লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
এ কেমন মূঢ়তা! মানবের এ কেমন সীমাহীন অজ্ঞতা! শ্রেষ্ঠতম বোধশক্তি তথা বিবেক চাতুর্যের অধিকারী মানব সম্প্রদায় কি করে চেতনার দারিদ্রে জর্জরিত? অস্তিত্বের মিথ্যে অহংবোধে আক্রান্ত? আজ জগতের সর্বদিকে, সকল মানবের অন্তরে বাহিরে তার অস্তিত্বের অহংকার! জীবনের ক্ষণিক মায়ামোহের আবরণে আবদ্ধ মানব সম্প্রদায় চলেছে অনিশ্চয়তার এক অন্ধকূপে। তবু তার একি আস্ফালন!
আমাদের জীবন সাময়িক অস্তিত্বের এক স্ফুলিঙ্গ মাত্র। যা ক্ষণকাল মিটিমিটি করে জ্বলে জ্বলে নিভে যাবে। এক কূল থেকে ঠাঁই নিবে ফের অন্য কোনো কূলে। এভাবেই চলতে থাকবে তার নিরুদ্দেশ যাত্রা। তাসের ঘরের মতো অস্তিত্বের এ আবরণ ঝড়ো হাওয়ায় ভাঙবে আর গড়বে। এ ভাঙাগড়ার মিথ্যে খেলা চলতে থাকবে অনির্দিষ্ট কাল। জড়া, ব্যাধি, মৃত্যুর অধীন আমাদের এ অস্তিত্ব। হতাশা, যন্ত্রনা, লজ্জা, ভয় সহ নানা প্রতিকূলতার তল্পিবাহক আমরা। সর্বক্ষন ভিতরে বাহিরে বয়ে বেড়াই নানান অপমৃত্যু কে। আগামীর নিঃশ্বাসটুকুর নিশ্চয়তা যার নেই, সেও নিশ্চিন্তে আগামী এক শতকের চিন্তায় মাতিয়ে রাখছে নিজেকে । অতীতের অনুশোচনা আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আবদ্ধ করে রাখে আমাদের বর্তমানকে। আমরা অতীত নামক কারাগারে বন্দী। ভবিষ্যতের কারাগারে বন্দী। এত সব বন্দীদশার মাঝে থেকেও আমরা নিশ্চিন্ত মনে পার করি আমাদের বর্তমান।
শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি তথা আশরাফুল মাখলুকাতের খেতাবধারী মানব সমাজ জগতে কত ক্ষুদ্র, কত অসহায় তা ভাবতেও অবাক লাগে। অস্তিত্বের মিথ্যে বড়াই এতটাই অপ্রাসঙ্গিক, জগৎটাই যেখানে নশ্বর!
যদি আমাদের অতি ক্ষুদ্রাদপিক্ষুদ্র এ জীবনটাকে রাঙিয়ে নিতে নিতে সক্ষম হই চিরন্তন অস্তিত্বের রঙে, তবেই স্বার্থক হয় আমাদের অহংকার।
স্বয়ং প্রভু মানবীয় চেতনায় নিয়ত প্রকাশিত ও বিকশিত হচ্ছেন। তাঁকে লাভ করার তথা আপনত্বে ধারন করার একটাই পথ পদ্ধতি। আর তা হলো, যারা/যে সমস্ত পবিত্র মানবগণ নিজেকে প্রভুতে সমর্পিত করে প্রভূসত্ত্বায় চিরপরিনির্বাণ লাভ করে চিরকালে জীবিত হয়ে আছেন, তাদের অনুসরণ অনুকরণের মধ্য দিয়ে অনুসরণকারীর ব্যক্তি সত্ত্বায় প্রভূসত্ত্বাকে জাগ্রত করে তোলা। তবেই মানুষ স্থিত হবে প্রভুতে। প্রভূ গুণে হবে গুণান্বিত।
প্রভূ অজর অমর অক্ষয় অব্যয়। তিনি সর্ববিকার মুক্ত। তিনি জড়া-ব্যাধি-মৃ্ত্যুর উর্দ্ধে। তার কোনো লয় ক্ষয় বিনাশ বা পরিবর্তন নাই। তিনি চির নিত্য। তার গুণে যদি অনিত্য এ ক্ষুদ্র মানুষটি গুনান্বিত হয়, তবে মানুষটিও পরিণত হবে নিত্যে। তখন সে মানুষটিরও আর জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর ভয় থাকবে না।
সসীম এ মানবীয় মোহনাতে অসীম প্রভূ বিরাজ করেন। তিনি সসীম এ দেহধামে মূর্ত হয়ে ওঠেন সাধকের সাধনার শক্তিতে। তিনি যখন হৃদপদ্মে জাগ্রত হন তখন তাকে ধারণকারী মানুষটিও হয়ে ওঠেন চিরকালের মানুষ। তারও আর মৃত্যু হয় না। তিনিও বিরাজ করেন চিরকালের নিত্যতায়।
প্রভূসত্ত্বার গুণগুলো মানুষ যখন আপনত্বে ধারণ করে তখন সে মানুষটি আর সাধারন মানুষ থাকে না। মানবীয় অস্তিত্বে তখন মানুষটি পরিণত হয় প্রভূতে। তখন তার দাসত্ব বন্দেগী তথা অনুকরণ অনুসরনের দ্বারা অন্যান্য মানুষগণ লাভ করে মুক্তি। এটাই ধর্ম বিধান। দোযখ থেকে মুক্তি পাওয়ার এটার প্রক্রিয়া। শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ এটাই। যখন মানুষের সসীম অস্তিত্বের মধ্যে অসীম প্রভূকে ধারণ করে তখনই সে হয় আশরাফুল মাখলুকাত তথা আদম। তখন ফেরেশতাদের তথা পূণ্যবানদের কেবলা হয় সে এবং ফেরেশতারা সে মানুষটির প্রতি সেজদাবনত হয়।
প্রভূর স্বানিধ্যপ্রাপ্ত হলেই আপনি বিরাজ করবেন চির মুক্তির, চির শান্তির অমর লোকে তথা নিত্য বৃন্দাবনে তথা মানবীয় জান্নাতে।
আর যদি আপনি হন প্রভূ হতে বিচ্যূত, তাহলে আপনি সর্বক্ষন জ্বলতে থাকবেন নরক অনলে। প্রভূরুপ আপনাকে মুক্তি দিবে সকল সংশয়-আধার হতে। তার রুপের জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত করে সে আলোকে আপনাকে দেখে নিতে হবে অমরত্বের পথ। তার এশকের আবহায়াত পান করে তথা কাওসারের পিয়ালা পান করে আপনি তার সঙ্গে চিরকালে স্থিত হবেন চির প্রশান্তিতে। এটাই হবে মানুষের একমাত্র সাফল্য। প্রভূযোগেই চিরমুক্তি। মুক্ত সত্ত্বায় স্থিত হলেই চিরমুক্তি।
মানবীয় সক্ষমতাকে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে যদি মানুষ প্রভূসত্ত্বাকে ভিতর বাহিরে ধারন করে প্রভূময় হয়, তবেই সে হবে শ্রেষ্ঠ। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম থাকুক চিরকাল। প্রভূগুরু সহায় হোক সকলের।
রচনাকাল – 02/01/2015
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী