হযরত খাজা কাজী বেনজীর হক চিশতী নিজামী
রাছুলপাক (সাঃ) বলেন, “তুমি যার সমালোচনা করছ মূলতঃ তোমার চরিত্রটিই তার মধ্যে দেখতে পেয়েছ।” এতোগুলো কথা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো একটি কারণেই আমি বলতে বাধ্য হলাম। যারা হায়ানী আত্মার/নফসে আম্মারার গুণÑখাছিয়তে আবৃত তাদের নিকট হতে নারীদের পর্দা করা অবশ্যই জরুরী, সে তার মা অথবা নিজের মেয়ে হলেও। নয়তো হাজার কাপড়ের পর্দার মধ্যে থাকলেও দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের লীলা বন্ধ হবে না। চরমোনাইর নেতা মৌলবী ফজলুল করিমের এক অনুসারী (তাদের ভাষায় মুরিদ) তার নিজের মেয়েকে মামার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলে পথে পাটক্ষেতের মধ্যে নিয়ে ধর্ষণ করেছে (যুগান্তর ও অন্যান্য পত্রিকার সংবাদ)। চরমোনাইর নেতা মৌলবী ফজলুল করিমের অনুসারীরা সৌদিদের মতো লম্বা জুব্বা, টুপি/পাগড়ী পড়ে থাকে। তাদের ভাষায় সুন্নতি লেবাছ। তবে কেনো নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করলো ? কারণ, তার দেহের লেবাছ/পর্দা আছে কিন্তু তার মনের পর্দা ঠিক নেই। আর পশুদের জন্য তো পর্দার নির্দেশ আসেনি।
মনের মাঝে যে পশুটিকে লালন পালন করছে, সেই পশুটিই ধর্ষণ কার্যটি সংঘটিত করছে মানবের বেশে। তাই দেহের সুন্নতি লেবাছ/পর্দাটি উঠাতে/খুলতে বেশী সময় লাগে নি, সাথে মনের পর্দাটি কায়ম থাকলে এমনটি হতো না। জানা দরকার, কর্মটি বাহির থেকে ঘটে না, ভিতরের নির্দেশে কর্মটি হস্ত-পদ, মুখ, কর্ণ দ্বারা পরিচালিত হয়। খোদা তিনটি বিষয় জিজ্ঞাসা করবেন আর তা হলো দীল, কর্ণ এবং চক্ষু (সুরা বনী ইসরাঈল)। যারা ফকির তারা আজীবন পর্দাবৃতই আছে, তারা এ তিনটি বিষয়ের উপর হেফাজতকারী, অন্ধ-মূর্খরা তা জানে না। যদিও কোথাও তার ব্যতিক্রমও দেখা যায়, তারা পীর/ফকির নয়। সেজন্যই কোরানে বলা হচ্ছে, “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অন্যের বন্ধু (সুরা আত্ তাওবা-৭১)।” “মুমিনদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে (সুরা তাওবা-৭২)।”
“নবী এবং মুমিনগণ একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যেই আছে (সুরা আনফাল-৬৪)।” অর্থাৎ তৌহিদে কায়েম হয়ে ‘বাকাবিল্লাহ/ওয়াজহুল্লাহর’ অধিকারী হয়ে আছে। মুমিনগণ নবীকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসে (সুরা আহযাব-৬)। হেদায়েত এবং রহমত (দয়া) একমাত্র মুমিনদের জন্যই (সুরা ইউনুছ-৫৭)। আর হাবিবে খোদা মুহাম্মদ রাছুলকে প্রাণের চেয়েও বেশী মহব্বত করলে আল্লাহর ভালোবাসাও হয়ে যায়। তাতে তার জীবনের সমস্ত গুনাহ্ আল্লাহ মাফ করে দিবেন (সুরা বনী ইসরাঈল-৩১)। মুমিনগণ আল্লাহর দিদার প্রাপ্ত (আচ্ছালাতু মেরাজুল মুমিনীন)। খোদাকে দেখাই হলো মুমিনের নামাজ, ইহাই ছালাতুল মেরাজ। এ হাদিস মোতাবেক মাদ্রাসার আলেম-মোল্লাদের মধ্যে কয়জন মুমিন আছে তা কি ভাবনার বিষয় নয় ! এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়না (আল মুমিনীনা মিররাতুল মুমিনীন)। রূহে ইনছানির অধিকারী মানুষটিই মুমিন, সে নারী বা পুরুষ যে-ই হোক। এরা নফস মুৎমাইন্নাহর অধিকারী/শয়তান/খান্নাছমুক্ত জান্নাতি মানুষ বিধায় তারা পরস্পর একে অন্যের বন্ধু (কোরান দ্রঃ)। তারা পর্দাবৃতই আছে। এ ধরনের মুমিনগণ এশকে ফাসেকীকে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে/করায়ত্ব করে এশকে সাদেকীনে কায়েম আছে বিধায় তাদের মধ্যে কোনো অশ্লীলতা নেই, ইহাই পর্দার হাকিকত। তাদেরই নামাজ (ছালাত) দায়েমীতে কায়েম আছে-ইহাই নামাজের কাজ (কোরান দ্রঃ)। যাক, ইনছানি আত্মার অধিকারী মানুষটিই পুরুষ, তা দৈহিক নারী-পুরুষ যে-ই হোক। দৈহিক আকার-আকৃতিতে তাদেরকেই মুমিন নারী-পুরুষ বলে, মূলতঃ তারা সবাই পুরুষ। যাক, বলাৎকার মানেই বলপূর্বক ধর্ষণ করা। আওয়ামী লীগ সরকার ধর্ষণের বিচার মৃত্যুদন্ড বা যাবৎ জীবন করছে কিন্তু কোন কারণে মাদ্রাসার ছেলেদের বলাৎকারে বিচার করছে না তা বুঝা গেল না।
অজ্ঞ-মূর্খরা ধার্মিক সেজে মসজিদের কমিটি করবে, টাকা আত্মসাৎ করবে, প্রতারণা করবে, সমাজের মধ্যে নেতৃত্ব দিবে/দিচ্ছে, তাতে সমাজের মানুষের অধঃপতন ঘটবে, উচ্ছৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হবে/হচ্ছে। এভাবে মানুষের ঈমান-আকিদাকে ধ্বংস করে দিয়ে অন্ধ-মূর্খ, বধির মানব সমাজ কায়েম হবে/হচ্ছে। তখন ধর্ম শুধু অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে, তাতে কোনো পূণ্য অর্জন হবে না। এখন ইবাদত করো আল্লাহ হাশরের দির সোয়াব দিবেÑএ ধরনের ধোঁকাপূর্ণ কথা সমাজের মানুষকে শিক্ষা দিবে/দিচ্ছে। ‘যাই করো নামাজ পড়’-এ ধরনের কু-মতবাদ শিক্ষা দিবে/দিচ্ছে, হাদিসের মূল অংশ বাদ দিয়ে অপব্যাখ্যা করে প্রচার করবে/করছে “নামাজ বেহেশতের চাবি।” সেজন্যই নামাজে পাপ সৃষ্টি হচ্ছে পূণ্য লাভ হচ্ছে না। কোরান শুধু অক্ষরের (আক্ষরিক বিদ্যার) মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তার কোনো জ্ঞান (মুহকামাত) থাকবে না। বর্তমানে তাই হচ্ছে। রাছুল বলেন, “কেয়ামতের পূর্বে অন্ধ-বধিরদের ফেৎনা হবে/হচ্ছে।” প্রতি মূহুর্তে কোটি কোটি কেয়ামত-পুনরুত্থান সংঘটিত হচ্ছে জ্ঞানীরা তা দেখেন। কোরান মহা জ্ঞান ভান্ডার, আক্ষরিক বিদ্যা দ্বারা বা ডিকশনারী/লোগাত দ্বারা তা কখনো কোনো দিনই বুঝা যাবে না। কোরান বলছে, ‘কোরান পড়ে কেউ পথ পায় আবার কেউ পথ হারায়।” কোরানের মুতাশাবেহাতের অর্থ করে পথ হারায় আর মুহকামাত বুঝে পথ পায়।
