লেখক – আজহার ফরহাদ
বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেতে হবে ধর্ম-আধুনিকতা-প্রগতিশীলতার একটি অপরিণত সহাবস্থানে। যেখানে দাঁড়িয়ে ‘না ধর্মে না জিরাফে’ এমন একটি ভ্রান্তিমূলক সংস্কৃতি-পরিচয় মেলে যার ভেতর অসংখ্য স্ববিরোধিতা ও শেকড়হীনতা বিদ্যমান।
সংস্কৃতির স্বভাবের ভেতর অভাব থাকতে পারে। যে কোনো অভাবের ওপর ভর করে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল কেন? সাংস্কৃতিক স্বভাবের ভেতর আত্মপরিচয়ের অভাববোধের কারণে। এই অভাব একটা সংকটের নাম; না পাওয়া বেদনার হতাশা নয়। এটিকে আরো একটু গভীরে বলা যেতে পারে ‘স্বভাবের অভাব’; অভাবের স্বভাব নয়!
এই ‘স্বভাবের অভাব’ হতে জেগে উঠেছে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা। এটিকে কেবল আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ‘ডিসকোর্স’ দিয়ে বিচার করা ঠিক হবে না। রাষ্ট্র ও জনপদের লোকমানসে প্রবাহিত দীর্ঘ এক ধারাবাহিক জীবন-পরম্পরা যখন আঘাত পেতে থাকে তখনই ব্যাপারটি ঘটে। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম তারই ফলশ্রুতি। কিন্তু দেশ-কাল-সময়ের স্বাধীনতাকে আমরা কেন মুক্তি বলবো? এখানে মানুষ কোথায়? প্রকৃতঅর্থে মানুষের মুক্তি কতখানি সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে রাজনৈতিক সংগ্রাম ও স্বাধীনতার মূলে সাংস্কৃতিক শক্তিমত্তাকে অনুধাবন করতে পারলে। সংস্কৃতিচর্চা আর সাংস্কৃতিক চেতনা এক নয় মোটেও। চেতনাহীন সংস্কৃতিচর্চার ভেতর চিত্ত-বিনোদন থাকতে পারে, জাগরণ সম্ভব নয়। আর কোনো জাগরণই জেগে ওঠা বা সচেতনতা নয়, যতক্ষণ না আত্মজাগরণ ঘটাতে পারছে। আমরা এখন এই আত্মজাগরণের পথ ও পরম্পরাটিকেই আমাদের আলোচনার মূলাধার হিসেবে দেখতে পারি।
মানুষের আচরণ ও চরিত্রের ভেতর দিয়ে সভ্যতার স্বভাব গড়ে ওঠে। এ স্বভাবের ভেতর যেসব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে তা যেমন সভ্যতার সম্ভাবনা তেমনি সংকটও। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে থিতিয়ে ওঠা মাখনের মতো বিবেচনা করলে পচে যাওয়া দুধের ছানার ভয়ও থাকে। এখানেই সংস্কৃতির সংকট। বড় বড় সভ্যতার সুবর্ণ সময়েও ভেতরে ভেতরে ঘটেছে অমানবিক, নিষ্প্রাণ, আত্মজাগরণহীন সমৃদ্ধি; যার তলে শেষে মানুষই হারিয়ে গেছে।
উনিশ শতকের পশ্চিমা চিন্তাকাঠামোর সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি ছিল ‘ঈশ্বরের মৃত্যু’। মানবসত্তার বিকাশে কাল্পনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বরভাবনা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এসেছিল। বিজ্ঞানের সত্যানুসন্ধান, ধর্মের জিজ্ঞাসাহীন প্রচলিত কাঠামোকে ভেঙে দিতে তৎপর হয়েছিল। মানুষ চাঁদের আলোয় মুগ্ধ না হয়ে চাঁদকে ছুঁয়ে দেখবার স্বপ্ন দেখেছে। যার ফলে বিশশতকে মহাকাশযাত্রা বা চাঁদে অবতরণের মতো বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভব হয়েছিল। উনিশ শতকের বিজ্ঞানমনষ্কতা এবং প্রচলিত ধর্ম-প্রাতিষ্ঠানিকতার আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পরবর্তীতে গড়ে ওঠা বিংশ শতাব্দীকে মানুষ পেয়েছে সংগ্রাম ও মুক্তির শতক হিসেবে।
বিশ শতকে এসে বিজ্ঞানচেতনা প্রযুক্তির চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজেই যেন ঈশ্বরের স্থান দখল করে বসে। ঈশ্বরচেতনা ও আধ্যাত্মিকতা যেমন ধর্মকাঠামোর ভেতর হারিয়ে যায় তেমনি বিজ্ঞানচেতনাও প্রযুক্তির অমানবিক উন্নয়নে কোথায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। বিশ শতকে দেখা যায় ‘মানুষই মৃত’। মানুষের মুক্তি ধর্মের বদলে বিজ্ঞান দিয়েও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আজকের একবিংশ শতক আমার কাছে উনিশ শতকের ‘মৃত ঈশ্বর’ ও বিশ শতকের ‘মৃত মানুষের’ পুনর্জাগরণের সময় হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
