লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
যুগে যুগে দেশে দেশে কালে কালে প্রতিটি জনপদে আবির্ভুত মহান অলী আউলিয়া গণের পবিত্র জীবনাচারনে বার বার জগতে প্রতিধ্বনিত হয় পবিত্র ধর্মচেতনার সুরধ্বনি। আবহমান কাল থেকেই পবিত্রাত্মা তথা আউলিয়াগণের দ্বারা ধর্ম প্রচার হয় জগতে।
জীবাত্মার গুণ খাছিয়তে আবৃত মানুষকে তারাই দেখায় মনুষ্যত্বের সরল সঠিক সুপথ। অজ্ঞানীদের বিরোধিতায় কখনো প্রচন্ড অত্যাচার সহ্য করতে হয় তাদের। তারপরও তারা আমাদের মতো পতিত মানব জাতির জন্য রেখে যান মুক্তির অমিয় সুধা। যা অনুসরনেই আসতে পারে আমাদের কাঙ্খিত সফলতা।
জগতের পলে পলে মুক্তির সেই অমিয় ডাক, অন্ধত্ব থেকে আলোয় উত্তরনের ডাক, পশুত্ব থেকে ইনছানিয়াতে উত্তরনের ডাক, কবর থেকে আলোকিত পরকালে উত্তরনের ডাক, – আপনত্বে বিরাজিত মহত্বের অমিয় বার্তা দ্বারে দ্বারে পৌছে দিতেই আবির্ভূত হয়েছেন অলী আল্লাহ গণ।
তাদেরকেই অনুসরন করতে বলা হয়েছে বার বার, তাদের পথে চলাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য, কারন তারাই কল্যাণ প্রাপ্ত।
ভারতবর্ষে ধর্মীয় শান্তি প্রতিষ্ঠা
যুগে যুগে অজ্ঞানতা নাশ করার জন্য প্রতিটি দেশে প্রতিটি জাতিতে প্রেরিত হয়েছেন মহানমানবগণ। যাদের দ্বারা অজ্ঞ মানব সমাজ পেয়েছে ইনছানিয়াতের শিক্ষা।
যারই পথ পরিক্রমায় তৎকালীন ভারতবর্ষ- যা অজ্ঞতা ও তমসার প্রাবল্যে পরিনত হয়েছিলো অসত্য ও অসুন্দরের মহাশশ্মানে। যেখানে বহুকালের সংস্কারের অতীত মানব জাতি ধুকে মরছিলো জাতি গোত্র বিভাজন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রের অসাম্য নীতিতে, অস্পৃশ্যতা, নীতিহীনতা, ধর্মভ্রষ্টতা সহ সকল প্রকার অপসংস্কারে।
মানুষ তত্বের উর্দ্ধে যেখানে সগর্বে রাজত্ব করছিলো অমানবিকতা, হিংস্রতা- এমনই একটি পরিবেশে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে মানবতার মহান মুক্তিদুত হযরত মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক প্রেরিত হলেন সুলতানুল হিন্দ খাজা মুঈনুদ্দিন হাসান সঞ্জরী আজমেরী চিশতী (র)।
খাজা বাবার ধর্ম প্রচার
অলিকুল শিরোমনি হযরত খাজা মঈনুদ্দিন হাসান চিশতী (র) এর একনিষ্ঠ ধর্ম প্রচারের কারণে আজ ভারতবর্ষে আমরা পেয়েছি মোহাম্মদী দ্বীন। অলিয়ে কামেলের রুহানী শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি, অখন্ড সত্যের দিব্যজ্ঞান, জ্যোর্তিময় নুর চেহারা সর্বসাকুল্যে তৎকালীন ভারত বর্ষের বঞ্চিত জনতা খাজা বাবার অমিত তেজ প্রভার নিকট মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিলো।
ভারতবর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তরবারির জোরে নয়, সেনাপতির রক্তচক্ষুর ভয়েও নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো মহান আধ্যাত্মিক সাধক, সুলতানুল হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর সাম্য, উদারতা, ভ্রাতৃত্ব, সার্বজনীন প্রেম, বিশ্বাস, ভক্তি, মহিমান্বিত কার্যাবলি সহ দ্বীনে মোহাম্মদী তথা সহজাত মানব ধর্মের অনিন্দ্য সুন্দর গুণ মহিমার ফলে।
মানুষকে সতের পথে আনয়ন
ভারতবর্ষে দ্বীনের যথার্থ তাবলীগ সাধিত হয়েছে খাজা বাবা তার ভক্ত অনুসারীদের দ্বারা। তৎকালীন প্রায় ৯৮ লাখ মানুষ খাজা বাবার হাতে হাত দিয়ে মনুষ্যত্বের ধর্মে দীক্ষা গ্রহন করে শান্তির সুশিতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হন। “সম্ভবত তাই কোনো এক লেখক বলেছিলেন, “খাজা বাবা যদি ইসলাম ধর্ম প্রচার না করে নিজ নামে ধর্ম প্রচার করতেন তাহলে হয়ত ভারতবর্ষে আমরা আজও ইসলাম ধর্ম চিনতাম না।”