অপর দিকে দ্বীনে মুহাম্মদীর তরিকা সম্পর্কে অজ্ঞ (যে নিজকে চিনে নি সে-ই অজ্ঞ-মূর্খ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার থাকুক বা না থাকুক) একদল মূর্খরা পীর সেজে অলিআল্লাহদের পথকে বিকৃত করে চলছে। কিছু কিছু পীর সমাজে দেখা যায় তারা দ্বীনে মুহাম্মদীর প্রতি ঈমানই আনে নি তথা কোনো পীরের/গুরুর নিকট বায়াত গ্রহণই করেনি, কামালিয়াত বা ইলমে সিনা অর্জন করবে দূরের কথা। তারা পীর সেজে সমাজের সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে চলছে। আরেক দল আছে তারাও বেমুরিদান, ওরা লাল কাপড় পড়ে/সংক্ষিপ্ত কাপড় পড়ে খাজা বাবার নামে গাজা বাবার ভক্ত সেজে গাজা খেয়ে চলছে এবং খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাঃ)-এর নামে ওরশ মাহফিল করে চলছে, আর অশ্লীল কাফেলা গানের ব্যবস্থা করে হাজার হাজার টাকা কামিয়ে গাজা খাওয়ার পুঁজি-রুজির ব্যবস্থা করছে। ওরশের সময় পথভ্রষ্ট কিছু লোক পবিত্র মাজার বা রঁওযা শরীফের আশে পাশে বসে নানা রকম নেশাদ্রব্য বিক্রি করছে, খাচ্ছে। তাতে মাজারের পরিবেশ-পবিত্রতা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের ক্রিয়া-কর্ম হতে মৌলবাদিরাও সমালোচনা করার ফায়দা লুফে নিচ্ছে। আরেক দল ওরা কারো মুরিদ নয়, হয়ও না তারা বিগত যুগের কোনো অলির আশেকীন বলে দোহাই দিয়ে পীর সেজে মানুষকে বিপদগামী করছে। আবার এক ধরনের মতলববাজ লোক রয়েছে যারা তাদের পীরের ইন্তেকালের কিছু দিন পরেই বলে বেড়ায় তাকে তার পীরে স্বপ্নে খেলাফত দান করেছে। এ কথা ২/৪ জনের নিকট প্রকাশ করে সে পীর সেজে বসে, আর কাফেলা গানের ব্যবস্থা করে মেয়েদের অশ্লীল নৃত্যগীত প্রদর্শণ করে টাকা কামানোর ধান্ধায় থাকে।
এ ধরনের পীরগুলো তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মৌলবী লেংড়া ইলিয়াছের মতো, সেও স্বপ্নে তাবলিগের নিয়ম-পদ্ধতি লাভ করছে বলে দাবী করছে। পেয়েছে স্বপ্নে অথচ প্রচার করছে বাস্তবে। এ ধরনের প্রতারক পীর ও মৌলবী ইলিয়াছের প্রচারটিও যদি স্বপ্নে হতো তবে মানুষ তাদের ধোকা-প্রবঞ্চনা হতে রক্ষা পেতো। স্বপ্নে বিয়ে করে কেউ বউ পেয়েছে কি না, স্বপ্নে সহবাস করে কেউ বাচ্চা পেয়েছে কি না – ইহা বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য বুঝা কোনো দূর্বোধ্য বিষয়ই নয়, আর নির্বোধদের ব্যাপারে কিছু বলার নেই। এ ধরনের বহু পীর (?) আমাদের সমাজে দেখা যায় যাদের মধ্যে তরিকার কোনো ধ্যান-ধারণা নেই, নেই ইলমে সিনার সাথে কোনো