ছালমা আক্তার চিশতী
অনুরাগ বিহীন হায়ানীয়াতময় অন্তর হলো একটি চিড়িয়াখানার সমতুল্য। কারণ, চিড়িয়াখানার খাঁচার মাঝে সব জীব-জন্তু বাস করে। মানুষের দীল পরিশুদ্ধ না হলে ঠিক চিড়িয়াখানার মতো তার দীলের অবস্থানটি হয়। দুনিয়ার লোভ ও মোহের সুতাগুলো এতই শক্ত যে, মুক্তির দর্শনের আহ্বানটি কানে ও হৃদয়ে প্রবেশ এবং আঘাত করতে পারে না। একজন মানুষের ভুল-ভ্রান্তি গুলো কাটাতে হলে মনকে কাঁদা মাটির মতো করতে হবে।
যেমন, যখন বাচ্চা ছোট থাকে কথা বলতে পারে না তখন মা বাচ্চাটিকে কথা বলা শিখায়, তেমনি গুরু তাঁর একজন শিষ্যকে তরিকত জগতের কথা বলতে বলতে তাকেও তাঁর মতো কথা বলা শিখিয়ে থাকে এবং সে কালামের মাধ্যমেই জ্ঞানালোক ভক্ত মনে আলো সৃষ্টি করে। আদব, নম্রতা থাকলে একজন কামেল ইনসানে পরিণত হওয়া যায়। কারণ, তরিকত দেশের মূল হলো এই আদব, নম্রতা, তমিজ-তাজিম। গুরুর নিগুঢ় ভাবের দরিয়ার মাঝে যদি লাফ দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তবে আদব, নম্রতার নূর লাগবে। যেমন, একটি কাঠের টুকরাকে যে কোন ফার্নিচারের রূপ দেওয়া যাবে তেমনি একজন শিষ্য যদি এই রূপে থাকতে পারে তবে গুরু তাঁর মনের মতো করে শিষ্যকে ভক্তের আকার দিতে পারবে। যারা মোল্লা পীরের পাল্লায় পড়ে শুধু দোয়া-দরূদ পড়েই ছোয়াবের ব্যাবসা করছে তারা মনে করে শুধু এই দোয়াগুলো পড়লেই আখেরে মুক্তি মিলবে এই ধরনের ধারণাগুলো ভুল। কারণ, মোল্লারা জানে কিভাবে একজন মানুষের গিবত করতে হয়।
আমার নিজ চোখে দেখা এক কওমি মোল্লা ছোট ছোট বাচ্চাদের থেকে তথ্য নিয়ে পীর-মুর্শিদের গিবত চর্চা করে থাকে। সে আর ভাবলো না সে যে কত বড় জঘন্য কাজটি করতেছে। এর দ্বারা সে তার নিজের আখের সিজ্জিনে অবস্থান করার রাস্তা তৈরী করে নিচ্ছে। কওমি খারিজি মোল্লারা পীর/গুরুর পিছনে এই ভাবে লেগে থাকতে পারে তা প্রমাণ সহকারে আমি নিজেই অনেকবার দেখেছি। যেমন, কেউ কারো সাথে ঝগড়া করলে সে স্বাভাবিক ভাবেই যার সাথে ঝগড়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকবে কিন্তু মোল্লাদের অবস্থা ঠিক বিপরীত। তারা কোন কারণ ছাড়াই একজন মানুষের বিরুদ্ধে খারাপ বক্তব্য পেশ করবে। কারণ, এটা হলো মোল্লাদের বিকৃত স্বভাবের ফলাফল, হয়তো বা তাদের শিক্ষার কুফল। তাদের এই স্বভাব দ্বারা জাহান্নামের টিকেট বিনা মূল্যে কিনে নিচ্ছে। আধ্যাত্মিক জ্ঞানীগণ আলেম- মোল্লাদেরকে ঘৃণা করে থাকে, এই ঘৃণাটা ব্যক্তি হিসেবে নয়, ঘৃণা করার কারণ হলো তারা আক্ষরিক বিদ্যা বা ইলমুল কালামকেই ধর্ম জ্ঞান বুঝিয়ে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে চলছে। আর তাদের এ কু-স্বভাবটি (গুরু/পীর/ফকিরদের বিরুদ্ধে) এমন যে তারা (চৌদ্দ আনা) জান ত্যাগ করতে রাজি কিন্তু তার এই গিবত করার স্বভাবটি ছাড়তে রাজি না। সে এই গিবত করাকে ভাবতেছে জান্নাতি সুখের মতো আবার এই বেলেহাজ মোল্লারাই বলে থাকে গিবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য। ফতোয়া অন্যের জন্য কিন্তু নিজের জন্য কোন ফতোয়া নেই। কারণ, ব্যক্তি স্বার্থ থাকলে বিবেক জাগ্রত থাকে না। দেখা