হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
‘নূর নামা’ কিতাবে বর্ণিত আছে আল্লাহপাক নূরনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লামকে সৃষ্টি করার পর একদিন আল্লাহপাক বললেন, “হে আমার হাবিব! আমি চারটি জিনিস সৃষ্টি করেছি আর তা হলো –
১। মাটি
২। পানি
৩। আগুন ও
৪। বাতাস
এর মধ্যে হতে একটাকে আপনার অধিকার করতে হবে, বাকি তিনটার শুধু প্রভাবই থাকবে। এর একটা দিয়ে আমি মানবজাতি সৃষ্টি করবো এবং বাকি তিনটিও তাতে সংমিশ্রণ থাকবে। আপনার যে কোনো একটা পছন্দ করতে হবে। আল্লাহপাকের এ কথা শুনে আল্লাহর হাবিব আরবা আনাছের মধ্যে প্রথমে ‘পানির’ নিকট গেল। নূরনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম দেখলো পানি ধ্বংসের নেশায় ভরপুর। হাবিবে খোদা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম তখন পানিকে দেখে বললেন, আচ্ছালামু আলাইকুম। পানি জবাব দিল, ওয়া আলাইকুম ছালাম বলে। পানি জানতে চাইলো আপনি কে ? নূরনবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বললেন, আমি আল্লাহপাকের সৃষ্টি। তুমিও তাঁর সৃষ্টি। শোন হে পানি! আল্লাহপাক এক জগৎ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাকেও সেখানে থাকতে হবে, তোমার এ ইচ্ছা ত্যাগ করো। আমাদের ইচ্ছা বলতে কিছু রাখা ভালো নয়। আল্লাহর ইচ্ছাই ইচ্ছা। আল্লাহকে খুশী করাই আমাদের কাজ, তুমি এখন তোমার দোষ-ত্রুটিগুলো জানো। পানি বললো, আপনি বলুন আমার কি দোষ-ত্রুটি আছে। নূরনবী বললো তোমার মাঝে ধ্বংসের গৌরব আছে, তুমি তা ত্যাগ করে পবিত্র হও। কারণ, তোমার দ্বারা আল্লাহপাক দুনিয়ার সব কিছু পবিত্র করবেন। তোমাকে ছাড়া দুনিয়াতে কোনো জীব বা অন্যান্য কিছুই বাঁচবেনা। তোমাকে পাক করবে বাতাস।
নূরের কথা শুনে পানি খুশী হলো এবং কালেমা শাহাদাত পড়ে মুসলমান বা আত্মসমর্পণকারী হয়ে গেল। এবার আল্লাহপাকের হুকুমে নূর গেল বাতাসের নিকট। এখানেও ছালাম বিনিময়ের পর নূর জানতে চাইলো বাতাসের কি গুণ আছে। বাতাস বললো আমি সব উড়িয়ে ধ্বংস করে দিতে পারি। আর আমাকে দুনিয়ায় নিলে আমার যা ইচ্ছা তা-ই করবো। নূর তখন বললো, হে বাতাস, তুমি তোমার গৌরব নিজ ইচ্ছায় পরিত্যাগ করো, একমাত্র আল্লাহই আমাদের প্রভু, তাঁর ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা হওয়া উচিত অন্যথায় আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। এখন তুমি তোমার গৌরব ছাড়। তাহলে পৃথিবীতে যেয়ে খুব গুণী হতে পারবে। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি জীব তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। তুমি কাহারো নজরে পড়বে না। এভাবে বুঝানোর পর বাতাস কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। তারপর নূর গেল ‘আগুনের’ কাছে। সেখানেও ছালাম বিনিময়ের পর নূরনবী আগুনের কি গুণ ক্ষমতা আছে তা জানতে চাইলেন। আগুন খুব গর্ব করে বললো যে, তার এমন ক্ষমতা আছে যে, সে ইচ্ছা করলে সব পুড়িয়ে ছাই করে ধ্বংস করে দিতে পারে। আরো দেখলো আগুনের মধ্যে প্রচন্ড অহংকার বিরাজ করছে, নূর এ সমস্ত কিছু লক্ষ্য করে আগুনকে খুব ভালো করে উপদেশ দিল তার মিথ্যা অহংকার ত্যাগ করার জন্য। আল্লাহর গুণগান শোনালেন আগুনকে এবং তার কি কি দোষ আছে তাও জানালেন। আগুন দিয়ে আল্লাহপাক কি কি করবেন তাও বললেন। আগুন নূরের সমস্ত কথা শুনে ‘কালেমা