সামা ধ্যান ও সুফি সংগীত

সামা — শুধু সংগীত নয়, এক পরাবাস্তব ধ্যান।

সুফিরা যখন ভাবে উন্মত্ত হয়ে রুহানী সংগীতে নিমগ্ন হন, তখন তা নিছক কানকে তৃপ্ত করা নয় — বরং আত্মার গভীরতর স্তরে পৌঁছানোর এক আধ্যাত্মিক সেতু। এই সংগীত কখনো কাওয়ালি, কখনো ধ্রুপদী ধ্বনি, আবার কখনো নীরব ধ্যানে রূপ নেয়, যেখানে শব্দও শব্দহীনতায় বিলীন হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠে: কেন সুফিরা সংগীতের মাধ্যমে ধ্যানে প্রবেশ করেন? কী আছে এই শব্দ-তরঙ্গে, যা আত্মাকে আকাশে ভাসিয়ে দেয়?
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো সুফি সংগীতের আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, কুরআনের আয়াত ও ঐতিহাসিক রেফারেন্স, কসমিক ফ্রিকোয়েন্সির সংজ্ঞা এবং কীভাবে সামা মানুষের আত্মার রহস্য উদ্ঘাটনে সহায়তা করে।

অধ্যায় ১: সামার তাৎপর্য ও ব্যুৎপত্তি
‘সামা’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘سماع’ শব্দ থেকে, যার অর্থ শুনা বা শ্রবণ করা। কিন্তু সুফিদের পরিভাষায় এটি শুধুমাত্র ‘শোনা’ নয়— বরং হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা। হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) বলেন:
“সামা এমন এক পবিত্র রশ্মি, যা অন্তরের সত্তাকে উদ্দীপ্ত করে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে।”
সামার উদ্দেশ্য হচ্ছে রুহানী রিয়াজত— আত্মাকে আলোকিত করা, নফসকে প্রশমিত করা এবং ইলাহি প্রেমে আত্মহারা হওয়া।

অধ্যায় ২: কুরআন ও সামা — সঙ্গীত কি নাজায়েয?
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ইসলাম কি সংগীতকে অনুমোদন করে? উত্তরটি সহজ নয়, কারণ ইসলামিক ফিকহে এটি বিতর্কিত। কিন্তু সুফিদের প্রেক্ষাপটে কুরআন থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন:
১. দাউদ (আ.) এর কণ্ঠ
“আর আমরা দাউদকে আমাদের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ দান করেছিলাম। হে পর্বতমালা! তার সাথে তোমরা আল্লাহর প্রশংসা কর এবং পাখিরাও।” (সূরা সাবা ৩৪:১০)
ইবনে কাসীর রহ. ও অন্যান্য তাফসিরকারীগণ ব্যাখ্যা করেন, দাউদ (আ.) এর কণ্ঠ ছিল এতই সুমধুর যে পাখি ও পর্বতও তার সাথে মিলিত হতো জিকিরে। এটি এক প্রকার ‘সামা’।
২. আল্লাহর কণ্ঠস্বর — কম্পন ও ধ্বনি
“যখন তোমার প্রতিপালক পর্বতের উপরে প্রকাশিত হলেন, তা ভস্মীভূত হয়ে গেল এবং মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন।” (সূরা আরাফ ৭:১৪৩)
ইমাম গাযযালী রহ. এর মতে, এই প্রকাশ এক প্রকার নূরের কম্পন ছিল, যার শব্দে মূসা (আ.) সংজ্ঞাহীন হয়ে যান — এটি ‘ধ্বনি’ তথা ‘তাজাল্লির শব্দ’।

অধ্যায় ৩: সামার ইতিহাস — চিশতিয়া ও মাওলাবিয়া তরীকার ঐতিহ্য
চিশতিয়া তরীকায় সামা হলো রুহানী সাধনার অন্যতম অনুষঙ্গ। হযরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া (রহ.) এবং আমীর খসরু এই ধারা প্রতিষ্ঠা করেন উপমহাদেশে। তারা বুঝেছিলেন— সংগীত হৃদয়ের এমন একটি ভাষা, যা যুক্তি নয়, অনুভব দিয়ে পৌঁছে যায় আত্মায়।
অন্যদিকে, মাওলানা রুমির অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠা মাওলাবিয়া তরীকায় দারবিশদের ঘূর্ণন বা ‘সামা রকস’ আল্লাহর চারপাশে মহাবিশ্বের ঘূর্ণনের প্রতীক।

অধ্যায় ৪: আত্মার কম্পন ও কসমিক ফ্রিকোয়েন্সি
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে জানা গেছে, পুরো মহাবিশ্ব নিরবিচারে কাঁপছে— একটি নির্দিষ্ট কম্পন বা ফ্রিকোয়েন্সিতে। প্রতিটি পদার্থ, কোষ, এমনকি চিন্তাও নির্দিষ্ট কম্পনে কাঁপে। এই কম্পন যদি সঙ্গীতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তখন শরীর ও মন উভয়েই সুস্থতা ও প্রশান্তি লাভ করে।
সুফিদের মতে, মানুষের আত্মা ‘লাওহে মাহফুজ’ থেকে এসেছে, আর সেই লাওহ তো এক ‘শব্দশূন্য শব্দের তরঙ্গ’। সুতরাং, সঙ্গীত আত্মার নিজের মাতৃভাষা।