যায় তারা সব সময়ই মৃত ভাইয়ের মাংস খেয়ে থাকে। গিবত করাটা হলো তাদের নেশার ন্যায়। কারণ, গিবত না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। যারা অন্ধ তারা এই ওহাবী-খারিজি মোল্লাদের পাল্লায় পরে গোল্লায় যাচ্ছে/পথভ্রষ্ট হচ্ছে। আর যারা গুরুর নিকট বায়াত না হয়েই যারে তারে গুরু দাবী করছে-ওরা এক ধরনের মস্তিষ্ক বিকৃত পাগলের মতো। তাদেরও কোনো বন্দেগী আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
হযরত আবুল হোসেন খেরকানী (র.) বলছেন- “অনেক লোক ভূমির উপর বিচরণ করে, কিন্তু তাহারা মৃত। আর অনেক লোক ভূমিগর্ভে শায়িত, কিন্তু তাঁরা জীবিত”। এই অবস্থাটি একজন গুরু বুঝতে পারেন। কারণ, অন্তর্দৃষ্টি দ্বারাই তা উপলব্ধি করা যায়। এমনও ব্যক্তি দেখা যায় তরিকতের দোহাই দিয়ে স্বপ্নে খেলাফত পেয়েছে বলে দাবী করে পীর সেজে গেছে। যে স্বপ্নের দোহাই দিয়ে পীর সেজেছে সে তো মরবেই (মানব জনম হারাবে), সাথে যারা এ ধরনের খোয়াব নামা পীরের পিছনে লেজ তুলে দৌড়াচ্ছে তারাও আলমে নাছুতের সাগরে ডুবে মরবে। কারণ, এ দু’টির একটারও মানব ছুরত ঠিক থাকবে না। অনেক আলেম-মাওলানারা মাদ্রাসার বিদ্যা শিখে বা মসজিদে চাকরী করে পীর/গুরু দাবী করছে, তারাও বাতিল বা নাকেছ পীর। পীর হওয়াটা কি সোজা কথা। ইলমে এলাহী বা ইলমে মারেফাত/ইলমে গায়েব যার জানা নেই সে কখনো পীর/গুরু হতে পারে না। কেউ কেউ নিজে বায়াত না হয়েই পীর সেজেছে, কেউবা গাঁজা খেয়ে লাল কাপড় পড়ে ফকির/সাধু ইত্যাদি উপাধি নিজের নামের সাথে ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারণা করে চলছে। আমাদের এলাকায় এ ধরনের বেশ কিছু লোক রয়েছেÑযারা কোনো পীরের নিকট বায়াত/মুরিদই হয়নি অথচ পীর সেজে আছে। তাদের মধ্যে কেউবা ওরশ শরীফও করছে। এরা ওহাবীদের চেয়েও ভয়ংকর। খোদার ভয় যদি বিন্দু পরিণাম দীলে থাকতো তবে আর এই রূপ কর্মকান্ড করত না। তাদের দ্বারাই সমাজে তরিকতের বিভিন্ন মতভেদের সৃষ্টি হয়ে থাকে/সমালোচনার কারণ হয়ে থাকে। কারণ, তরিকতের মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে আইনুল ইয়াকিন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাঝে। যখন এমকান ও ওয়াজেব এক দরশন হয় তখন মানুষের সাধনায় সিদ্ধি অর্জন হয়।
যাদের গুরুর ঠিকানা নেই/বায়াত হয়নি তারা যতই তরিকতের নাম দিয়ে দোয়া-দরূদ, তসবিহ জপবে তার কোনোই পূণ্য লাভ হবে না, বরং জাহান্নামের দরজার দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে। আহাম্মকগুলো সে ভেদ জানে না/বুঝে না। কারণ, ভক্তের মুক্তির জন্য গুরুর সন্তুষ্টি অর্জন হলো সর্ব উৎকৃষ্ট দয়া-করুণা। আমার মুর্শিদ কেবলা হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী (র.) তাঁর একটি গানের মাঝে বলছেনÑ ‘বেদ, কোরান, বাইবেল, গীতা সকলের মূল মুর্শিদ তোমার ভজন কর তার।’ এই মায়ার জগত থেকে বাহিরে যেতে হলে একনিষ্ঠ চিত্তে মুর্শিদের আনুগত্যময় অনুসরণ করতেই হবে। সমস্ত শাস্ত্র-বিধানের উপরে আছে মুর্শিদ/গুরু, তাঁর থেকেই সমস্ত শাস্ত্র-বিধান আগমন ঘটে। দেখা গেছে আগে এই জগতের মাঝে মানুষ এসেছে তার পর তার উপরে আসমানি কিতাবগুলি নাজিল হয়েছে। এই কথার ভেদ রয়েছে তা একমাত্র একজন মুর্শিদই বলতে পারেন। