লাহর অনুমতিক্রমে ঈমান আনা হলো- সুরা ইউনুস – ১০০) এবং ঈমানকে সরল মনে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়িয়ে ধরে রাখা হলো সৌভাগ্যের বিষয়; মুক্তির পথ ইহাই ঈমানদারগণের প্রতি আল্লাহর দয়া-করুণা। যারা গুরুর আশ্রয়ে আসেনি আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান নেই, তারা পথভ্রষ্ট। নবী-রাছুলগণই মানব গুরু, বেলায়েতে আল্লাহর ওলিগণ। নমরুদ, ফেরাউন, সরদার সউদ, আবু জাহেল, আবু লাহাবগণ কোনো যুগেই গুরুকে মানে নি/মানে না। যারা গুরুর আনুগত্যে না এসে অমুকের-তমুকের আশেক সেজেছে তারাও এক ধরণের বস্তুবাদি জিনগ্রস্থ মানুষ, দুনিয়ার মানুষ। এরা আশেক-মাশুকের নাম নিয়ে অশ্লীল পথে ধাবিত হয়ে চলছে। যারা শুধু দুনিয়ার আশা করে তারা হলো দুনিয়া মুখি মানুষ। কারণ, দুনিয়া মানেই হলো ছয় রিপু বা আমিত্বের মাঝে ডুবে থাকা মানেই বস্তুবাদী হওয়া। সুতরাং যারা দুনিয়ার সুখ সন্ধানেই রতো আছে তাদের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘তালিবুদ্দুুনিয়া মরদুদ/মুয়ান্নাছ।’ অর্থাৎ দুনিয়ার সুখ সন্ধানীগণ মরদুদ শয়তান/নারী। গুরু ব্যতীত জগতের আর সমস্তই নারী। নারীর জান্নাত নেই, মুক্তি নেই ; এরা দুনিয়াতে আবদ্ধ হয়ে সিজ্জিনে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। গুরুর/জগত স্বামীর নিকট নিকাহ (বায়াত)-এর মাধ্যমে বস্তুমোহ (নারীত্ব) হতে মুক্ত হয়ে পুরুষত্ব অর্জন করলে মিলবে জান্নাত। নারীত্ব হতে বের হয়ে পুরুষত্ব অর্জন হলে তার জন্য চার বিয়ে করা ফরজ, সে দৈহিক নারী-পুরুষ যে-ই হোক। সে নারী প্রত্যেকের সাথেই আছে।
মন আখেরাত মুখি না হলে দুনিয়ার কর্ম বা ইবাদত করাটাও পাপ হবে। ছয় রিপুকে ধারণ করে যত কর্ম করা হউক তা মূল্যহীন। যেমন- ময়লা ভর্তি কন্টিনারের মাঝে কেউ খাবার রাখবে না, তেমনি মানুষের অবস্থান দীলের কন্টিনারে যদি ময়লা থাকে তবে আর খোদার নূরের জ্যোতি তার মাঝে প্রকাশ পাবে না। ‘মকতুবাতের’ ২য় খন্ডের ৬৫ পৃষ্ঠায় ১৮৭ নং মকতুবাতে বর্ণিত আছে যে, হযরত খাজা আহরার রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু স্বীয় পুস্তকে লিখেছেন যে, “পীরের ছায়া অর্থাৎ তাছাওর বা ধ্যান আল্লাহর জেকের হতেও উৎকৃষ্ট।” হযরত শায়েখ আহামদ শেরহিন্দি রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলছেন, “পীরে তাস্ত আউয়াল মাবুদ তাস্ত” অর্থাৎ তোমার পীরই হলো তোমার প্রথম মাবুদ। নিজ পীরকে এই রূপ জানতে না পারলে ইবাদত বন্দেগী বিফল