পরিচয়। যে সমস্ত মাজার বা রঁওযা ঘিরে এ সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম সংঘটিত হয় সে সমস্ত মাজার বা রঁওযাগুলোর পবিত্রতার রক্ষার জন্য সবারই এগিয়ে আসা উচিত। অনেকে কিছু সহজিয়া বৈষ্ণব বাউলদের এবং ২/৪ কথা সুফিদের মধ্য হতে শিখে জগা খিচুরী তত্ত্ব সৃষ্টি করে তাদের অনুসারীদের মধ্যে প্রচার করে চলছে। তরিকাকে যেমন বিকৃত করছে মোল্লা পীর এবং রাজনৈতিক পীরেরা তেমনি বিকৃত করছে এ ধরণের ইলমে সিনা বিবর্জিত বেমুরিদান একদল পীরেরা, কবিরাজি পীরেরা, রাজনৈতিক পীরেরা। ধর্ম জ্ঞান বিবর্জিত কিছু সাংবাদিক কবিরাজদেরকেও ‘ফকির’/পীর বলে সম্ভোধন করে তাদের বিকৃত ঘটনার কথা পত্রিকায় প্রকাশ করতে দেখা যায়।
ফকির আর কবিরাজের মধ্যে কি প্রভেদ সে সম্পর্কে ওরা একেবারেই বেখবর। দ্বীন ইসলামের তরিকা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে তাদের দ্বারাও বিকৃত প্রচার চলছে। সাধারণ কিছু লোকের মুখে শোনা যায় তারা কবিরাজদেরকে ‘ফকির’ সম্বোধন করছে, ইহা তাদের অজ্ঞতার কারণেই হয়। তারা ‘ফকির’ কাকে বলে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। ‘ফকিরদের’ কথা কোরানের বেশ কয়েক জায়গাই তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে সুরা বাকারার ২৭৩ নম্বর আয়াতটি উল্লেখ্য যোগ্য। ‘ফকির’ অনেক উচ্চস্তরের একটি কথা। যিনি আল্লাহর ফেৎরাতে (সিফগাল্লাহয়) কায়েম হয়ে ওয়াজহুল্লাহর অধিকারী হয়েছেন তথা বাকাবিল্লাহধারী তিনিই ফকির।
ফকিরদেকে/পরকালপ্রাপ্তদেরকে (লিলফুকারাই) সাহায্য- সহযোগীতার করার জন্য খোদা নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন কোরানে। ফকিরগণই আল্লাহর রাস্তার মধ্যে (ফি সাবিলিল্লাহি) অবরুদ্ধ হয়ে আছে, তারা মানুষের নিকট কিছু চায় না, তাদের জন্য কিছু (টাকা-পয়সা বা অন্যান্য নজর নেওয়াজ) ব্যয় করার কথা সুরা বাকারার ২৭৩ নম্বর আয়াতে বিধৃত আছে এবং তা অতি উত্তম বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা ফকিরদেরকে/গুরুকে কিছু অর্থ-সম্পদ দিচ্ছে তা মূলতঃ আল্লাহপাকই দিচ্ছেন। হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রাঃ) একদিন তাঁর ভক্তদেরকে বলছেন, “মনে করো না তোমরা আমাকে কিছু দেও, না আল্লাহপাকই দেন, তোমাদের মাধ্যমে দেন।” তাতে পূণ্যটা আল্লাহপাক তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেন। বুঝা গেল অলি আল্লাহর/ফকির/গুরুর খেদমত, তাকে নজর-নেওয়াজ পেশ সে-ই করতে পারে আল্লাাহপাক যার প্রতি দয়া করেন, করুণা করেন, অলি-আউলিয়ার খেদমত করে পূণ্যার্জনের তৌফিক দান করেন। আমলে আমালিয়াত আর খেদমতে মিলে কামালিয়াত।