ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু মহাপুরুষ রয়েছেন যাঁদের আত্মিক বর্ণমালায় আজো আলোকিত হয় ইলম ও ইশকের পথযাত্রা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত খাজা হাসান বসরী (রহ.) — যিনি শুধু এক জন তাবেঈ নন, বরং আত্মশুদ্ধির মর্মরস যাঁর অস্তিত্বে মিশে গিয়েছিল, যিনি ছিলেন হৃদয়ের গভীরে আল্লাহর প্রেমে পাগল, এবং আহলে বাইতের প্রতি এক অপার শ্রদ্ধাশীল আশেক।
হিজরী ২১ সালে জন্মগ্রহণকারী এই মহান সাধক বেড়ে উঠেন মদিনা মুনাওয়ারার পবিত্র বাতাসে। বলা হয়ে থাকে, তাঁর জন্মের সময় হযরত উম্মে সালমা (রা.)—রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানিত স্ত্রী—তাঁকে বুকের দুধ পান করিয়েছিলেন। ফলে তিনি ‘রুহানিয়াতে নববী’ বা নববী আত্মার স্পর্শ লাভ করেন। তিনি ছিলেন এমন এক তাবেঈ, যিনি ১২০ জন সাহাবীর সংস্পর্শে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর আত্মা ছিল বিশেষভাবে আলোকিত হযরত আলী (আ.)-এর মারেফাতি ছায়ায়।
আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত ও মাওলা আলীর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক
হাসান বসরী (রহ.) আহলে বাইতের প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন। তাঁর অন্তরে মাওলা আলী (আ.)-এর প্রতি যে অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধা ও ইশক ছিল, তা শুধুই রাজনৈতিক সমর্থন নয়, বরং আত্মিক এক বোধ, এক মারেফাতি সংলগ্নতা। তিনি বলতেন, “আলী ছিলেন এমন দরজা, যার মধ্য দিয়ে হক প্রকাশিত হত।” আলী (আ.)-এর জ্ঞানের গভীরতা, তাকওয়ার প্রখরতা ও আত্মিক তাওয়াজ্জুহ দেখে তিনি বিস্মিত হতেন। আহলে বাইতকে তিনি কেবল রাসূলের পরিবার হিসেবে নয়, বরং ইলমে লাদুন্নির ধারক, নূরের বাহক এবং আত্মার সত্যিকার ওলিরূপে বিবেচনা করতেন।
এই ভালোবাসা থেকেই তিনি ইয়াজিদের অত্যাচার ও কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার নিন্দা করেছিলেন এবং হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতকে আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ রূপ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি বলতেন, “আহলে বাইতের রক্তে এই দীন রক্ষিত হয়েছে, তাদের প্রেম ছাড়া ইসলাম শুধু কাগজের শরিয়ত হয়ে পড়ে।”
মারেফাত ও তাসাউফের ভিত্তির স্থাপক
তাসাউফ বা সুফিবাদে হযরত হাসান বসরী (রহ.)-এর নাম এক অনন্য দ্যুতি বিকিরণ করে। যদিও পরবর্তীতে সুফি তরিকাগুলো সংগঠিত আকারে আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু তাঁদের আত্মিক ভিত্তি স্থাপিত হয় এই মহান অলির হাত ধরে। তিনি আত্মাকে দুনিয়ার মোহ থেকে সরিয়ে ‘ইলাহি হুযূর’ বা আল্লাহর উপস্থিতির দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর মতে, “মারেফাত হলো সেই নূর, যা অন্তরে উদিত হয় আল্লাহর হাবিবের প্রেমে, এবং যার দীপ্তিতে দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়।”
