লেখক – আহমেদ কামরুল মোর্শেদ
বস্তুবাদী সমাজ যখন পারিবারিক পরিমন্ডল, আত্মীয়তার বন্ধন, সামাজিক দায়-দায়িত্ব সব ছুড়ে ফেলে আত্মরমণে বুঁদ হয়ে থাকে, তখনও আত্মপরিচয় অনুসন্ধানী চিন্তাশীল যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম হয় না। সভ্যতার বিকাশের পথে সর্বযুগেই এ কথাটি কমবেশি সত্য বলে প্রযোজ্য।
কিন্তু অনাদিকাল থেকেই সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো পথ, সমুন্নত মতাদর্শের কোনো দর্শন তথা লোকোত্তর দর্শন কোনো অবস্থায় কখনোই যেনো কোনো সমাজের পূর্ণ আস্থা, দৃঢ় বিশ্বাসকে সংহত অবস্থায় ধারাবাহিক ভাবে দীর্ঘকাল একত্রিত করে ধরে রাখতে সক্ষমতা অর্জন করছে না।
কারন কায়েমি স্বার্থ বিবিধ পন্থায় অপরিনামদর্শী আত্মকেন্দ্রিক নীতিহীন ভোগবাদিতাকে সুকৌশলে মুখোশের অন্তরালে অথবা প্রকাশ্য বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক তথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজস্ব হীনস্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে বারবার সফল হয়েছে এবং মানবমন্ডলীর পরিশুদ্ধ চিন্তাশীলতাকে সর্বদাই এক প্রকার গ্রাস করে ফেলেছে। এরই কুফল এখন মহামারীর মতো ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনাকে পর্যন্ত সর্বত্রই প্রায় সমভাবে যেন গ্রাস করে চলেছে।
অথচ মহাকালের স্রোতে মানব সভ্যতার বিকাশের ধারাটি এখন এক তীক্ষ্ণ বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত বস্তবাদী বিজ্ঞানের বিস্তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া দ্বারা এখন গোটা বিশ্ব প্রকৃতিকে বিশাল হুমকির মুখে এনে ফেলেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা সর্বত্রই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। পারমাণবিক মরনাস্ত্র বিশ্ব মানবতাকে জিম্মি করে ফেলেছে।
অন্যবিচারে পৃথিবি এখন বর্ধিত জনসংখ্যায় ভারবাহনে নাভিশ্বাস তুলছে। বিকল্প ঠিকানা খুঁজতে বিজ্ঞান যখন মহাকাশ অভিযাত্রার প্রতি মনোনিবেশ করেছে, তখনও মানুষ নিজ মনোদৈহিক বিজ্ঞানকে পূর্ণাঙ্গ অথবা বিকশিতভাবে বুঝতে অক্ষম অবস্থাতেই পড়ে আছে।
মহাকাশকে জয় করতে আগ্রহী মানবসভ্যতা নিজ মনাকাশকেই এখনো তেমন একটা বুঝতেই পারেনি। যদিও দেহের কর্তৃত্ব প্রকৃতপক্ষে মনের নিকট, অথচ দেহই যেন মনকে করায়ত্ব করে রেখেছে। আবার দেহের কারাতুল্য সীমাবদ্ধতা এবং দেহধারনের অবমাননাকর বাধ্যবাধকতাকে অতিক্রম করার চিন্তা – চেতনা কখনোই তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না।
আমরা জানি দেহকে কেন্দ্র করেই দীর্ঘ বিবর্তনে মানবসত্তার বর্তমান মানসিক উৎকর্ষতাটি বিকশিত হয়েছে। মানবীয় ইন্দ্রিয়সমুহ দেহপাঠ সাপেক্ষে অতীন্দ্রিয়তায় উদ্ভাসিত হবার সক্ষমতাকে সংরক্ষন করে। দেহকে পাঠ করার প্রয়াসে দৈহিক চাহিদাসুহকে সূক্ষ পরিণামদর্শী মন দ্বারা বিচার করা প্রয়োজন হয়।
অর্থাৎ নিমগ্ন মনে দেহের মধ্যে ভ্রমন করার অভ্যাসকে অর্জন করতে হয়। মনোদৈহিক সুসাম্যতাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং নিবিড় আত্ম-অনুসন্ধান করা ব্যাতিত মানবসত্তার দেহ ধারন কখনো অর্থপূর্ন হতে পারে না।
বিগত কয়েক হাজার বছর যাবত উপরোক্ত প্রসঙ্গে মহামতি লালন এবং সমমানের অন্যান্যরা বাংলা তথা ভারতবর্ষ ও সংলগ্ন ভৌগলিক পরিমন্ডলে তাঁদের অসামান্য দেশনার আলোকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করে রেখেছেন। অবশ্য বিগত কয়েকশত বছর জুড়েই এর বিপরীতে বিশ্বব্যাপী যন্ত্রসভ্যতার পুঁজিবাদী ভোগবাদিতা প্রবল গতিতে গোটা মানবসভ্যতাকে যেন কার্যত গ্রাস করে রেখেছে। যার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া উপনিবেশবাদী শক্তিদের দ্বারা ভারতবর্ষেও বিস্তার লাভ করেছে।
