জয়গুরু প্রসঙ্গ ও তরিকতের সম্ভাষণ

জয়গুরু—এই শব্দটি শুধু একটি ধর্মীয় বা মতবাদগত অভিবাদন নয়, বরং এটি এক অন্তর্জগত-নিমগ্ন আত্মার নিঃশব্দ চিৎকার, প্রেমময় আত্মনিবেদন, এবং আধ্যাত্মিক আলোর প্রতি চেতনার ঝর্ণাধ্বনি। “জয়” শব্দটি বাহ্যিক যুদ্ধে বিজয়ের চেয়ে অনেক গভীরতর—এটি আত্মার কামনা-ক্রোধ-অহংকার থেকে মুক্তির বিজয়, এবং “গুরু” হচ্ছেন সেই জ্যোতির্ময় সত্তা যিনি অজ্ঞতার তিমিরে বন্দী আত্মাকে সত্যের সূর্যে অভিষিক্ত করেন। এই দুই শব্দ মিলিয়ে গঠিত “জয়গুরু” হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন চেতনার ভাষা—এক পরম আহ্বান: “আত্মার আলোরই জয় হোক, যিনি আমায় জাগালেন, তাঁকেই শত শত প্রণতি।”

সুফি মারেফতের ভাষায়, ‘গুরু’ মানে কেবল কোনো ব্যক্তিগত উপদেশদাতা নন। মুর্শিদ হচ্ছেন সেই আত্মার দিকচিহ্ন, যার দিকে তাকিয়ে শিষ্য নিজেই নিজের আত্মার অঙ্গন আবিষ্কার করে। তিনি আল্লাহর অনুগ্রহের ঝর্ণাধারার বাহক। মুর্শিদের প্রতি ভালোবাসা মানে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার প্রতীক। তাই ‘জয়গুরু’ বলতে সুফি বোঝায়—“আমার অন্তরের আলোকে যিনি জাগালেন, যিনি আমাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সত্তায় পৌঁছে দিলেন, তাঁরই অন্তর্জয় হোক”। এখানে কোনো বাহ্যিক বিজয় নেই—এখানে আছে নিজের ভেতরের প্রাণবোধের আরাধনা, ফানার মাধ্যমে বাকী’র দিকে যাত্রা।

বৈষ্ণব পরম্পরায়ও ‘গুরু’ মানে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি। ভক্তি-যোগে গুরু হচ্ছেন কৃষ্ণতত্ত্বের এক জীবন্ত বাহন। চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন—“গুরু-কৃপা বিনা কৃষ্ণ লাভ সম্ভব নয়।” গুরুই সেই সেতুবন্ধন, যার মাধ্যমে আত্মা নাম-রস-প্রেমমাধুর্যের অনন্ত নদীতে প্রবেশ করে। ‘জয়গুরু’ তাই বৈষ্ণব ভাষায় কীর্তনময় আত্মার আর্তি—“প্রভু, আমি নিজেকে তোমার প্রেমের যোগ্য করিনি; তবে গুরুদেবের প্রেমে তুমি আমার দরজা খুলে দিয়েছো। তাই, তাঁরই জয় হোক।” এই আত্মনিবেদনের ভিতরে রয়েছে পরম ভালোবাসার বৃষ্টি—যা অহংকারকে গলিয়ে, শরণাগতির ফুল ফোটায়।

সুফি ও বৈষ্ণব ঐতিহ্যে গুরুর ভূমিকা প্রায় অভিন্ন। উভয়ের হৃদয়ঘরের প্রার্থনায় গুরু হচ্ছেন সেই অন্তর্জ্যোতি, যার ছায়ায় মানুষ প্রেমের পথিক হয়ে ওঠে। সুফিদের “ইশক” আর বৈষ্ণবদের “প্রেম”—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো দেয়াল নেই। উভয়ের চেতনায় প্রেমই পথ, গুরুই বাহন, এবং আল্লাহ বা কৃষ্ণ—তাঁরাই চূড়ান্ত প্রাপ্তি। এই দুই ধারার মিলনে ‘জয়গুরু’ হয়ে ওঠে এক সার্বজনীন আত্মঘোষণা—যেখানে ধর্মের সীমারেখা ছাপিয়ে, আত্মার ভাষায় বলা হয়: “প্রেমের যে আলো আমার ভেতর জ্বলে উঠেছে, তারই শিখা চিরজয়ী হোক।”

