লেখক – শওকত ফরিদ উদ্দিন মাসুদ ইরান
বহুকাল ধরে শুনে এসেছি তরিকত চর্চা তথা আধ্যাত্মিকতার চারণভুমি মানিকগঞ্জ। বাস্তবে সে বিষয়টি জানতে ও বুঝতে পারলাম অতিসম্প্রতি। মানিকগঞ্জ জেলার বিশেষ করে ঝিটকা শরীফকে কেন্দ্র করে গুরুবাদের যে চর্চা শুরু হয়েছিল তার প্রভাব এখন বাংলাদেশের সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায়। আর তাই ঝিটকা শরীফ তথা পবিত্র এ আউলিয়া ভূমির প্রতি আমি অবনত মস্তকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
আমি আমার মুর্শিদের সাথে একাধিকবার ওরশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছি সিংগাইর এর আজিমপুর ফকির মওলা দরবার শরীফে। রশিদ সরকার দাদার আমন্ত্রণে গুরুজীর সাথে আমরা বেশ কয়েক বছর মানিকগঞ্জের এই দরবারের অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ লাভ করেছি। আজও তা স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে।
মঈন ভাই (আমার গুরুভাই) এবং আমি ঝিটকা শরীফের মহিউদ্দিন পীর সাহেব হুজুরের কাছে বেশ কিছুদিন যাতায়াত করি। অসাধারন মানুষ ছিলেন তিনি। তার প্রতি জানাই ভক্তি এবং শ্রদ্ধা।
অতি সম্প্রতি যে মহান আউলিয়ার দরবারে উপস্থিত হয়ে আমি অভিভূত হয়েছি সে প্রসঙ্গে বলি। দয়াল বাবা হারুন শাহ প্রতিষ্ঠিত বাঠইমুড়ি শাহী মঞ্জিল দরবার শরীফে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে নিজেকে ধন্য মনে করছি। ভক্ত স্বভাবের যে উন্নত নিদর্শন এ দরবারের ভক্তদের মাঝে আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা অন্য কোথাও সচরাচর চোখে পড়েনা। আদব, তমিজ, নম্রতার এক ধারাবাহিক চিত্রই যেন আমি একের পর এক দেখতে পেলাম। গুরু নির্দেশনার বাইরে এখানে কোনো কাজ সম্পাদিত হওয়ার সুযোগ নেই। এত সুশৃঙ্খল ভাবে সবকিছু সম্পন্ন হচ্ছে অথচ আশ্চর্যের বিষয় এখানে দরবার পরিচালনার কোনো কমিটি নেই। সকল কাজের আদেশ মুর্শিদ প্রদান করেন। ভক্তরা সে কাজ এবাদত মনে করে যথাযথ ভাবে সম্পন্ন করে। যার যে কাজ গুরু নির্ধারন করে দিয়েছেন সে কেবল সে কাজেই মনোনিবেশ করেছে। এত আদব নিয়ে দরবারের গোলামী করতে আমি খুব কম দরবারের ভক্তদেরই দেখেছি।
দরবারের বর্তমান মুর্শিদ হযরত আজাদ ইবনে হারুন। আমি তাকে ভাই বলে সম্বোধন করেছি। অমায়িক স্বভাবের এই মানুষটির রয়েছে সবাই কে আপন করে নেবার এক জাদুকরি ক্ষমতা।
আহলে বাইয়াত তথা পাক পাঞ্জাতন এর পরিপূর্ণ অনুসরণ আমি লক্ষ্য করেছি এ দরবারের ভক্তদের মধ্যে। হুসাইনি ইসলামের পতাকা উচ্চে তুলে ধরে, মানুষকে বিষাদময় কারবালার কাহিনী স্বরন করিয়ে দিতে আশুরা পর্ব উদযাপন এ দরবারের অন্যতম ধর্মীয় আয়োজন। হাজার হাজার মানুষ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে থাকে। মহররম পর্ব উদযাপনের সময় এ দরবার ও তার ভক্তরা এমন ভাবে সেজে ওঠে দেখলে মনে হয় যেনো এই বুঝি সেই একখন্ড ঐতিহাসিক কারবালা।
এখানে ভক্তদের মধ্যে তত্বজ্ঞান নিয়ে তর্কে লিপ্ত হতে দেখলাম না। যা দেখলাম দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। প্রতিটি ভক্ত নিশ্চল গাছের মত দাড়িয়ে আছে গুরুর আদেশ নির্দেশ পালনের অপেক্ষায়।
আলোচনা ও ফাতেহা পর্ব শেষে যখন তোবারক বিতরন শুরু হলো। আমি বিস্ময়েরে সাথে লক্ষ্য করলাম, কাসেদ লেখা সেবকদের মধ্য থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত যারা, তারা তোবারক বিতরন শুরুর আগে পরম ভক্তিভরে গুরুর হুকুম নিয়ে তোবারব বিতরণ শুরু করলেন। এত আদবের সাথে তোবারক বিতরণ ও গ্রহন আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না।
অতি উচ্চ স্তরের আউলিয়া বাবা হারুন শাহ এর রওজা জিয়ারত করে আমার অন্য রকম এক অনুভুতি হয়েছে, যা বলে বোঝাতে পারবো না। এখানে হিন্দু মুসলমান এসে এক মোহানায় মিলিত হয়েছে।
আমার দেখার বাইরেও হয়তো এমন অনেক অদেখা বিষয় রয়ে গেছে যা আমি এত অল্প সময়ের মধ্যে অনুধাবন করতে পারি নি। বিদায় নেয়ার পুর্বমুহুর্তে আজাদ ভাই ভিতরে ডেকে নিয়ে তোবারক হিসেবে কিছু ফলমুল সাথে দিগন্তজোড়া হাসি দিয়ে বলল ‘আবার আসবেন’।
আমি বিদায় নিলাম। কিন্তু বাঠুইমুড়ি শাহী মঞ্জিল রয়ে গেলো আমার মনের মণিকোঠায়।