লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; শব্দ থেকে অনন্তে

মানবজাতির অন্তর্গত যাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি শব্দ—“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। এই কালিমা শুধুমাত্র একটি মৌলিক বিশ্বাস নয়, বরং এটি এক চাবিকাঠি যা আত্মার গহীনে লুকিয়ে থাকা অনন্ত আলোর দরজা খুলে দেয়। সুফি সাধনার পথিকরা এই কালিমাকে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারিত বাক্য হিসাবে নয়, বরং একেকটি শব্দকে ধ্যান, আত্মদর্শন ও আত্মালোকের একটি প্রবেশদ্বার রূপে গ্রহণ করেন।

১. কালিমার স্তরভিত্তিক বিশ্লেষণ
(ক) “লা” – আত্ম-অস্বীকৃতি:
‘লা’ মানে না। এটি একেবারে প্রথম ধাক্কা Ego-র বিরুদ্ধে। এটি নফসের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ। সুফিরা বলেন—প্রকৃত জ্ঞানের শুরু ইনকার থেকে।
“লা” হলো আত্মঅহংকারের গলা কেটে ফেলার প্রথম তরবারি।
যখন মুরীদ (সাধক) বলে, “লা”, সে যেন বলছে—আমি কিছুই নই। আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার জ্ঞান, শক্তি, প্রভাব—সব মিথ্যা। এই “লা” উচ্চারণেই শুরু হয় আত্মশূন্যতা (Fana)।
(খ) “ইলাহা” – সমস্ত মিথ্যা উপাস্য:
‘ইলাহা’ মানে উপাস্য। কিন্তু এই অংশে শব্দটি এসেছে নাকারণে—“লা ইলাহা”।
অর্থাৎ—সব মিথ্যা উপাস্যকে আমি অস্বীকার করছি
এখানে মিথ্যা উপাস্য বলতে বোঝায়—অর্থ, ক্ষমতা, খ্যাতি, ভোগ, নিজের অহংকার, মন, নফস, চিন্তা—যে-কোনো কিছু যা আল্লাহ ব্যতীত জীবনে ‘আলফা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুফিরা বলেন—
“সবচেয়ে ভয়ংকর মিথ্যা উপাস্য হচ্ছে নিজের ‘আমি’।”
(গ) “ইল্লা” – অন্তর্মুখী ধ্বনি
‘ইল্লা’ মানে ছাড়া। এটি একদম অস্তিত্বের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকার মুহূর্ত। যখন সবকিছু অস্বীকার করে শুধুমাত্র একটিকেই রেখেছ—এখানেই সৃষ্টি হয় এক ধ্যানস্থ স্তব্ধতা। এই শব্দটি সুফিদের কাছে Transition Gate—মিথ্যা থেকে সত্যে প্রবেশদ্বার।
‘ইল্লা’ মানে সমস্ত অন্ধকার সরিয়ে চেতনার একটি একবিন্দুতে স্থিত হওয়া। এখান থেকেই আত্মা চিৎকার করে বলে—“আমি একাকে খুঁজি!”
(ঘ) “আল্লাহ” – অস্তিত্বের মূল কেন্দ্র
এটি কালিমার চূড়ান্ত ও অনন্ত অর্থবহ শব্দ। আল্লাহ অর্থ—তিনি যিনি উপাস্য, যিনি অনন্ত, যিনি একক ও অদ্বিতীয়।
সুফিরা বলেন,
“আল্লাহ শব্দের প্রতিটি অক্ষরে লুকিয়ে আছে জ্ঞান, প্রেম ও আত্মবিসর্জনের পরম ধ্বনি।”
‘আল্লাহ’ উচ্চারণে প্রথম ‘আলিফ’ দিয়ে শুরু হয়—যা কায়িনাতের কেন্দ্ররেখা। তারপর ‘লাম’, ‘লাম’, এবং ‘হা’। এই চার অক্ষরকে সুফিরা বিশ্লেষণ করেন হৃদয়ের চার গহীন স্তরের প্রতীক হিসেবে। এই নাম ধ্যান করলে হৃদয় থেকে সমস্ত অন্ধকার সরে যায়।

২. কালিমার ধ্যানপদ্ধতি (Sufi Dhikr Technique)
সুফিদের কাছে এই কালিমা একটি ধ্যানমন্ত্র। একে ব্যবহার করে তারা ধাপে ধাপে আত্মা বিশুদ্ধ করেন।
(ক) ধ্যানের প্রস্তুতি:
শুদ্ধ নিয়ত নিয়ে বসা
একাগ্র চিত্তে গভীর নিঃশ্বাস
অন্ধকারে নয়, হালকা আলোতে বসে হৃদয়ে আল্লাহর নাম কল্পনা করা
(খ) শ্বাসের ধারা অনুসারে জিকির:
১. শ্বাস ছাড়ার সময় (Exhale):
ধীরে ধীরে উচ্চারণ করো—“লা ইলাহা”
মানসিকভাবে কল্পনা করো, তোমার সমস্ত অহংকার, চিন্তা, উদ্বেগ, বাসনা—সব মাটির নিচে চলে যাচ্ছে।
২. শ্বাস গ্রহণের সময় (Inhale):
উচ্চারণ করো—“ইল্লাল্লাহ”
কল্পনা করো, আল্লাহর আলো তোমার হৃদয় পূর্ণ করছে।
এই প্রক্রিয়া ১৫-২০ মিনিট চর্চা করলে, এক ধরণের ধ্যানাবস্থা তৈরি হয়—যে অবস্থায় Ego বিলীন হয় এবং আত্মা আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়।