হবে, মানব জনমটা হবে অসার। অসার জিন্দেগী আখেরাতকে ধংস করে দেয়। যারা দুনিয়ার সৌভাগ্যের আশা করে বা দুনিয়ার মান-মর্যাদার কথা ভেবে আখেরাতের কর্ম হতে বিরত/দূরে থাকে বা সরে যায় তারাই বিপথগামী/দোযখগামী হবে। তাদের তকদির তারা নিজেরাই তৈরী করে নেয়। তারা এমন কর্মে লিপ্ত হয় যা জীব জন্তুদের কর্মের মতো, জীব জন্তুরা তাদের ভিতর বাহির এক করে চলা ফেরা করে আর যারা এই রূপ মানবীয় অজুদ ধারণ করে পশুর স্বভাবটা ধারণ করে রেখেছে তারা জঙ্গলের জীব/জন্তুর থেকেও অধম।
আল্লাহকে পাওয়ার আশা করা এবং আল্লাহকে পেতে হলে ভিতর বাহির এক করে গুরু ভজন করতে হবে। যারা গুরুর নির্দেশিত পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে তারা মানব জনমে মুক্তি লাভ অবশ্যই করবে। কথায় বলে, গুরু থুইয়া যে গোবিন্দ ভজে সেই পাপী নরকে যাবে। ফকিরী নাম ধরে সাধনার নামে এক ধরনের লোক আছে তারা চন্দ্র সাধনার নামে নানা কিছু আহার-বিহার করে, ইহা মাত্রই তরিকার কাজ নয়/মানব ধর্ম নয়। এরা চরম ভাবে বিভ্রান্ত। তারা নিজেরাই পোলাও, মাংস রেখে পায়খানা, প্রশ্রাব, রজ, বীর্য ইত্যাদি সাধনার নামে খেয়ে থাকে। কারণ, এই ধরনের সাধারণ বিষয়টি বুঝার মতো জ্ঞানও তাদের নেই। তাতে তাদের মানবাত্মা হারিয়ে পশুত্বের জগতে নেমে যায়/আসফালাস সাফেলিন হয়ে যায়। সাধনার প্রথম স্তরই হলো জিনগ্রস্থ হতে ইনছানে উত্তীর্ণ হওয়া আর ইনছান আল্লাহর মধ্যে ফানা হয়ে চির স্বাধীনতার জগতে বাকা হয়ে যায়। এ জন্য একজন মুক্তিকামী মানুষের সব কর্মের মূল হলো বায়াত হওয়া।
গাউছেপাক হযরত আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তাঁর ‘আল ফাতহুর রাব্বানী ওয়া ফায়জুর রাহমানী’ কিতাবের ৮৫ পৃষ্ঠায় বলছেন, ‘নেককারদের বা ইনছানুল কামেলদের খেদমতে থাকা যদি তোমার সম্ভব হয়, তবে ইহাই তোমার জন্য ইহকাল ও পরকালে মুক্তির জন্য শতগুণে শ্রেয় হবে’। সুতরাং তারাই হতভাগা যারা গুরুর সান্নিধ্য হতে ইচ্ছাকৃত ভাবে দূরে আছে/গুরু সংযোগ হতে বিচ্ছিন্ন আছে। যেমন- আমরা রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের মাঝে মশারী টানিয়ে থাকি। মশারী টানানোর কারণ হলো মশায় কামড়াবে। এই পাঁচ বস্তু দিয়ে গড়া দেহটাকে সেবা যত্ন করতেছি। তেমনি মন একদিন ভেবে দেখেছে কি এই মাটির দেহের মাঝে আল্লাহর নূরের দেহ যে লুকিয়ে আছে তার মাঝে মশারী লাগানো হয়েছে কিনা। এই নূরের দেহের মশারী লাগাতে হলে গুরুর জ্ঞানের আলো/জ্যোতি লাগবে। আপাদ-মস্তক গুরু নিজেই নুর এবং