তাইয়্যেবা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। শেষে নূর নবী গেল ‘মাটির’ নিকট। নূরনবী মাটির নম্রতা, নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার অসীম ক্ষমতা, ধৈর্য্যশীলতা, শান্ত স্বভাব ইত্যাদি মহৎ গুণাবলী দেখে খুব খুশী হলেন ‘নূর মাটিকে ছালাম দিলেন। মাটি উত্তরে বললো, ওয়া-আলাইকুম ছালাম-মারহাবা স্বাগতম। নূর তার গুণ জানতে চাইলে মাটি বললো আমার কোনো গুণ নেই। আল্লাহর গুণেই আমি গুণান্বিত। আল্লাহপাক যখন যে অবস্থায়ই রাখেন সে অবস্থায়ই আমি খুশী। এ কথা শুনে নূর খুশী হলেন এবং মাটিকে কালেমা পড়িয়ে মুসলমান করা হলো। মহান আল্লাহপাক উক্ত আরবা আনাছের দ্বারা আদম অজুদ তৈরী করে তাতে ফিল আরদে খলিফা রূপে বসালেন আদমকে এবং তা সমস্ত সৃষ্টি কার্য সমাধা করে চলেছেন অনাদি কাল হতে। হাদিস কুদসীতে আল্লাহপাক বলেছেন, “লাওলাকা লা’মা খালাকতু আফলাক” অর্থাৎ যদি আপনাকে (নূরনবীকে) সৃষ্টি না করতাম তবে আমি কিছুই সৃষ্টি করতাম না। কাজেই নূরনবী হলেন সৃষ্টির কেন্দ্র বিন্দু। আল্লাহপাক হাদিস কুদসীতে আরো বলছেন যে, “খালাকতু মোহাম্মাদান মিন নূরে ওয়াজহিয়ান” অর্থাৎ আমি মোহাম্মদকে আমার চেহারার নূর হতে সৃষ্টি করেছি। এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর চেহারার দলিল পাওয়া গেল যেমন, কোরানে বলা হয়েছে, “ফা আইনা মা তুওয়াল্লু ফাছাম্মা ওয়াজহুল্লাহি” অর্থাৎ সুতরাং তোমরা যেদিকেই ফির (তাকাও) না কেনো, সুতরাং সেদিকেই আল্লাহর চেহারা বিদ্যমান। কাজেই এ রহস্যাবলীকে পীর-মুর্শিদের কাছে চিনে নিতে হবে। আল্লাহর চেহারায় সৃষ্টি হলো আদম এবং আল্লাহর চেহারার নূরে সৃষ্টি মোহাম্মদ এ কথার মাঝে গভীর নিগূঢ় তত্ত্ব রয়েছ যা আরেফে বিল্লাহগণই ভালো অবগত আছেন। হাদিস কুদসীতে বর্ণিত আছে, আল্লাহপাক বলেন, হে আমার প্রিয় হাবিব! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি আকাশ-জমিন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। আকাশ মন্ডলকে সুউচ্চে স্থাপন করতাম না এবং ভূমন্ডলকে নি¤েœ বিছানাস্বরূপ করতাম না। আরো বর্ণিত আছে যে, রাছুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াচ্ছাল্লাম বলেন, “আমি হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের সৃষ্টির চৌদ্দ হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহপাকের দরবারে একটি নূর ছিলাম।”
ইমাম মোহাম্মদ আল-মাহদী আহমাদ তাঁর ‘মাতালিব-উল-মুসাররাত’ কিতাবে লিখেছেন, “আল্লাহ সর্বপ্রথম যে বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা হলো আমার নূর এবং আমার নূর হতে সৃষ্টি হলো প্রতিটি বস্তু।”মূলতঃ নবীজি হলেন সৃষ্টি জগতের রূহ হায়াত ও সমস্ত অস্তিত্বের মূল রহস্য। তাঁর হতেই এবং তাঁর মধ্যেই সমস্ত সৃষ্টির অস্তিত্বের ভিত্তি।
‘নুজহাতুল মাজালিশ’ নামক কিতাবে বর্ণিত আছে, “আল্লাহপাক তাঁর নূর হতে এক মুষ্টি নূর গ্রহণ করলেন।” এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হযরত মাওলা আলী আলাইহিস সালাম হতে বর্ণিত হয়েছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাছুল ! আপনি কোন্ বস্তু হতে সৃষ্টি হয়েছেন ? তিনি বললেন, যখন আমার পরওয়ারদিগার আমার প্রতি যা ওহী করার তা করলেন (ইহা মোকামে কাবা কাওসাইনে), আমি বললাম, হে আমার রব ! তুমি আমাকে কোন্ বস্তু হতে সৃষ্টি করেছ ? আল্লাহপাক বলেন, আমার ইজ্জত ও জালালের কসম, যদি তুমি না হতে আমি আসমান-জমিন সৃষ্টি করতাম না। আমি বললাম, হে আমার রব, তুমি আমাকে কোন্ বস্তু হতে সৃষ্টি করেছ ? তিনি বললেন, হে মোহাম্মদ ! আমি ঐ নূরের শুভ্রতার প্রতি দৃষ্টি করলাম যে নূরকে আমি সৃষ্টি করলাম আমার কুদরতের দ্বারা ; যাকে আমি অভিনব বিস্ময়কর আদি রূপ দান করলাম আমার হুকুম দ্বারা।