তিনি বিশ্বাস করতেন, তরিকত মানে কেবল জিকির, ইবাদত কিংবা বাইরের রূপ নয়; বরং অন্তরের পরিশুদ্ধি, অহং দমন, এবং আল্লাহর ইশ্কে ফানায় হয়ে যাওয়া। তাঁর চোখে ইলমের সত্য রূপ ছিল এমন: “সত্যিকারের আলেম সেই, যে নিজের আমল দ্বারা আল্লাহকে চিনে, কিতাব দ্বারা নয়।” এই দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী সুফি সাধনার মূল কাঠামো হয়ে ওঠে।
রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংলাপ
তাসাউফের ইতিহাসে রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর নাম উচ্চারিত হলে, সেখানে হাসান বসরী (রহ.)-এর ছায়াও পড়ে। যদিও তাঁদের মধ্যে কিছু আলাপচারিতা নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক আছে, তথাপি সুফি সাহিত্যে তাঁদের কথোপকথন এক অপরূপ রুহানী ধারা তৈরি করেছে। বলা হয়, একদিন হাসান বসরী (রহ.) বলেছিলেন, “আমি জাহান্নামের ভয় করি।” উত্তরে রাবেয়া বললেন, “তুমি এখনো তোমার ‘নাফস’ নিয়ে আছো। আমি জাহান্নামের ভয় কিংবা জান্নাতের লোভে ইবাদত করি না, বরং আমি আল্লাহর প্রেমে মগ্ন। যদি জান্নাত না থাকতো, তবুও আমি ইবাদত করতাম।”
এই কথোপকথনে হাসান বসরী (রহ.) নীরব হয়ে যান এবং বলেন, “তুমি ইলমে ইশক এর এমন জায়গায় পৌঁছেছো, যেখানে আমি এখনো হাঁটি।” এতে বোঝা যায়, তিনি নারী হলেও এক বিশাল আধ্যাত্মিক উচ্চতাকে স্বীকার করেছিলেন — যে স্বীকারোক্তি তাঁকে পরিপূর্ণ পরিণত সাধক হিসেবে তুলে ধরে।
চিশতিয়া ও কাদেরিয়া তরিকার পূর্বসূরী প্রভাব
হাসান বসরী (রহ.) ছিলেন এমন এক আধ্যাত্মিক স্রোতের উৎপত্তিবিন্দু, যা পরবর্তীতে চিশতিয়া, কাদেরিয়া, সুহরাওয়ার্দিয়া প্রভৃতি তরিকায় পরিণত হয়। তাঁর একজন অন্যতম শিষ্য হযরত আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ (রহ.)-এর মাধ্যমে চিশতিয়া তরিকার আদি শিকড় স্থাপিত হয়। আর তাঁর মারেফাতি শিক্ষা, আত্মশুদ্ধির কৌশল এবং দুনিয়া বিমুখতা পরবর্তীতে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর তরিকায় আশ্চর্য রকমভাবে প্রতিফলিত হয়।
তরিকত ও সিলসিলা ভিত্তিক সুফিবাদে যদিও সরাসরি হাসান বসরী (রহ.)-এর নাম ‘পীর’ হিসেবে উচ্চারিত হয় না, তবে তাঁর আত্মিক বীজ ও ইলহামী ধারা পরবর্তী প্রতিটি তরিকার হৃদপিণ্ডে প্রবাহিত। এই কারণে তাঁকে অনেক সুফি শায়েখ “আওলাদে মারেফাত” এর প্রথম পুরুষ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তাঁর রুহানী দর্শনের সারকথা
হযরত হাসান বসরী (রহ.) ছিলেন এমন একজন আত্মদর্শী, যিনি দুনিয়ার মোহ, রাজনীতি, বাহ্যিক ধর্মীয়তা—সব কিছুকে অতিক্রম করে হৃদয়ের গহীনে আল্লাহকে খোঁজার আহ্বান জানান। তিনি বলতেন:
“হে মানুষ, তুমি আল্লাহর প্রেমকে গ্রহণ করো, কেননা প্রেমের আগুনে সব পাপ পুড়ে যায়।”
তিনি আরও বলতেন,
“তুমি যদি আল্লাহকে চেনো, তবে দুনিয়ার কোনো কিছুর জন্য তোমার ভয় থাকবে না।”