গুরু হতে আগত জ্ঞানটাই হলো জ্যোতি। এই জ্যোতির্দেহের অধিকারী হতে হলে আমিত্বের আবরণ খুলতে হবে। আর এই আবরণ খুলতে হলে অনুরাগের বাহনে বসতে হবে। কারণ, অনুরাগ ছাড়া এই আবরণ খোলা যায় না। যেমন- ঘরের মাঝে জানালা থাকে যার ঘর সে জানালার মাঝে পর্দা দিয়ে থাকে যাতে কোন মানুষ ঘরের ভিতরটা দেখতে না পারে তেমনি ছয় রিপু পর্দা হয়ে একজন অচেতন মানুষের দীলের জানালাগুলোকে বন্ধ করে ফেলে। এই বন্ধ জানালাগুলো খুলতে হলে গুরুর নূরের আলো লাগবে। বোখারী শরীফের ৫ম খন্ডের মাঝে বর্ণনা করা হয়েছে- “পার্থিব স্বার্থপূরণ না হলে যারা বায়াত ভঙ্গ করে আল্লাহপাক তাদের প্রতি হাশরের দিন তাকাবেন না।” কারণ, ব্যক্তিস্বার্থ থেকে সকল পাপের জন্ম হয়। দুনিয়া নিয়ে গুরুর দরবারে যাওয়াটাই হলো পাপ।
কিছু সংখ্যক মানুষ ব্যতিত সবই এই ভুলগুলো করে থাকে। যারা ভুল করে তারা মানব জনম হারানোর দিকে ধাবিত হয়। কারণ, দুনিয়ার পূজারীগণ আখেরাত হারাবে এইটাই স্বাভাবিক। যারা স্মৃতির পাতায় অমর হয়ে রয়েছে তারা অনেক দুঃখ যাতনা পার হয়ে এই বিপদ সংকুল রাস্তা পারি দিয়েছে। যারা অচেতন অর্থাৎ গুরুর কালাম শ্রবণ করেনি সামনে বসেও গুরুর কালাম শুনতে পায়নি তারা এই ভয়ংকর বিপদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আলমে নাছুতের সাগরে ডুবে যাবে ; শেষে সুরত বদল হয়ে হাশরে তাদের উত্থান ঘটবে। কারণ, তাদের শ্রবণ শক্তিকে ইবলিশের নিকট ধার দিয়েছে। তাই কান থাকলেও গুরুর পবিত্র কালামগুলো শ্রবণে আসেনি। দেলের দ্বারা কালাম উপলদ্ধি করেনি। তারা পশু আকৃতিতে হাশরে উঠবে (সুরা হিজর)। আল্লাহর দেওয়া সাতটি নূরি সেফাতকে জাগ্রত করতে না পারলে গুরুর করণ করা যাবে না কারণ, এই সাত সেফাত সব মানুষের মাঝে রয়েছে যারা গুরুকে ধারণ করবে তারা এই নূরানী সেফাতগুলোর হেফাজত করবে আর যারা মুর্দার তারা এই নূরের অবস্থানে জুলমাত এনে অন্ধকার দ্বারা সেফাতগুলোকে ঢেকে দিবে। কারণ, একজন মানুষের মনে অহরহ অন্ধকার এসে পূর্ণিমার চাঁদের (মানব সত্তাই চাঁদ) আলোকে ঢেকে ফেলে। এই চাঁদের আলোটা যে কি তা জ্ঞানীগণ বুঝেন। একজন জ্ঞানীর কাছে গিয়ে নফসের প্ররোচনায় অচেতন থাকাটা দুর্ভাগ্যের বিষয়।
