লেখক – কায়ছার উদ্দিন আল মালেকী
মাওলানা পীর আব্দুল খালেক (র.) চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নের ছতুরা গ্রামে ১৮৯২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ছিলেন, শিক্ষাবিদ, সুদক্ষ প্রশাসক, সুফিতত্ত্ববিদ, রাজনীতিবিদ, গ্রন্থ প্রণেতা ও বাংলার অমর কলম সম্রাট। তিনি সুদীর্ঘকাল একাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বব্রহ্মান্ডে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে- (১) ফেনী কলেজের ফারসি বিভাগের অধ্যাপক এবং ইসলামিয়া হোস্টেলের সুপারিনটেডেন্ট, (২) কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ, (৩) কলকাতা লেডি ব্র্যার্বোন কলেজের অধ্যাপক এবং কলকাতা টেইলর হোস্টেলের সুপারিনটেডেন্ট, (৪) ঢাকা বদরুন্নেছা সরকারী কলেজের অধ্যাপক, (৫) ইডেন সরকারী গালর্স কলেজের উপাধ্যক্ষ। ‘তালীমাত-ই ইসলামিয়া’ পাকিস্তানের আইন পরিষদ বোর্ড যা ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয়, এ পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি পূর্ব বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নিবার্চনে এ বরেণ্য রাজনীতিবিদ- ব্রাহ্মণবাড়িয়া দক্ষিণ-পূর্ব আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে অসামান্য অবদানের স্বাক্ষর রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে (পৃষ্টা নং -২৫৭) লিখেছেন, “আমার নির্বাচনী এলাকা ছাড়া আশেপাশের দুই এলাকাতে আমাকে যেতে হয়েছিল- যেমন যশোরের আবদুল হাকিম সাহেবের নির্বাচনী এলাকায়, ইনি পরে স্পিকার হন; এবং আবদুল খালেকের এলাকায়, ইনি পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন”।
আব্দুল খালেক (র.) বাংলা সাহিত্যি অঙ্গনে অসামান্য অবদান রেখে অমর হয়ে আছেন বাংলার জনপদে। তিনি সমকালীন সময়ের এপার বাংলা ওপার বাংলার প্রথিতযশা অমর লেখক। ইলমে তাসাউফের নিগূঢ় তথ্যের উপর “সিরাজুস্-সালেকীন” নামক গবেষণাধর্মী একটি যুগান্তকারী গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি বর্তমানে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাযিল ২য় বর্ষের সিলেবাসভুক্ত পাঠ্যবই। তাওহিদ, রেছালাত, আক্বিদা, রাসূল (দ.)’র মিলাদ ও সিরাতের মুল প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর “সাইয়েদুল মুরসালীন” নামক একটি গবেষণাধর্মী ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা লিখেছিলেন। গ্রন্থটি ১৯৫১ সালে প্রথমে ছাপা হয়। সমকালীন সময়ে বাংলা ভাষার উপর নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (দ.)’র শান-মান এবং জীবনচরিতের উপর এরূপ উচ্চ মার্গীয় ধর্মীয় গ্রন্থ এপার বাংলা ওপার বাংলায় কোন লেখক লিখে যাননি। এ দুটো গ্রন্থ সকলের কাছে মহামূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে এখনো-ও সমাদৃত।
মুসলিম জাগরণের কবি- ফররুখ আহমদ, এক সময় বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রফেসর আবদুল খালেক (র.)’র সংস্পর্শে তিনি বামপন্থী মতবাদ ও রাজনৈতিক দর্শন থেকে বেরিয়ে ইসলাম ধর্মের সঠিক রূপ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ গ্রহণ করেন। একদা কবির সাথে এবং অধ্যাপক আবদুল খালেক (র.)’র সাথে ধর্মীয় নানাবিধ বিষয়ে ইংরেজী ভাষার উপর কয়েক ঘন্টা ব্যাপী যুক্তিভিত্তিক ও তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর বাহাস (তর্কবিতর্ক সভা) হয়। এ বাহাসে অধ্যাপক আবদুল খালেক (র.)’র দালিলিক যুক্তির উপর কবি সাহেব পরাজিত হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কবিকন্যা এ বিষয়টি কবি ফররুখ আহমদ-ব্যক্তি ও কবি- শাহাবুদ্দিন আহমদ সম্পাদিত বইয়ের উদ্ধৃতি বলেছেন। এজন্য সাহিত্যিক ও লেখক সমাজ- অধ্যাপক (র.) কে কবি ফররুখ আহমদের ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার বাতিঘর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অধ্যাপক আব্দুল খালেক (রহ.)’র অসীম সাহসিকতার কারণে কলকাতার দাঙ্গায় (১৯৪৬ সাল) টেইলর হোস্টেলের ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী প্রাণে বেঁচে যায়।
