প্রেম শব্দটি বাংলায় যত সহজ শোনায়, তার অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক অপার গভীরতা, রহস্য ও আত্মবোধের অতিব সূক্ষ্ম তরঙ্গ। মানুষের হৃদয়ে জন্ম নেওয়া এক ধরণের অভ্যন্তরীণ তীব্র আকর্ষণ, যেটা দেহ ছুঁয়ে আত্মার কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুফিরা এই ভালোবাসাকেই বলেন ‘ইশক’। তবে এ ‘ইশক’ হচ্ছে অপার্থিব প্রেম। এটি আত্মা ও পরমাত্মার মিলনের এক ঐশী প্রয়াস। সুফিদের ভাষায় — ‘ইশক হাকিকী’, অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, যে ভালোবাসা নিজেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলার মাধ্যমেই প্রকৃত আপন সত্তাকে আবিষ্কার করে।
১. আল্লাহকে ভালোবাসা: ফিতরাতের রহস্য
সুফি দর্শনে বলা হয়, আল্লাহতায়ালা মানুষকে এমন এক স্বভাব বা ‘ফিতরাত’ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে আল্লাহর প্রতি একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে।
হাদীস কুদসী: “আমি ছিলাম এক গুপ্ত ধনভাণ্ডার, আমি চেয়েছিলাম যেন আমাকে কেউ চিনে; তাই আমি সৃষ্টি করলাম।”
— মা খলাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লি’য়াবুদুন (যিনি চিনে তাঁকে ভালোবাসে)
এখানে ‘চিনে’ শব্দটি কেবল জ্ঞান নয়, বরং প্রেম ও উপলব্ধির মিশ্র অনুভূতি — এটাই ‘ইশক’। মানুষ ভালোবাসে আল্লাহকে, কারণ তাঁর ভিতরেই সেই আলোকচুম্বকীয় আকর্ষণ সঞ্চারিত আছে। সেই আকর্ষণই মানুষকে টানে নামাজে, জিকিরে, কান্নায়, নির্জনে।
২. আত্মার উৎস স্মরণ
সুফিরা বলেন, মানুষের আত্মা এসেছে লাওহে মাহফুজ থেকে। ‘আলমে আরওয়াহ’-এ আমরা আল্লাহর সান্নিধ্যে ছিলাম। তখনই আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেন:
“আলাস্তু বিরাব্বিকুম?”
“আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?”
আমরা বলেছিলাম: “বালা, নিশ্চয়ই” (সূরা আল আরাফ, ৭:১৭২)
এই হ্যাঁ বলার স্মৃতি হৃদয়ের গহীনে সঞ্চিত থাকে। এই স্মৃতি, এই চিরপ্রেম — মানুষকে আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ করে। এই টানই ‘ইশকের মূল’।
৩. ইশকের প্রকারভেদ: মজাজি থেকে হাকিকি
সুফিরা ইশককে দুই ভাগে ভাগ করেন:
ইশক মজাজি (রূপক প্রেম): পার্থিব প্রেম, নারী-পুরুষ, প্রকৃতি বা সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসা
ইশক হাকিকি (সত্যিকারের প্রেম): আল্লাহর প্রতি প্রেম
মজাজি প্রেম কখনো কখনো ইশক হাকিকির দিকে নিয়ে যায়, যদি তাতে আত্মা জেগে ওঠে। হজরত রাবিয়া বসরী (রহ.) একবার বলেছিলেন:
“হে আল্লাহ! আমি তোমাকে ভয় করিনা জাহান্নামের জন্য, বা স্বর্গের জন্য ভালোবাসিনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি কারণ তুমি ভালোবাসার যোগ্য।”
এই নির্ভেজাল প্রেমই হচ্ছে ‘ইশক হাকিকি’র প্রলেপ।
৪. ‘ইশক’— একটি তাপমাত্রা, একটি অবস্থা
‘ইশক’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে সুফিরা বলেন, এটি এসেছে আরবি শব্দ ‘আশাকা’ থেকে, যার অর্থ গাছের পেঁচানো লতা, যা একবার কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরলে তা না শুকানো পর্যন্ত ছাড়ে না।
তেমনি, ‘ইশক’ একবার হৃদয়ে প্রবেশ করলে তা আত্মাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যে, সে ব্যক্তি নিজেকে ভুলে গিয়ে শুধু প্রেমাস্পদের ধ্যানে বিলীন হয়ে যায়। এটি একটি মানসিক অবস্থা, ‘হাল’, যা উপলব্ধি করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না।
৫. কেন মানুষ আল্লাহকে ভালোবাসে?