এই দূর্ভাগ্যকে সৌভাগ্য করতে হলে আল্লাহর দেওয়া খাস নাম আলিমুন দ্বারা নফসকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। যার আলিমুন জাগ্রত সে ভাল/মন্দ প্রভেদ করতে পারবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর পবিত্র কালাম শুনিয়েছে তা অর্জুন শ্রবণ করে, গুরুর দেওয়া সেই কালাম অনুযায়ী যুদ্ধ করে জয় লাভ করেছে। গুরু অচেতন ভক্তকে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়ে চেতন করে। হযরত খাজা বাবা গরীবে নেওয়াজ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তাঁর ‘দেওয়ান-ই-মঈনুদ্দীনে’ বলছেন, “খাওয়াহিকে রাখম বানিদার বেহারা মান বানগরমান আয়না ওয়েম ও সিত্ খোদা আজ মান” অর্থাৎ তুমি যদি খোদার মুখ দেখতে চাও তা হলে আমার চেহারার দিকে তাকাও। আমি তার আয়না, সে আমা হতে আলাদা নয়। যারা গুরু প্রেমিক তাদের হাল হাকিকত আলাদা। তারা এই মায়াময় জগতে বাস করেও এই মায়া থেকে নিজ মনকে দূরে রাখে। আর যারা গাফেল তারা মনকে বিষয় মোহের মাঝে বেঁধে রাখে। কারণ, তারা বুঝতে পারে না এই কাজগুলো কার। মহা মনের অধিকারী না হতে পারলে গুরু সেবা করা যায় না। আর মহা মনের অধিকারী তখনই একজন মানুষ হয় যখন সে পর্দা মুক্ত হয়। আয়নার মাঝে রূপ দরশন করতে হলে আমিত্বের খোলস হতে নিজ অস্তিত্বকে বের করে নিতে হবে তবেই ইরফানী আয়নার মাঝে রূপ দরশন হবে। যারা একত্ববাদে বিশ্বাসী তারা প্রবৃত্তির পুজা করবে না।
কারণ, তারা মানব ধর্ম ইসলাম ধারণ করার অবিরাম চেষ্টা সাধনা করতেছে। একজন মুরিদের মনের খবর গুরু জানেন কারণ, গুরুর অন্তর্দৃষ্টি খোলা। গুরু একজন মুরিদের ভিতর বাহির দুইটি অবস্থাই দেখতে পায়। যে ব্যক্তি পার্থিব স্বার্থপূরণ করতে গিয়ে গুরুকে ভুলে যায় সে আল্লাহর অশেষ রহমতের দরজা হতে বের হয়ে জাহান্নামের দরজায় অবস্থান করে। গুরুর আশ্রয়ে থাকাই জান্নাতের দরজায় অবস্থান করা। যেহেতু মানবগুরুর হাতে বায়াত মানেই আল্লাহর হাতে বায়াত (সুরা ফাত্তাহ-১০) বিধায় গুরু ত্যাগ করা বা বায়াত ভঙ্গ করা আল্লাহর নিকট হতেই ঈমান ত্যাগ করা। এরাই কাফের হয়ে যায়। যেমন, একজন চেতন মানুষ খাবার প্লেটে নিয়ে খায় আর একজন অচেতন মানুষ সে নিজেকেই হায়ানী আত্মার খাবার হিসেবে সাজিয়ে রাখে। তার এই অবস্থার থেকে বুঝা যায় সে কতটা অচেতন। সে বুঝতে পারে না সে কতটা ভুলে আছে/ভুল করছে। কারণ, সে নিজে নিজেই হায়ানীয়াতের ফাঁদের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কারণ, গুরু ব্যতীত আর সমস্তই দুনিয়া। গুরুর প্রতি যার পূর্ণ ঈমান নেই অথবা পার্থিব স্বার্থের জন্য যারা গুরুর সঙ্গ/ঈমান ত্যাগ করে তারা আখেরে অবশ্যই মানব জনম হারাবে/জাহান্নামী হবে। এ জগতে নফস দ্বারা অর্জিত আমলের ফলাফলটা এই রূপ হবেই। শত নামাজ, রোজা, তসবিহ ইত্যাদিতে রতো থাকলেও।