অধ্যায় ৫: সামা ও ধ্যান — শব্দ থেকে শব্দহীনতায়
একজন আসল সামাপ্রেমী যখন ধ্যানে বসে কাওয়ালি শোনে, তার হৃদয়ে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়, যাকে বলে ‘ওজ্দ’ বা ‘হাল’। সে অবস্থায় সে নাচতে পারে, কাঁদতে পারে, বা অচেতন হয়ে যেতে পারে। এটি কোনো বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং অন্তরাত্মার ঈশ্বরস্পর্শ।
আল্লাহ বলেন:
“যখন আমার বান্দারা কোরআন শ্রবণ করে, তখন তারা শ্রবণে মনোযোগী হয় এবং চুপ থাকে যেন রহমত বর্ষিত হয়।” (সূরা আ’রাফ ৭:২০৪)
এই আয়াতকে অনেক সুফি সামার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য মনে করেন— কোরআন হোক বা কাওয়ালি, যদি তা আল্লাহর স্মরণে হয়, তবে তা ধ্যানের মাধ্যম।

অধ্যায় ৬: বিজ্ঞান ও সংগীত — মেডিটেশন ও মিউজিক থেরাপি
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির মিউজিক মানুষের ব্রেইনের আলফা ও থেটা ওয়েভ সক্রিয় করে, যা ধ্যানের জন্য অনুকূল। HeartMath Institute-এর গবেষণায় বলা হয়, হৃদয়ের কম্পন সংগীত দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং এটি হার্ট-কোহেরেন্স সৃষ্টি করে — মানে হৃদয় ও মস্তিষ্কের মাঝে এক ধরণের সাযুজ্য।
সুফিদের সামাও ঠিক এই কাজই করে — হৃদয়ের অন্তস্তরঙ্গের সাথে মিল তৈরি করে আল্লাহর কম্পনের দিকে আত্মাকে একতাবদ্ধ করে।

অধ্যায় ৭: সামা ও ‘হাল’ — এক ধরণের আত্মদৈহিক রূপান্তর
সামার মাধ্যমে সুফিরা প্রবেশ করেন ‘হাল’ নামক এক রুহানী অবস্থায়। এটি হলো এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায়, এবং ঈশ্বরপ্রেমে লীন হয়। রুমির ভাষায়:
“মৌমাছি যখন মধুর স্বাদ পায়, তখন সে মৌচাক ভুলে যায়। সুফি যখন সামার স্বাদ পায়, তখন সে দেহ ভুলে আত্মা হয়ে ওঠে।”

অধ্যায় ৮: সুফি বাণী ও সামার মাহাত্ম্য
হযরত আমীর খসরু
বলেন:
“এই সংগীত হৃদয়ের বন্ধ দরজাগুলো খুলে দেয় — আর সেখান দিয়ে নেমে আসে প্রেমের আলোকধারা।”
হযরত শামস তাবরিজ বলেন:
“সত্য সঙ্গীত সেই, যা তোমাকে নিজের ভেতর ডুবিয়ে দেয় — আর সেখান থেকে তোমার আত্মা উঠে আসে আলোর ঝর্ণার মতো।”

অধ্যায় ৯: শব্দহীন সুর — সামার অন্তর্নিহিত স্তর
সত্যিকারের সামা সেই যেখানে শব্দ শোনার মধ্যেও শব্দহীনতা পাওয়া যায়। এটা তখনই সম্ভব, যখন অন্তরের গভীরে এক ধরণের তান ছুঁয়ে যায় — যেখানে শুধু সুর নয়, সুরের পরবর্তী শূন্যতাটুকুও অনুভব করা যায়।

অধ্যায় ১০: সুফি সংগীতের প্রকৃতি — এক ঐশ্বরিক ভাষা
সুফি সংগীত একটি অলৌকিক ভাষা— যেখানে কথা থাকে, কিন্তু অর্থ থাকে গভীরে। প্রতিটি শব্দ যেন একটি দোয়া, প্রতিটি সুর যেন আত্মার কম্পাস। একে সাধারণ গান ভাবা ভুল হবে।

অধ্যায় ১১: সমালোচনার জবাব — কি সব সংগীত হারাম?
না, সব সংগীত হারাম নয়। ইমাম গাযযালী (রহ.), ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) সহ বহু প্রখ্যাত আলেমগণ স্বীকার করেছেন যে, যদি সংগীত আল্লাহর স্মরণ, পাপ থেকে বিরত থাকা এবং হৃদয়ের জাগরণে সহায়ক হয় — তবে তা জায়েয।

অধ্যায় ১২: উপসংহার — শব্দ থেকে নীরবতা, সুর থেকে নূর
সামা এক রুহানী খোরাক। এটি মানুষের মন থেকে মায়া সরিয়ে হৃদয়কে আল্লাহর দিকে টেনে নেয়। যখন দেহ কম্পনে, চোখে অশ্রু আর হৃদয়ে আহ্বান— তখনই সামার সত্য রূপ উদ্ভাসিত হয়। এটি তখন আর সংগীত নয় — বরং নামাজ, জিকির, রূহের আযান।

শেষ কথা:
সুফিরা সংগীতে মগ্ন হন কারণ এই ধ্বনি তাদের হৃদয়ের রুহানী দরজাগুলো খুলে দেয়। কুরআনের বাণী, নবী দাউদ (আ.)-এর সংগীত, মহাবিশ্বের কম্পন ও হৃদয়ের তান — সবই মিলিত হয় সামার সুরে। সুর থেকে শুরু হয়ে নীরবতার দিকে যাত্রা— এটাই সামা, এটাই আত্মার ধ্যান।

আপন খবর একটি সুফি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক লেখালেখির প্লাটফর্ম।

লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর - Apon Khobor