চার্চ, পুরোহিত, মোল্লাতন্ত্রে বন্দী যে ঈশ্বরকে আধুনিক মানুষ মৃতজ্ঞান করেছে; পুঁজি, বাজার অর্থনীতি, প্রযুক্তিবিদ্যার অমানবিক সমৃদ্ধিতে যেখানে ব্যক্তিসত্তা গৌণ ও মূল্যহীন কর্পোরেট দাসে পরিণত হয়েছে, মৃতবৎ সে মানুষকে যৌথভাবে জেগে ওঠা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই প্রয়োজন মানুষের ভেতর আত্মবিশ্বাস ও আত্মসংগ্রামের। মানুষ যে অর্থহীনভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানচিন্তার সংঘর্ষে ক্ষত-বিক্ষত অসহায় প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে সেখান থেকে তার মুক্তির প্রয়োজন। এ উভয়সংকট হতে না বেরুতে পারলে তার জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমৃদ্ধি কোনো সফলতা বয়ে আনবে বলে মনে করতে পারি না।
পশ্চিমা সভ্যতার এই উন্নয়ন প্রকল্প যে সংকটকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠেছে সেখান থেকে সহজে বের হওয়া তার জন্য সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অনগ্রসর ও প্রান্তিক বিশ্বেও এর প্রভাব স্বভাবতই পড়েছে, সেখানে ঘটনাটি ঘটেছে আরোপিতভাবে। রাষ্ট্র ও সমাজপ্রকল্পের বিভিন্ন মডেল অনুসরণ করতে গিয়ে একদিকে ধর্মান্ধতা অপরদিকে অন্ধ-প্রগতিশীলতা মানুষকে ভেতরে ভেতরে রসহীন, অনুভবহীন, দুরন্ত রোবটে পরিণত করেছে। আমরা দেখছি নিষ্প্রাণ রোবটদের আদর্শ ও মতবাদের সংঘাত, মানুষের পায়ের আওয়াজ যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্তর্গত সভ্যতার দিকে না গিয়ে মতাদর্শিক সংঘাতময় অপসংস্কৃতির সংকট তৈরি করছি। পশ্চিমের নিজস্ব বিকাশের পথটিকে পোশাকের মতো পরিধান করে অগভীর সভ্য হয়ে ওঠা–একে সংস্কৃতির সংকট না বললে আর কী বলবো?
মানবিক পৃথিবীর জন্য সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল কতখানি জরুরি তা বিবেকবান মানুষমাত্রেই উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বোঝাচ্ছি; তা কি কেবল উপভোগ করে সময় কাটাবার বস্তু নাকি এগিয়ে যাবার, উদ্বুদ্ধ হবার অনুপ্রেরণামূলক তৎপরতা সেটি বোঝা দরকার। সংস্কৃতির অন্তঃধর্মকে না চিনতে পারলে সভ্যতার মর্মে পৌঁছানো যায় না। বিরাট সব সভ্যতাকে মানুষ চিনতে পেরেছে, মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে সংস্কৃতির ধ্যান-ধরন-ধারাবাহিকতা দিয়ে। এটিই সংস্কৃতির ধর্ম, যা মৌলিক জীবনবোধ ও দর্শনের ছায়াস্বরূপ দেশ-কাল-সমাজে প্রতিফলিত হয়। যাকে পারলৌকিক ধর্মকাঠামোর মতো নির্দ্দিষ্ট একটি গন্ডীর ভেতর আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়, এই তার সৌন্দর্য। মানবসভ্যতার উত্থান-পতনেও এই সৌন্দর্য হারিয়ে যায় না; পৃথিবীর আদিতম সুর হয়ে গেঁথে বসে অপরিবর্তনীয় বিবর্তনের গভীরে।
কিন্তু কথা হলো সংস্কৃতির এই মৌলিকত্ব আসলে কি? কোথা হতে এটি জন্মলাভ করে? ক্ষেত্রভেদে ধর্মের সাথে তার দ্বন্দ্ব ও প্রীতির কারণ কি? কখনো দেখা যায় ধর্মীয় সংস্কৃতির ভেতর তার ঢুকে পড়া, কখনো প্রবল বিরোধ। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকাঠামো যখনই অমানবিক ও আগ্রাসী হয়ে উঠতে চেয়েছে ঠিক তখনই দেখা গেছে কোনো না কোনো সাংস্কৃতিক শক্তি তাকে রুখে দাঁড়িয়েছে। এই শক্তিটি কী?