আল্লাহপাক এ বিশ্বকে পাঁচটি স্তরে প্রকাশ করেছেন নূরে মোহাম্মদীর মাধ্যমে তথা নূরে মোহাম্মদী হতে –
১। আল্লাহর আধিপত্যের জগত বা আলমে হাহুত।
২। নূরে মোহাম্মদীর জগত বা আলমে লাহুত।
৩। পরিকল্পনার জগত বা আলমে জাবারুত।
৪। নির্দেশের জগত বা আলমে আমর বা আলমে মালাকুত।
৫। সৃষ্টি বা আলমে খালক বা আলমে নাছুত।
আল্লাহপাকের এ সৃষ্টির কোনো রকম পরিবর্তন নেই। তাই কোরানে বলা হয়েছে, “লা তাবদিলা লি খালকিল্লাহ” অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। মাওলা পাকের এ পাঁচটি আলমের ভিতর একটি হলো ‘পরিকল্পনার জগত’। নূরে মোহাম্মদী আল্লাহর ইচ্ছা মোতাবেক ‘হামদ’ ও প্রচারের বা বিকশিত করতে ইচ্ছা করলেন এবং সাতটি ঘোষণার মাধ্যমে এর সূচনা হলো। ‘বিছমিল্লাহর’ এক মঞ্চ তৈরী করে তাতে অধিষ্ঠিত হয়ে ঘোষণা করলেন –
প্রথম ঘোষণা করলেন – কুন্তু কান্জান মুখফিয়ান।
দ্বিতীয় ঘোষণা করলেন – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
তৃতীয় ঘোষণা করলেন – আনা মিন নূরীল্লাহ।
চতুর্থ ঘোষণা করলেন – নূর মিন নূরীল্লাহ।
পঞ্চম ঘোষণা করলেন – নূর মিন নূরী।
ষষ্ঠ ঘোষণা করলেন – খালাকা মিন নূরী।
সপ্তম ঘোষণা করলেন – ইয়া আমীর-আল্লাহু আকবর।
এ সাতটি ঘোষণা ছিল নূর হতে নূর সাইজুদা হবার পরিকল্পিত রূপ এবং সমস্ত সৃষ্টি বিকশিত হবার মূল স্রোতধারা। এ বিকশিত নূর চারটি হালিয়তে দীপ্তি লাভ করে চারটি নামের আবরণে স্থিত আছে। যেমন, “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু রূহী” মানে সর্বপ্রথম রূহ সৃষ্টি (প্রকাশ)। ইহা হাকিকতের জগতে হাকিকতে মোহাম্মদীর গভীর কেন্দ্রে বর্তমান এবং এখানে রূহের প্রথম প্রকাশিত স্থান। তাই এ স্তরের প্রথম প্রকাশিত অবস্থাকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে, “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু রূহী।” মায়ীয়েতের স্তরে বা মোকামে প্রথম প্রকাশ হয় নূরে মোহাম্মদী রূপে বিধায় বলা হয়েছে, “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরী”। ইহা নূরের দ্বিতীয় বিকাশ হলেও এ স্তরে প্রথম প্রকাশ এ নামে। ইহা সূক্ষ্মরূপ জগতের প্রথম প্রকাশ ও বিকাশ। ইহার বিভিন্ন নাম সাব্যস্ত আছে। ইহার তৃতীয় বিকাশ আলমে আরওয়াতে অথচ এ স্তরের নাম ও রূপের আবরণে প্রথম প্রকাশ বিধায় বলা হয়েছে, “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু আকল”। আলমে আরওয়াতে ঈমান আনার অবস্থার সাথে জড়িত – যা এ স্তরে প্রথম প্রকাশ। এখানেই বলা হয়েছে “আলাস্তু বে রাব্বিকুম” -মানে আমি কি তোমাদের রব নই। “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু কলম”- মানে প্রথম কলম সৃষ্টি করেন আল্লাহপাক। এ অবস্থা ‘লওহ মাহফুজ’ এর লিখিত অবস্থার সাথে জড়িত। এখানেই প্রথম নূরের কলমে নূরের কালিতে প্রথম লিখিত স্থান। এখানে আল্লাহর কালাম বা কিতাবিন মাকনুনিন সংরক্ষিত আছে – যা অপবিত্রগণ কখনো স্পর্শ করতে পারে না, এ কথা কোরানের বিবৃত করা হয়েছে। এ কিতাব কাগজে সংকলিত কিতাব-কোরান অবশ্যই নয়।