হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী রহ. এর বাণী

সংকলন – লাবিব মাহফুজ চিশতী

আবু সুলায়মান দারায়ী (রহঃ) ছিলেন তাসাউফের প্রাথমিক যুগের অন্যতম আধ্যাত্মিক পথিক ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সাধক, যিনি আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর ভালোবাসার গভীরতম পর্যায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। তাঁর জন্ম সিরিয়ার দরয়া শহরে, এবং তিনি বাস করতেন দামেশকের নিকটবর্তী দারায়া নামক স্থানে, যা তাঁর উপাধি “দারায়ী” থেকে বোঝা যায়। তিনি বলতেন, “যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে না, তার সাধনা কেবল বাহ্যিক ভানমাত্র।” তিনি ধ্যান, নীরবতা (সামত), অন্তর্মুখিতা (খলওয়াত) এবং হৃদয়ের পরিশুদ্ধিকে আত্মার পরম উন্নতির মাধ্যম হিসেবে দেখতেন।

আবু সুলায়মান দারায়ী (রহঃ) বলেন, “আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর ভালোবাসা—এই দুই পাখার সাহায্যে আত্মা আকাশে ওড়ে।” তিনি ‘ইখলাস’ অর্থাৎ একনিষ্ঠতা ও নির্ভেজাল আল্লাহপ্রেমকে সকল আমলের প্রাণ মনে করতেন। তিনি একজন নিঃসঙ্গ সাধক হিসেবে পরিচিত ছিলেন—জনসমক্ষে খুব কমই আসতেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের প্রশংসা বা সমালোচনা উভয়ই আত্মার পবিত্রতার পথে অন্তরায় হতে পারে। তাঁর মজলিসে (সাধনা সভা) অংশ নিতেন অনেক পরবর্তী যুগের বিখ্যাত সুফি সাধক, যেমন হারিস আল-মুহাসিবী ও জুনায়েদ বাগদাদী। তাঁর ভাবধারায় ‘মহব্বত’, ‘মাআরিফা’ ও ‘ইন্তিজারুল লিকা’ (আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষা) — এই ধারণাগুলো গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে পরবর্তী সুফি তত্ত্বে।

তাঁর বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর, যেমন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে, সে দুনিয়াকে ভয় করে না, এবং যে আল্লাহকে ভয় করে, সে পাপ থেকে লজ্জিত হয়।”
এই ধরনের উক্তিগুলো তাঁকে একজন গভীর অন্তর্দর্শী ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞার প্রতীক করে তুলেছে। তাঁর শিক্ষা ছিল মূলত আত্মা ও হৃদয়ের শুদ্ধতা অর্জনের অনুশীলন, যা আজও সুফি দর্শনের একটি মৌলিক স্তম্ভ।

হযরত আবু সুলায়মান দারায়ী রহ. এর কিছু মূল্যবান বাণী মুবারক –

1. শুধু মুখে তাগ স্বীকার করাও সোনা রূপার চেয়ে দামী।

2. পার্থিব মোহই যে কোনো পাপের উৎস।

3. যে কোনো বিপদ বিপর্যয়কে আল্লাহর ইচ্ছা মনে করে আল্লাহ ছাড়া সব কিছুকেই পরিত্যাগ করার নামই তাসাইফ।

4. ক্ষুধা, ‍উপবাস উপাসনার জন্য জরুরী।

5. পার্থিব বিষয়াদি নিয়ে অধিক চিন্তা ভাবনা করা পারলৌকিক বিষয়ের ওপর পর্দা স্বরুপ।

6. ধৈর্যে জ্ঞান ও চিন্তা বাড়ে, আর ধ্যানে বাড়ে আল্লাহর ভয়।

7. চোখে কান্নার ও মনে চিন্তার অভ্যাস করো।

8. আল্লাহকে চিনতে হলে মন থেকে অন্য সব চিন্তা দূর করে ফেলতে হবে।

9. যে উপদেশ দাতা খোঁজে সে যেন দিবারাতের পরিবর্তনের প্রতি লক্ষ্য রাখে।

10. বান্দা যতই ইবাদতে লিপ্ত থাকে, ফেরেশতাগণও ততক্ষণ জান্নাতের বাগিচায় তাদের প্রতিটি ইবাদতের বিনিময়ে এক একটি বৃক্ষরোপন করেন। যখন সে উপাসনা থেকে বিরত হয় তখন ফেরেশতাগণও অবসর গ্রহণ করেন।

11. যে উপাসনা দ্বারা পৃথীবিতে স্বাদ পাওয়া যায় না, সে উপাসনা দ্বারা পরকালেও প্রতিদান মিলবে না। তৃপ্তিই হল ‍উপাসনার স্বীকৃতি।

12. যাহেদ বা ত্যাগীদের শেষ সোপান মুতাওয়াক্কেলীনদের প্রথম সোপান।

13. আল্লাহ আরেফ বা জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে স্বপ্নের মাধ্যমে এমন দরজা দান করেন, মর্খদের নামাজের মধ্যে ও লাভ হয়না। আরিফগণের বাতিনি চোখ যখন খুলে যায়, তখন জাহেরী চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তারা জাহেরী চোখ দ্বারাও তখন আল্লাহ ছাড়া আর কিছু দেখেন না।

14. আল্লাহর নৈকট্য লাভ তখনই হয়, যখন দ্বীন দুনিয়াকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। মারেফাত চুপ থাকার নিকটবর্তী।

15. যার অন্তর আল্লাহর আলোয় আলোকিত, তার অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। যে উপাসনায় কষ্ট সহ্য করে, তার মুক্তির জন্য উসিলা হয়ে যায়।

16. ধৈর্যের মত উত্তম বস্তু আর নাই। ধৈর্য দু প্রকার। যে কাজের প্রতি আসক্তি নেই তাতে ধৈর্যধারণ করা, প্রবল আসক্তি সত্ত্বেও হারাম থেকে ধৈর্যধারণ করা।

17.যে ব্যক্তি আত্মিক শ্রম দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে সে অবশ্যই জান্নাতের যোগ্য হয়ে যায়।

18. আল্লাহ বলেছেন, যে বান্দা আমার নিকট শরম বা লজ্জা প্রকাশ করে, রোজ কিয়ামতে আমি তার যাবতীয় দোষত্রুটি আবৃত করে রাখবো।

19. যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে, সে দুনিয়াকে ভয় করে না, এবং যে আল্লাহকে ভয় করে, সে পাপ থেকে লজ্জিত হয়।

20. তাওবা হলো সেই মোমবাতি, যা পাপের আঁধারে আলোর সৃষ্টি করে।

21. যে ব্যক্তি খোদাভীতিহীনভাবে ইবাদত করে, সে কেবল বাহ্যিক গঠন রক্ষা করছে; তার অন্তর মৃত।

22. হৃদয় যতটুকু শূন্য হবে দুনিয়ার মোহ থেকে, ততটুকু পূর্ণ হবে আল্লাহর মহব্বতে।

23. তিনিই ঈমানদার, যার অন্তর গোপনে আল্লাহর স্মরণে কাঁদে এবং বাহিরে নিজেকে সবার চেয়ে ক্ষুদ্র ভাবায়।

24. তাসাউফ হলো, এমন এক যাত্রা যেখানে তুমি নিজের কাছ থেকেই নিজেকে মুক্ত করো।

আপন খবর একটি সুফি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক লেখালেখির প্লাটফর্ম।

লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর - Apon Khobor