আমাদের আলোচ্য বিষয় বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বাউল-ফকির সমাজ ও তার গভীর মানবতাবাদী জীবনদর্শনকে মুখ্য ধরা হয়েছে। যার পরিচয় না পেলে সংস্কৃতির নিজস্ব ধর্মকে চিনতে ভুল হবে। আমরা এমন এক জাতি যার রয়েছে বিস্তৃত সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য, ভেতরে প্রচ্ছন্ন লোকায়ত ও লোকোত্তর চেতনার সুদীর্ঘ পরম্পরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার একটি আড্ডায় বলেছিলেন, ‘মানবপন্থী বাংলাদেশ প্রাচীনকালেও ভারতের শাস্ত্রপন্থী সমাজ-নেতাদের কাছে নিন্দনীয় ছিল ‘ তার মানে বাংলাদেশ চিরদিনই শাস্ত্রগত-সংস্কারমুক্ত। বৈষ্ণব ও বাউলদের মধ্যেও দেখা যায় সেই স্বাধীনতা। তাদের সাহিত্যে ও গানে অলঙ্কার বা শাস্ত্রের গুরুভার তারা কখনও সইতে পারে নি। শাস্ত্রের বিপুল ভার নেই অথচ কি গভীর কি উদার তার ব্যঞ্জনা। এদেশের কীর্তন-বাউল-ভাটিয়ালি প্রভৃতি গানে খুব সাদা কথায় এমন অপূর্ব মানবীয় ভাব ও রস সাধকেরা ফুটিয়ে তুলে গেছেন যে কোথাও তার তল মেলে না, কূল মেলে না। অপার মানবীয় ভাবের কোথায় সীমা কোথায় শেষ? প্রাণের মতোই তা সর্বভারমুক্ত ও সহজ তার অতল অপারতার রহস্য।’—ক্ষিতিমোহন সেন; বাংলার সাধনা।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘হারামণি’ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ আরো বলছেন–
‘আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু, আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল-সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি। এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করে নি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধে নি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপন। কিরকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময়ে, যে কালে এই কথাগুলি বলেছিলেন সেই সময়কাল ও বাস্তবতা আজ নেই কিন্তু বাউলসাধকগণ রয়েছেন স্বমহিমায়। তিনি বাউলসাধকদের শক্তিমত্তা ও বিশেষত্ব সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা কেবল ভারতবর্ষ নয় সমগ্র পৃথিবীর বিবেচনায় অত্যন্ত মূল্যবান। বাউল-ফকির সমাজ সময়ের হাল-হকিকতকে কতখানি সমঝদারিত্বের সাথে মোকাবেলা করেন এবং মানুষকে মহত্ত্বর জীবনবোধ ও উপলব্ধির আত্মসংগ্রামে টেনে নিতে চান তা আজকের প্রযুক্তিদাসত্ব ও পুঁজিকৈবল্যর যুগে দাঁড়িয়েও আমরা অনুধাবন করতে পারি।
সূক্ষ্মতম জীবনবোধের সাথে সরস দার্শনিকতা যে পরিমাণ সমৃদ্ধ করেছে বাউল গানকে তা বিরল। বাঙালির এতবড় জাগরণের পরম্পরাটিকে পশ্চিমের দার্শনিক পরাকাষ্ঠার সাথে তুলনাযোগ্য করে তোলেন অনেকেই। কিন্তু এই দর্শনচর্চা কেতাবী নয়, মানুষের অন্তর্গত বিশ্বাস ও উপলব্ধির সাথে মিলিত পরমসত্যের অনুসন্ধানী হয়ে ওঠা, মানুষেরই জয়গান গেয়ে। মনে রাখতে হবে এখানে দেবতার চেয়ে, কল্পিত ঈশ্বরের চেয়ে মানুষই মুখ্য। বাউলের ধর্ম তাই মানুষের আরাধনা করে। যে মানুষকে বাউল সজ্ঞানভাবে ঈশ্বরের প্রতিরূপ ভাবেন, আদমসুরত এখানে স্রষ্টার আদল।