পুঁজিবাদী ভোগবাদিতা আজকে যখন পরিণামে মানব সভ্যতাকে যাবতীয় ভোগান্তিতে প্রানান্তকর করে তুলেছে, আত্মপরিচিতি তথা অধ্যাত্মবিদ্যার প্রয়োজনিয়তাকে তখন নিরেট বস্তুবাদীরাও স্বীকার করে নিতে একপ্রকার বাধ্য হচ্ছেন। যদিও তাদের চিন্তার পরিধি কেবল ঐহিক সীমানায় সীমাবদ্ধ, তথাপিও শ্রেণিহীন মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় কেউ কেউ পারত্রিক তাৎপর্যকেও এখন কমবেশি বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
উপর্যুক্ত প্রেক্ষাপটে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণি ইত্যাদি বিভাজনে বিভক্ত গোটা মানব সভ্যতাকে একটি কাঙ্খিত সাম্যতার ভিত্তিতে সুষ্ঠ পরিণতি প্রদানের মাধ্যমে মহামতি লালন প্রদত্ত দেশনাবলী খুবই কার্যকর একটি পথ-পদ্ধতি বলে প্রতীয়মান হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, মহামতি লালন দেশনায় দৃশ্যত আত্মদর্শন, নিজ দেহমনকে পাঠ বা নিজেকে পরিপূর্ন জানার মাধ্যমে প্রকৃতার্থে বিশ্ব-ব্রম্মান্ডের সৃষ্টিরহস্য এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কটিও নিরুপনের দিকনির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। লালন গীতিকবিতার সামগ্রিক একটি রুপরেখার নিবিড় পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে তা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।
আরো উল্লেখ্য যে, উনিশ শতকে অবহেলিত গ্রামীন বা সমগ্র বাংলায় লালন গীতিকবিতার মর্মার্থকে সম্যকভাবে উপলব্ধি এবং আত্মস্থ করার সংকুচিত পেক্ষাপটটি একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কারনে বিপুলভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী অনুসন্ধানী পাঠকমাত্রই আজ লালন চেতনাকে সম্যকভাবে উপলদ্ধি করার জন্য সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রবর্তী ধ্যান ধারনার আলোকে বিচার-বিশ্লেশনের সুযোগ লাভ করেছে।
ফলে লালন দেশনার নিগূঢ় মমার্থটি উদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি ব্যাপক সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। লালন গীতিকবিতার নিবিড় পর্যবেক্ষণে আবহমান বাংলার প্রবাহিত মরমিধারা বা সুফিবাদী ধ্যান ধারনার একটি বিকশিত ক্ষেত্রও তাই উন্মোচিত হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, নিরাকার থেকে সাকারের প্রলম্বিত পরিভ্রমনটি যে পরিশেষে নিরাকারেই প্রত্যাবর্তনের একটি সুনির্দিষ্ট বিধান এবং এটি সৃষ্টিতত্বের বিকাশ বিজ্ঞান দ্বারা বিশ্ব প্রকৃতিতেই বিরামহীন ভাবে বিধৃত, এরকমটা অনেকেই এখন খোলামেলা ভাবেই বলেছেন।
মানব সত্তার মনোদৈহিক প্রকৃতিতে সম্যক পাঠের মাধ্যমে কার্যত গোটা বিশ্বপ্রকৃতিকেই পাঠ করা সম্ভবপর, এটাও ইদানিং কেউ কেউ বলছেন। অথবা এসব কথা এখন অধ্যাত্মবাদীদের কাছে অন্তত মোটেই নতুন কিছু নয়। বস্তুবাদ এবং অধ্যাত্মবাদ এই সমন্বিত চিন্তা যেন মহামতি লালন দেশনায় বেশ স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান। লালন পন্থি সাধকরা এখন সেরকমটাই প্রকাশ্যে অথবা প্রকারন্তে বলছেন। লালন দেশনা হৃদয়ঙ্গমে মানবসত্তার প্রতি বিশ্বপ্রকৃতিতে প্রযুক্ত নিজ দায়িত্বটিও যেন সম্যকভাবে পরিফুষ্ট হয়ে ওঠে।