সুফিদের মতে মানুষ আল্লাহকে ভালোবাসে পাঁচটি কারণে:
আল্লাহর নূরের আকর্ষণ – হৃদয়ের গভীরে সেই নূরের প্রতি এক আলোকগত টান
দয়া ও করুণা – মানুষ তার প্রতি দয়ার উৎসের প্রতি প্রেম পোষণ করে
জ্ঞান ও উপলব্ধি – যতই আল্লাহকে চেনা যায়, প্রেম ততই গভীর হয়
সুখের সন্ধান – সকল সুখের মূল হচ্ছে পরমসত্তার সংস্পর্শ
সৃষ্টিগত সম্পর্ক – আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা; সৃষ্টির স্বভাবই তাকে ভালোবাসা
৬. হযরত মাওলানা রুমির প্রেমতত্ত্ব
মাওলানা রুমি বলেন:
“তোমার প্রেমের নেশা আমাকে এমন এক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে,
যেখানে আমি আমি নই, আর তুমিও তুমি নও।
শুধু প্রেম বেঁচে থাকে, আমি-তুমি সব ফুরিয়ে যায়।”
রুমির প্রতিটি গজলই এক প্রেমিক আত্মার কান্না, যার ভাষা সঙ্গীত আর ছন্দ।
৭. ‘ইশক’ ও আত্মদহন: ফানা ও বাকা
সুফি পথে ইশক মানে শুধু আবেগ নয়, এটি এক বিপ্লব, আত্মার পুনর্জন্ম। প্রেমিক ধীরে ধীরে ‘ফানা’ হয় — নিজেকে বিলীন করে দেয় প্রেমাস্পদে। তখনই আসে ‘বাকা বিল্লাহ’, আল্লাহতে স্থায়ী হওয়া।
ফানা ফিল্লাহ — আল্লাহর প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ফেলা
বাকা বিল্লাহ — আল্লাহর প্রেমেই স্থায়ী হয়ে যাওয়া
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী বলেন:
“আমি সাগরে নিমজ্জিত হলাম, সে সাগর আমি নিজে ছিলাম না।”
৮. কুরআন ও ইশক
কুরআনে বলা হয়:
“ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল মুতাওয়াক্কিলিন” — আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন
“ইউহিব্বুহুম ওয়া ইউহিব্বুনাহু” — তিনি তাদের ভালোবাসেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসে (সূরা মায়েদা: ৫৪)
এখানে বোঝা যায়, ইশক কেবল বান্দার পক্ষে নয় — আল্লাহও তাঁর প্রেমিক বান্দাদের ভালোবাসেন।
৯. নবীজির (সা.) প্রেম
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন প্রেমের পূর্ণতর রূপ। তিনি ছিলেন ‘হাবীবুল্লাহ’, আল্লাহর প্রিয়।
রাতভর দাঁড়িয়ে কাঁদতেন, কেবল প্রেমের কারণে। নবীজির দোয়াগুলো ছিল এক প্রেমিকের কান্না:
“ইলাহি, আমি তোর জিকিরে তৃপ্ত হইনা, তোর প্রেমে তৃষ্ণা মেটে না।”
১০. রাবিয়া বসরীর প্রেমজ কাব্য
হযরত রাবিয়া বসরীর (রহ.) কবিতায় আমরা দেখি এক প্রেমিকার আর্তি:
“হে আল্লাহ! যদি আমি তোমাকে জাহান্নামের ভয় করে ভালোবাসি,
তবে আমাকে দগ্ধ করো।
আর যদি জান্নাতের আশায় ভালোবাসি,
তবে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করো।
কিন্তু যদি ভালোবাসি শুধু তোমার প্রেমে,
তবে আমার থেকে তোমার নূরকে কভু দূরে কোরো না।”
এ প্রেম আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।
১১. ইশক ও সঙ্গীত: সামা ও কাওয়ালি
সুফিদের কাছে সামা (সঙ্গীত) হচ্ছে ইশকের অদৃশ্য ভাষা। কাওয়ালি, রাগ, দরবারি — এগুলো প্রেমিক আত্মার ঢেউ। যেমন রুমি বলেন:
“সেতারের প্রতিটি তার কাঁদে, কারণ সে ভালোবাসায় ক্ষত-বিক্ষত।”
১২. সমাপ্তি: আত্মার চূড়ান্ত আরাধনা
ইশক শেষ হয় না। এক প্রেম পূর্ণ হলে আরেক প্রেম শুরু হয়। এই পথের শেষ নেই, যেমন আল্লাহর কোনো সীমা নেই। মানুষ আল্লাহকে ভালোবাসে, কারণ এ ভালোবাসাই তার অস্তিত্বের প্রকৃত অর্থ। এবং সুফিদের কাছে জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য একটাই —
“ইশক বিল্লাহ, লি-ইশকিল্লাহ, মিন-ইশকিল্লাহ।”
— আল্লাহর জন্য প্রেম, আল্লাহর প্রেমেই প্রেম, আল্লাহর মাধ্যমেই প্রেম।
শেষকথা:
এই পথ কঠিন, কিন্তু যে একবার এই আগুনে পুড়েছে, সে আর ফিরতে পারে না। সে প্রেমে পুড়ে ছাই হয়, আর সেই ছাই দিয়েই আঁকে আল্লাহ নামের চিত্র।
সুফি প্রেম ও আল্লাহ প্রাপ্তি
আপন খবর একটি সুফি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক লেখালেখির প্লাটফর্ম।