ক্ষিতিমোহন সেন বলছেন,
‘দার্শনিক সব গভীর তত্ত্ব এদেশে প্রচারিত হয়েছে কবিতায় ও গানে। দর্শনে-সঙ্গীতে যে বিবাদ তা এদেশে নেই। বাংলাদেশের বাউলেরা সুরে তালে যে-সব গভীর তত্ত্বগান করেছেন তা আর কোনো ভাষায় বা আর কোনো প্রকারে প্রকাশ করাই অসম্ভব। কাজেই এদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান-কাব্য-সঙ্গীত পরস্পরে পরস্পরকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলেছে। ধর্মে ও জ্ঞানে এদেশে বিরোধ ঘটে নি। এই দুয়ের মধ্যে বিরোধ ঘটলে দুঃখের আর অন্ত থাকে না।’ —বাংলার সাধনা; পৃ.২০।
কিন্তু ধর্মে ও জ্ঞানে এখন বিরোধ বিস্তর। এই বিরোধ যত না ধর্মের কারণে তারচেয়ে বেশি অজ্ঞানতা ও সংস্কৃতিহীনতার জন্যে। এত সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরও কেমন করে ঘটে এমন দুর্ঘটনা, তা বিশেষ চিন্তার বিষয়। তবে কি মানুষ এগোয়নি একটুও, পেছনের সংস্কার ও কূপমন্ডুকতাকে আগলে ধরে আছে! ঠিক তা নয়। সময় এগিয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। সময়ই তার সমসাময়িকতার ভেতর থেকে বের করে আনে দারুণ সব স্বর্ণশস্য। আমাদের কেবল তার বাঁক-বদল ও দিকপরিবর্তনকে ধরতে হয়। বাংলার বাউলধর্ম তা সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে থাকে। বাউল কতখানি সমসাময়িক তা একটি গানে টের পাওয়ার চেষ্টা করি।
ও দেশে মোবাইল এসেছে, চিঠি বন্ধ হইয়াছে
ভালোবাসার কথা এখন আসে বাতাসে।।
আমার অভাবের সংসার
বন্ধুর সনে প্রেম করিলে মোবাইলের দরকার,
ওরে বন্ধে বলছে বেইল নাই আমার মোবাইল না লইলে।।
আমার বন্ধুয়া শোনাইছে
মোবাইল একটা লইলাম হাতে হালের বলদ বেঁচিয়ে,
ওরে মাসে মাসে কার্ড ভরিয়া ঘরবাড়ি গেছে।।
আমার বন্ধু কালাচাঁন
একমাত্র মোবাইল না হইলে বাঁচে না পরাণ
ওরে বন্দে বলছে পোস্ট অফিসতো বন্ধ হইয়াছে।।
সমসাময়িকতার অনবদ্য এই উপলব্ধি সম্প্রতি রচিত বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণের মুঠোফোন কাব্যের চাইতে অনেক অনেক বেশি সমসাময়িক, দার্শনিকভাবে উপলব্ধ এবং সাধারণ মানুষের নিকটবর্তী। বাউল-ফকির সাধক ও শিল্পীগণ কোনো মতেই জনবিচ্ছিন্ন নন, গণমানুষের উচ্ছ্বাস-আবেগ-ফুর্তিকে উসকে দেবার বদলে তাদের ভেতর একটা গভীরতর জীবনবোধ অনুসন্ধানের চেষ্টা সবসময়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শোনামাত্রই গানটিকে চটুল মনে হলেও ভাল করে শুনতে গেলে সে গভীরের স্পর্শ অনুভব করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। এখানেই বাউলের সমসাময়িকতা এবং শক্তিমত্তা। যার পক্ষে সময়ের সকল অভিব্যক্তিকে ধরে ফেলা সম্ভব এবং আখেরে সে সম্ভাবনার দিকে মানবসত্তাকে এমন একটি পথে টেনে নিয়ে যাওয়া যেখানে তার অচেতনা কাটে, আত্মচেতনা জাগ্রত হয়।