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (র.) বলছেনÑ ‘সমস্ত কিছু ত্যাগ করে তুমি কোন কামেল ওলীর গোলাম হয়ে যাও, তবেই তুমি ধর্মের স্বাদ গ্রহন করতে সক্ষম হবে।’ আমাদের মতো ভক্তি-ভজনহীন সাধারণ মানুষের জন্য গোলাম হওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। যেমন, একটি পুকুরের মাঝে মাছ থাকে পুকুরের পানিগুলো যদি ময়লা থাকে তবে মাছগুলো মরে যাবে তেমনি তরিকত জগতটা পুকুরের পরিষ্কার পানির ন্যায়।
তরিকতের নাম দিয়ে বিভিন্ন মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ায় অথচ দেখা যায় তাদের পীর অথবা মুর্শিদের খবর নেই অথবা গুরুর প্রতি তাদের তেমন কোনো ভালো ঈমান বা ধারণা নেই। যার পীর নেই তার পীর হলো শয়তান। গুরু ব্যতীত অন্য কিছুকে গ্রহণ করা একজন ভক্তের জন্য হারাম। আমার মুর্শিদ কেবলা হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশ্তি নিজামী তাঁর আলোচনার মাঝে বলতে থাকেÑ যার ঘরে চাল আছে সে আর ভিক্ষা করতে কোথাও যাবে না। যারা ঘরে চাল রেখে ভিক্ষা করে তা তাদের স্বভাব দোষেই করে। তেমনি যার পীর রয়েছে (যে নিজেকে গুরুর নিকট পরিপূর্ণ সমর্পণ করেছে) সে আর পীরের অনুমতি ছাড়া বিভিন্ন মাজারে/নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াবে না। কারণ, যার জন্য বা যাকে দেখার জন্য নানা স্থানে ঘুরবে সেতো তারই গুরু/মুর্শিদ! পীরবিহীন লোক হলো মুর্দা, ঈমানশূন্য। যখন একজন মানুষ বায়াত হয়ে যায় তখন তার সব কর্মের মূলে থাকবে পীর, পীরের অনুমতি ছাড়া চলাটা হবে অসার। যেমন, আমরা রাস্তা দিয়ে পথ চলতে থাকি ঐ পথের মাঝে যদি বাধা আসে তবে আর আমরা পথ চলতে পারব না তেমনি একজন মানুষ যখন বায়াত হয় তার পথের মাঝে শয়তান সর্ব অবস্থায় বাঁধাস্বরূপ এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এই শয়তানকে চিনতে হলে গুরু জ্ঞানের আলো লাগবে।
গুরু জ্ঞানের আলোর অধিকারী হতে হলে মুর্শিদের হুকুম আহকাম মেনে চলতে হবে। যে সেই হুকুম আহকাম মেনে চলতে পারে ঐ ব্যক্তি আলোর সন্ধান পাবে। যে নিজ প্রবৃত্তি বা স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পরেনি সে জুলমাতের মাঝে আটকা পরে যাবে। দীলের অন্ধত্বকে যে আঁকড়িয়ে ধরে রাখে সে এই মায়া জালের মাঝে পরে হাবুডুবু খাচ্ছে। যারা গুরুর অনুগামী হবে তারা সবুজ রঙ্গের বৃক্ষরূপ ধারণ করবে। একই জায়গায় ভালো মন্দের অবস্থান। ভালো মন্দের দুইটি রং রয়েছে একটি কালো এবং আরেকটি হলো সাদা। যারা গুরুকে রেখে গোবিন্দ ভজে তারা কালো রঙ্গের অজুদ ধারণ করবে। আর যারা গুরুকেই মূল হিসেবে ধারণ করবে তারা সবুজ বৃক্ষস্বরূপ জ্যোতির অধিকারী হবে।
আমার মুর্শিদ কেবলা কাবা হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী বলছেন-
“যাঁরা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত তথা সিবগাতাল্লাহয় ভূষিত তথা প্রভুসত্তার বৃত্তিতে সিক্ত, তারাই হলো ধার্মিক”।