তাঁর পুরো জীবন ছিল ‘ফানা ফিল্লাহ’ বা আল্লাহতে বিলীন হওয়ার এক নিরন্তর অভিযাত্রা। যে রাত্রি তিনি কাঁদতেন, সে কাঁদা ছিল তাঁর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ফেরত নেওয়ার আকুতি। তাঁর চোখের অশ্রু ছিল ‘ইলাহি আশেক’-এর চোখের জল—যা দুনিয়ার নয়, আখিরাতের সন্ধানে প্রবাহিত হত।
উপসংহার
হযরত খাজা হাসান বসরী (রহ.) কেবল একজন ধার্মিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন আত্মার জ্যোতিষ্ক, মারেফাতের প্রথম সূর্য, যাঁর আলোতে আজো লক্ষ লক্ষ মুরিদ ও আশেক দিশা খুঁজে পান। আহলে বাইতের প্রতি তাঁর প্রেম, মাওলা আলীর কাছে আত্মিক সংযুক্তি, রাবেয়া বসরীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংলাপ, এবং পরবর্তী তরিকাগুলিতে তাঁর প্রভাব—সব মিলিয়ে তিনি এক ঐশী রহস্যের নাম। যিনি শেখালেন, “আল্লাহর দিকে যাও হৃদয় দিয়ে; শরীরের ইবাদত শুধু শুরু, প্রেমই হচ্ছে চূড়ান্ত আত্মার রসদ।”
হযরত খাজা হাসান বসরী (রহ.) এর ২০টি পবিত্র বাণী মোবারক:
১. “আমি এমন লোকদের দেখেছি, যাদের হৃদয় কুরআন দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু মুখে তারা নীরব ছিল।”
২. “যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবাসে, তার জন্য এই দুনিয়ার কোনো কিছুই আকর্ষণীয় থাকে না।”
৩. “তুমি যদি তোমার আমল দিয়ে খুশি হও, তবে জানো—তোমার আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”
৪. “তাকওয়া হলো: তোমার অন্তর যেন হালাল ও হারামের মাঝখানেও কাঁপে, যেন তুমি সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছো।”
৫. “গুনাহ মানুষের অন্তরে কালো দাগ ফেলে; বারবার গুনাহ করলে সে দাগ তার হৃদয় ঢেকে দেয়।”
৬. “আল্লাহর প্রেমিকদের চিনে রাখো—তারা রাতের অন্ধকারে কান্না করে আর দিনের আলোয় নীরব থাকে।”
৭. “এই দুনিয়া হলো এক সেতু; এর উপর বাড়ি বানিও না, বরং পার হও।”
৮. “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়কে অন্তরে ধারণ করে, তার কথা ও চাহনি উভয়েই নূরানী হয়।”
৯. “তুমি যদি জানো তোমার সকল কাজের হিসাব নেওয়া হবে, তবে তুমি নিশ্চুপ হয়ে যাবে।”
১০. “সত্যিকারের ইলম হলো সেই, যা হৃদয়ে নেমে আসে এবং চরিত্রে প্রতিফলিত হয়।”
১১. “তোমার চোখের অশ্রু কেবল চোখেই সীমাবদ্ধ না থেকে হৃদয়কে ভিজিয়ে দিক।”
১২. “তুমি যদি আল্লাহকে জানো, তবে জানবে—তাঁকে ছাড়া কিছুই জানার নেই।”
১৩. “অহংকার এমন এক রোগ, যা ইবাদতের মাধ্যমে ঢেকে রাখা যায় না।”
১৪. “রিজিক তোমাকে যেমন খুঁজে নেয়, তেমনি মৃত্যু একদিন তোমাকে খুঁজে নেবে।”
১৫. “আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ো—তোমার জীবনে অন্য কিছুর প্রয়োজন থাকবে না।”
১৬. “যে বেশি হাসে, তার অন্তর মরে যায়।”
১৭. “আল্লাহর পথে চলতে চাইলে নিজেকে হারাতে শিখো।”
১৮. “সকল ইবাদতের চূড়ান্ত রূপ হলো—আল্লাহর ইশ্কে আত্মবিলীন হওয়া।”
১৯. “রাতের নিঃস্তব্ধতাই মুমিনের আসল মুরশিদ।”
২০. “তুমি যদি ফানাহ (বিলীনতা) না চাও, তবে কখনো হাকিকাতে পৌঁছতে পারবে না।”