কলকাতা দাঙ্গা শুরু হয় রমজান মাসের শুক্রবারে। এ দাঙ্গা স্থায়িত্ব ছিলো ১৬-১৯ আগস্ট পর্যন্ত। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই দাঙ্গায় ৪০০০ জন নিহত এবং ১০,০০০ জন আহত হয়। এ দাঙ্গার সময় যে এলাকায় যে জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বেশি ছিলো, সে এলাকায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। কলকাতার দাঙ্গার সময় আবদুল খালেক (র.) ‘টেইলর হোস্টেল’ এর সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ( পৃষ্টা নং- ৬৫) লিখেছেন, “এখন চিন্তা হল টেইলর হোস্টেলের ছেলেদের কি করে বাঁচাই”। বঙ্গবন্ধু সেসময়ে কলকাতার ‘বেকার হোস্টেলে’ থাকতেন। প্রথম যেদিন কলকাতার দাঙ্গা শুরু হয়, সেদিন অধ্যাপক আবদুল খালেক (র.) ‘নাখোদা মসজিদ’ এ জুমার নামাজ আদায় করেছিলেন। এ ঘটনা সর্ম্পকে মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল হক (এম.এ) বলেছিলেন, দাঙ্গা শুরু হওয়ার সময় আমরা দু’জন একসাথে ছিলাম। এ কঠিন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক সাহেব বাসায় যাবেন নাকি টেইলর হোস্টেলে যাবেন এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে টেইলার হোষ্টেলের দিকে রওনা হন এবং সেসময়ে তাঁকে একটি কথা বলতে শুনেছি, “পরিবারকে আল্লাহর হাতে সপিলাম”।
আমরা দু’জন হাটতে হাটতে বিকেল ৩ টা নাগাদ টেইলর হোস্টেলে পৌঁছতে সক্ষম হই। এরই মধ্যে কলকাতার চারিদিকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকজন জড়ো হতে থাকে, এক পর্যায়ে চারিদিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা নামলে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি শেষ হলে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে পড়ে কলকাতার রাজপথ। এরপর শুনা যায় কলকাতার চারিদিকে অশান্তির আগুনে দাউ দাউ করে জ¦লছে। রাত ৯ টার সময় মিলিটারি পোশাকধারী একদল পুলিশ একটি ট্রাক নিয়ে বাবু বাজার চৌরাস্তা হয়ে টেইলর হোস্টেলে এসে আমাদের প্রত্যেককে একটি করে তলোয়ার, ভোজালী, লম্বা হাতল ওয়ালা একটি কুড়াল দিয়ে চলে যান। আবদুল খালেক (র.) থেকে আমরা পরে জানতে পারলাম- মিলিটারি পোশাকধারীরা ছিলো হজরত খিজির (আ.)’র প্রেরিত লোক। দুর্বৃত্তরা রাত ১০-১১ টার সময় টেইলর হোস্টেলের গেইট ভাঙ্গতে চেষ্টা করলে-ও গেইট ভাঙ্গতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে আমরা সকলি জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে অধ্যাপক (র.)’র থেকে জিহাদের বায়’আত নিলাম, বায়’আতের পর তিনি আমাদের বললেন, “আমি অগ্রে জিহাদ করবো, পরে অপর সকলকে আমার অনুসরণ করতে বলবো”। রাত আড়াইটার সময় কলকাতার ডেপুটি কমিশনার- পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান ও একটি ট্রাকে আমাদের সকলকে টেইলর হোস্টেল থেকে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের কারমাইকেল হোস্টেলে নিয়ে যায়; সেখানে আমরা ৪ দিন ছিলাম। টেইলর হোস্টেল থেকে প্রস্থানের সময় লাইট গুলো নিভে দিতে এবং দরজা ও জানালা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম।
দাঙ্গার পর আমরা যখন হোস্টেলে আসলাম, দেখতে পেলাম- হোস্টেলের সব আসবাবপত্র ও টাকা-পয়সা সবি রক্ষিত অবস্থায় আছে। এক কথায় প্রতিষ্ঠানের কোন ক্ষতি হয়নি। এ পরিস্থিতে আমরা একদিন শুনতে পেলাম, ড.কুদরত-ই খোদাসহ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। এ সংবাদ শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়লাম কিন্তু অধ্যাপক (র.) বললেন, “এরা মারা যায়নি, এরা নিরাপদে আছে”। এ কঠিন পরিস্থিতি-ও আমরা সবকিছু ঠিকঠাক মত আদায় করতে পেরেছি, যেমন- নামাজ, রোজা, সেহরী, তারাবিহ নামাজসহ সকল কর্মকান্ডে কোন অসুবিধা হয়নি। এরই মধ্যে একদিন আবদুল খালেক (র.) মুরাক্বাবায় বসে একটু খানি মুচকি হাসলেন। এ দৃশ্য দেখে মুছকি হাসির রহস্যভেদ জানতে চাইলে তিনি আমাদের জানান, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (র.) এবং একজন নবী (আ.) আমাকে বললেন, “ঘাবরাওমত, হামলোগ য়্যা হ্যাঁ, তোমহারা কুই নোকসান নেহি হোগা” (ভয় পেয়োনা, আমরা গেইটে আছি, তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না)। ৪ দিন পর আমরা সবাই নিরাপদে বাড়ী ফিরলাম।
কলকাতার দাঙ্গার বহু পূর্বে অধ্যাপক (র.) একটি ভবিষৎ বাণী করেছিলেন, “আমি দেখতেছি দুই তিন বৎসরের মধ্যে কলকাতায় রক্তের স্রোত বয়ে যাবে। আপনারা সকলেই বন্দুক নিন, কাজে আসবে। আমি-ও নিয়েছি”, এ ঘটনাটি কলকতার একাউন্ট জেনারেল এজি অফিসার আকবর আলী সাহেব সত্যায়িত করেছেন। কলকতার দাঙ্গার পর শুরু হয় বিহারের ৪৬’র দাঙ্গা। এ দাঙ্গা সর্ম্পকে-ও আবদুল খালেক (র.) ভবিষৎ বাণী করেছিলেন, “আমি পশ্চিম দিক থেকে একটি ঝড়ের আশাংকা করছি। আপনারা হুশিয়ার”। কিছুদিন পর বিহারের ৪৬’র দাঙ্গা শুরু হয়ে সারা ভারতবর্ষে বীভৎস তান্ডবলীলায় পরিণত হয়। এ মহান আল্লাহর অলির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও নিরন্তন ভালবাসা।