সুফি সাধনায় যেমন ফানা এবং জিকিরের মাধ্যমে আত্মবিলীনতার অভিজ্ঞতা ঘটে, তেমনি বৈষ্ণব সাধনায় নাম-স্মরণ ও কীর্তনের মাধ্যমে ভক্ত হৃদয়ে জাগে প্রেম-সংবেদ। এই দুই ধারায়ই গুরু হচ্ছেন সেই অন্তর্দীপ—যিনি শিষ্যকে নিজের অন্তরের পথ চিনিয়ে দেন। হযরত রুমী বলেছিলেন: “Your task is not to seek for love, but merely to seek and find all the barriers within yourself that you have built against it.” গুরু সেই সহকারী, যিনি অন্তরের দেয়ালগুলো ভেঙে প্রেমের দরজা খুলে দেন। ‘জয়গুরু’ সেই খোলা দরজায় মাথা নত করে বলা ধ্বনি—“তুমি আমার ভেতর আলো এনেছো, তোমারই জয় হোক চিরকাল।”

গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, ‘জয়গুরু’ হলো একটি ধ্বনি-মন্ত্র, যা কেবল মুখে উচ্চারিত শব্দ নয়; বরং এটি হৃদয়বিহ্বল এক ধ্যান। যখন এই শব্দ কেউ হৃদয় দিয়ে বলে, তখন সে নিজের ভিতরের চেতনার পর্দা খুলে ফেলে দেয়। এই উচ্চারণ সেইসব আত্মার জন্য, যারা সত্যিই জেগে উঠতে চায়, যারা আল্লাহর অথবা কৃষ্ণের সাথে মিলনে পৌঁছাতে চায় গুরুস্নেহের হাত ধরে। একজন সাধকের যাত্রার প্রতিটি ধাপে যখন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয় হয়, তখন এই একটি শব্দ—জয়গুরু—তাকে মনে করিয়ে দেয়: “তোমার আলোর প্রদীপ এখনো জ্বলছে, গুরু তাকে নিভতে দেবেন না।”

অতএব, জয়গুরু মানে কেবল শব্দ নয়—এটি এক আত্মার মহাসংগীত, যা বাজে সকল সত্যান্বেষী হৃদয়ে। সুফি হোক, বৈষ্ণব হোক, বা বাউল-ফকির—এই শব্দে প্রত্যেকে নিজের আত্মার স্বর শুনতে পায়। এখানে নেই কোনো ধর্মীয় গর্ব, নেই কোনো মতবাদগত কড়াকড়ি—এখানে আছে কেবল প্রেম, বিনয়, আত্মসমর্পণ, ও আলোয় জেগে ওঠা।

উপসংহার:
“জয়গুরু” — এই শব্দটি সেইসব হৃদয়ের আর্তি, যারা সন্ধান করে অদেখা প্রভুর, যারা ভালোবাসে সেই আলোকপুরুষকে, যিনি আঁধার ভেদ করে পথ দেখান। সুফি মুর্শিদ আর বৈষ্ণব আচার্য—তাঁরা উভয়েই গুরুরূপী ঐশ্বর্য, যাঁর চরণে আত্মা পায় শরণ। এই শব্দের মাধ্যমে আমরা উচ্চারণ করি না কেবল ভক্তি, বরং আত্মার ইতিহাসও। প্রতিবার যখন কেউ বলে “জয়গুরু”, তখন সে বলে:
“আমি কিছুই নই, গুরু তুমি সব।
আমার আত্মায় আলোর যে শিখা তুমি জ্বেলে দিয়েছো—
সেই জ্যোতিরই আজ আমি জয় ঘোষণা করছি।”


জয়গুরু।
জয় প্রেম, জয় আলো, জয় সেই অন্তর্জ্যোতির—যিনি গুরুর রূপে হৃদয়ে প্রবেশ করেন।

আপন খবর একটি সুফি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক লেখালেখির প্লাটফর্ম।

লাবিব মাহফুজ চিশতী

আপন খবর - Apon Khobor