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে খাজা বাবার এ সাফল্যের মুলে ছিলো সুদৃঢ় ঈমান, কঠোর সাধনা, পবিত্র কোরান ও হাদীসের সাথে গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক, তেজোদীপ্ত প্রভাব বিস্তার কারী আধ্যাত্মিক শক্তি, রাসুলাল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ মানবসেবা, দ্বীনে মোহাম্মদীর পরিপূর্ন বাস্তবায়ন ও তরিকতের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রভৃতি।
খাজা বাবার জীবন
ইরানের সিজিস্তান নামক স্থানে ৫৩০ হিজরী সনে ১৯ জমাদিউল আউয়াল খাজা গিয়াসউদ্দিন হাসান (র) এর ঔরসে এবং উম্মুল ওয়ারা (র) এর গর্ভে জন্মগ্রহন করেন।জ্ঞানার্জনের জন্য বোখারা, সমরকন্দ, সিরিয়া, হামাদান, কিরমান, তাবরিজ, আস্তারাবাদ, হিরাত, বালখ প্রভৃতি স্থান সফর করেন এবং অবশেষে ৩২ বছর বয়সে কোহে ফিরোজের শ্যামস কুঞ্জে অবস্থিত মাশহাদের বিখ্যাত পীরে কামেল অলি হযরত খাজা ওসমান হারুনি (র) এর নিকট মুরিদ হন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
পরবর্তীতে তিনি আরব থেকে ইরাক ইরান ও আফগানিস্থান হয়ে প্রথমে লাহোর ও পরে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে আজমির পৌছে সেখানে বসতি স্থাপন করেন এবং বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে ভারত বর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেন দ্বীনে মোহাম্মদী।
খাজা বাবার অপরিসিম ত্যাগ, ধর্ম প্রচারে দৃঢ়চিত্ততার কারনেই আজ ভারত বাংলায় ৫০ কোটিরও বেশি মুসলমান।
খাজা বাবার দেহত্যাগ ও মাজার শরীফ
আল্লাহর এ খাস অলি ৬৩২ হিজরীর ৬ ই রজব ইহজগত ত্যাগ করেন। ভারতের আজমিরে অবস্থিত তারাগড় পাহাড়ের পাদদেশে খাজা বাবার মাজার অবস্থিত।যা ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট এক মহাপবিত্র স্থান।
ভারতবর্ষে আমরা ইসলাম ধর্মের সুমহান দীক্ষা পেয়েছি অলী আউলিয়া দের মাধ্যমে। ভারতে ইসলাম ধর্মের প্রেমময় অমিয় বার্তা পৌঁছে দিতে আরো কাজ করেছেন খাজা বাবার শতাধিক খলিফা বৃন্দ। ৬৩৬ খৃষ্টাব্দে ভারতীয় জলসীমায় প্রথম রনতরীর আগমন ঘটলেও ভারতে পরিপূর্ণরুপে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পায় খাজা বাবার দ্বারা ও তার রেখে যাওয়া খলিফাদের দ্বারা। ভারতবর্ষের অন্যতম ধর্ম প্রচারক হলেন খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, খাজা শেখ ফরিদ, খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রমুখ।
বাংলাদেশে ধর্ম প্রচার
আমাদের প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশ। ভারত উপমহাদেশের এই স্বাধীন দেশটির শতকরা ৯০ জন মুসলমান। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ায় খলজীর বঙ্গবিজয় (১২০১ খ্রি.) এর অনেক আগেই এখানে পীর আউলিয়াদের আগমন শুরু হয় এবং যাদের দ্বারা ইসলামের দাওয়াতি কাজ শুরু হয়েছিলো।বখতিয়ারের তলোয়ার নয়, বরং পীর আউলিয়া ও সুফি সাধকদের আধ্যাত্মিক শক্তি, ইসলামের অন্তনিহিত সামাজিক সাম্য উদারতা ও শান্তির বানী এদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করে তুলেছিলে।
ড.গোলাম সাকালায়েন বলেন, “এদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজ মননে ও চিন্তায় মুসলিম সূফি সাধক ও পীর দরবেশদের নিকট এমন অনাাড়ম্বর সহজ সরল জীবনাচারের আদর্শ লাভ করলো যা তাদের কাছে সম্পূর্ন অভিনব এবং বিস্ময়কর।”
সমগ্র সৃষ্টিকুলের শান্তি ও সহাবস্থানের বার্তা নিয়ে ইসলামের আগমন। রাছুল (সা) কে বলা হয়েছে সমগ্র সৃষ্টির কল্যান। যার সত্যতা বাস্তবায়িত হলো এদেশে সুফি সাধকদের আগমনের ফলে। গোপাল হালদার বলেন,“বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মনেরা অত্যাচার করাতে নিরঞ্জন রুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মনদের বিরুদ্ধে দেবতাদের নিয়োজিত করলেন, দেবতারা এলেন মুসলমান রুপে।”