৩. কালিমা ও সূফি ‘ফানা’ ধারণা
সুফিদের অন্যতম প্রধান ধাপ হলো—ফানা ফি’ল্লাহ (আল্লাহর মাঝে আত্মবিলয়)।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হচ্ছে সেই ধাপে পৌছাবার বাহন।
হযরত বাইয়াজিদ বোস্তামী (রহ.) বলেন—
“আমি সাত বছর ধরে ‘লা’ বলেছি, নিজের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে। তারপর ‘ইল্লাল্লাহ’ বলেছি আর আল্লাহর ভালোবাসায় ডুবে গেছি।”
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা সত্তার ভাঙ্গন হয়, আত্মা বিশুদ্ধ হয়, এবং একজন ‘আরিফ’ (জ্ঞানী) হয়—যে আল্লাহকে দেখেন না চোখ দিয়ে, বরং হৃদয় দিয়ে।

৪. কালিমা ও কসমিক ধ্বনি: শব্দতত্ত্ব বিশ্লেষণ
সুফিরা বিশ্বাস করেন, ধ্বনি (Vibration) হচ্ছে সৃষ্টি জগতের মূল।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” শব্দটিকে তারা একধরণের কসমিক সাউন্ড কারেন্ট রূপে বিবেচনা করেন, যেটি ব্রহ্মাণ্ডের গভীরে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে।
প্রতিটি অক্ষর একটি ‘লাইট ফ্রিকোয়েন্সি’ তৈরি করে। এই ধ্বনি হৃদয় ও মস্তিষ্কে অনুরণন তোলে।
আধুনিক নিউরো-সায়েন্সও বলে, ধ্যানমন্ত্রের ধ্বনি তরঙ্গ মস্তিষ্কের অ্যালফা ও থেটা ওয়েভকে উদ্দীপ্ত করে, যা মানসিক শান্তি আনে। সুফিরা এই প্রক্রিয়াকে বলেন—‘আউয়াজে হাক্ব’

৫. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ – প্রেমের শুদ্ধীকরণ
সুফিবাদের মূলতত্ত্ব হচ্ছে—ইশকুল হাকিকি, অর্থাৎ পরম প্রেম। কালিমা হচ্ছে সেই প্রেমের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার মূল মন্ত্র।
যখন কেউ বলে—“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, তখন সে যেন বলছে—
“হে আল্লাহ! আমি কাউকে ভালোবাসবো না, আমি কাউকে মান্য করব না, আমি কাউকে ভয় পাব না—শুধু তোমাকেই!”
এই প্রেমিকের উচ্চারণে চোখে পানি আসে, হৃদয় কাঁপে, আত্মা অনুরণিত হয়। এটাই হচ্ছে সুফি হৃদয়ের ধ্বনি।

৬. সুফি সাধকদের কালিমা নিয়ে কিছু বাণী
হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.):
“কালিমা হলো জাহান্নামের আগুন থেকে নয়, বরং নফসের আগুন থেকে মুক্তির দিশা।”
হযরত ইবনে আরাবী (রহ.):
“‘লা’ দ্বারা আত্মা নিজেকে ধ্বংস করে, আর ‘ইল্লাল্লাহ’ দ্বারা সে আল্লাহর মাঝে গড়ে ওঠে।”
হযরত রুমি (রহ.):
“যে সত্যিই কালিমার অর্থ উপলব্ধি করে, সে আর কারো গোলাম নয়, সে শুধু প্রেমের গোলাম।”

৭. আধুনিক জীবনে কালিমার ধ্যানচর্চার উপকারিতা
আজকের দুঃশান্তিময় জীবনে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ধ্যানচর্চা—
মানসিক চাপ হ্রাস করে
মনোযোগ বৃদ্ধি করে
আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান গড়ে তোলে
একাকীত্ব ও বিষণ্নতা কাটায়
হৃদয়কে আল্লাহর প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” একটি সাধারণ ধর্মীয় বাক্য নয়। এটি এক অলৌকিক ধ্বনি, এক ধ্যান, এক আলোকমন্ত্র। এটি দিয়ে শুরু হয় আত্মার পথচলা, মুছে যায় অহংকারের দেয়াল, খোলে অন্তর্যাত্রার দরজা।
সুফি সাধকরা এই কালিমা দিয়ে রাতের গভীরে আত্মাকে ভাসিয়ে দেন প্রেম ও আলোয়। আমাদেরও উচিত, এই মহাজাগতিক বাক্যকে শুধু ঠোঁটের উচ্চারণে সীমাবদ্ধ না রেখে, হৃদয়ের ধ্বনিতে রূপান্তর করা।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”—এই বাক্য একে যারা বুঝেছে, তারা মুক্ত। যারা না বুঝে উচ্চারণ করে, তারাও আল্লাহর রহমতের সুরক্ষায়। কিন্তু যারা উপলব্ধি করে আত্মায় ধারণ করেছে—তারা আল্লাহর বন্ধনে বাঁধা চিরন্তন প্রেমিক।”

আপন খবর একটি সুফি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক লেখালেখির প্লাটফর্ম।

লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর - Apon Khobor