বাংলাদেশে ইসলাম আগমন করেছে তেরশো বছরের ও বেশি সময় ধরে। অথচ বখতিয়ার খলজি বাংলা জয় করেন মাত্র আটশো বছরের মতো। তার অনেক আগে থেকেই এদেশে ইসলাম প্রচার হয়েছে অলী আউলিয়াদের দ্বারা।
ভারতীয় উপমহাদেশে অলী আউলিয়াদের আগমনের কারণ
আমরা জানি যে, কারবালায় ইয়াজিদ বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর থেকেই নবী (সা) এর বংশধরদের বা প্রকৃত দ্বীনে মোহাম্মদীর অনুসারীদের জন্য আরব নিরাপদ ছিলো না।
তাই তারা জীবন রক্ষা করতে বা ধর্ম প্রচার করতে ভারতীয় উপমহাদেশে বা ভারত বাংলাদেশে আগমন করেন। তারই ধারাবাহিকতায়, এদেশে বার বার আগমন করেন অলী আউলিয়াদের কাফেলা। যাদের মধ্যে অন্যতম হযরত শাহজালাল এবং ৩৬০ আউলিয়ার আগমন।
বাংলাদেশে বেশিরভাগ আউলিয়া রা এসেছেন সমুদ্র পথ হয়ে। তারা চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে সেখানে স্থায়ী ভাবে বাস শুরু করেন।
হযরত শাহজালালের বাংলাদেশে আগমন
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের যুগান্তকারী ঘটনা হযরত শাহজালাল এর ইসলাম প্রচার। তিনি সুদুর ইয়ামেন থেকে তার মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর (র) এর আদেশে বাংলাদেশে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। হযরত শাহজালালের বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার সম্পর্কে প্রচলিত ঘটনা হলো, তৎকালীন সিলেটে যখন হয়রত শাহজালাল আসেন সিলেটে রাজত্ব করতো রাজা গৌরগোবিন্দ। তিনি ছিলেন খুব অত্যাচারি শাসক।
তৎকালীন সিলেট তথা রাজা গৌরগোবিন্দের রাজত্ব ছিলো জাদুটোনার জন্য বিখ্যাত। তার রাজত্বের তথা সিলেটের পূর্ব দিকে টুলটিকর নামক স্থানে বাস করতো বোরহান উদ্দিন নামক একজন মুসলমান। তিনি তার পুত্রের আকিকা উপলক্ষে একটি গরু কোরবানিদেন। রাজা গৌরগোবিন্দ এই খবর অবগত হওয়া মাত্র তার পুত্রকে হত্যা করেন ও তার হাত কেটে দেন।
গৌড়গোবিন্দের সাথে যুদ্ধ
নিরুপায় বোরহান উদ্দিন তৎকালীন দিল্লীর বাদশাহ সুলতান আলাউদ্দিন মাহমুদ শাহর দরবারে গিয়ে এর বিচার পার্থনা করেন। বাদশাহ গৌরগোবিন্দকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য ভাতিাজা সিকান্দার শাহ কে প্রেরন করেন। কিন্তু যুদ্ধে সিকান্দার শাহ পরাজিত হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন এমন সময় হযরত শাহজালাল সিলেটের দিকে আসছিলেন। তারা একত্রিত হয়ে আবার বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করেন। এবং বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন মানব ধর্ম ইসলামকে।
বাংলাদেশে যদিও বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য অলী আউলিয়া এসেছেন তারপরও এদেশে স্থায়ী ভাবে ইসলাম প্রত্ষ্ঠিা পায় হযরত শাহজালালের বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে।তার সাথে আগত ১১ জন আউলিয়া এবং ৩৬০ আউলিয়া সকলেই বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েন এবং প্রচার করতে থাকেন ইসলাম।
মানব ধর্ম ইসলাম – শান্তি প্রতিষ্ঠা
ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে বাংলাদেশে আমরা ইসলাম ধর্ম পেয়েছি অলী আল্লাহদের মাধমে। ধর্ম প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপাদান হলো সুফি সাধক ও অলী আল্লাহদের তাবলীগ ও দাওয়াতি কার্যক্রম। অলী আল্লাহদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টি, উদার মানসিকতা, অসাধারন নির্মল চরিত্র, জ্ঞানের প্রতি তীব্র অনুরাগ, মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা সহজেই জয় করতে পেরেছিলো সমগ্র বাংলা।
রচনাকাল – 19/02/2018
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী