লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী
মাঝে মাঝে পৃথীবিতে আবির্ভূত হয়েছেন এমন কিছু শক্তিমান সত্ত্বা, যারা জগত কে শিখিয়েছেন প্রভুপ্রেম। ‘আপনি আচরি ধর্ম’ তারা সকলকে দিয়েছেন শিক্ষা। প্রভুপ্রেমের মশাল প্রজ্জলিত করেছেন দ্বিগ্বিদিক। তেমনি একজন প্রভুপ্রেমিক, মহিমান্বিত সত্ত্বা, তাপসী রাবেয়া বসরী (র)।
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম – রাবেয়া বসরী আল আদাবিয়া (র)
উপাধি – আল বসরী
জন্মস্থান- ইরাকের বসরা নগর
জন্ম – ৭১৩ খ্রি.
পিতার নাম – ইসমাঈল
মাতার নাম – মায়ফুল
গুরু – ইমাম হাসান বসরী আল আনসারী
ওফাত – ৮০১ খ্রি. জাতীয়তা – আরবীয়
জীবনী
অত্যন্ত দরিদ্র পিতার সংসারে আগমন হযরত রাবেয়া বসরী (র) এর। নিদারুণ অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত হচ্ছিল তাদের। যে রাতে রাবেয়া বসরী (র) জন্ম নিলেন, রাতের অন্ধকারে ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর তেলটুকুও ছিলনা তাঁদের। রাবেয়া বসরী (র) এর পিতা ইসমাইল তেলের সংস্থান করতে ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসেন ঘরে। স্ত্রীর অনুরোধে তেল ধার করতে যান প্রতিবেশীর কাছে। কিন্তু তেল দেয়া তো দূরের কথা, ঘরের দরজাই খুললেন না প্রতিবেশী। অশ্রুসজল নয়নে বাড়ি এসে কিছু সময় পর তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখেন, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা) এসে তাঁকে সান্তনা দিচ্ছেন। বলছেন, দুঃখ কোরো না, অচিরেই তুমি এক মহীয়সী কন্যা সন্তানের জনক হতে চলেছো। ভবিষ্যতে সে জগতের এক অত্যুজ্জল নক্ষত্রে পরিণত হবে।
স্বপ্ন যোগে রাসুলুল্লাহ (সা) তাঁকে লিখিত একটা চিরকুট নিয়ে বসরার আমির ঈসার নিকট যেতে বললেন। চিরকুট টিতে লেখা ছিল, “হে আমির ঈসা, তুমি প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় একশত বার দরুদ পাঠ করো, আর জুমুয়ার রাতে পাঠ করো চারশত বার। যেহেতু এই জুমুয়ার রাতে তুমি চারশত বার দরুদ শরীফ পাঠ করো নি, তার ক্ষতিপূরণ স্বরুপ চারশত দিরহাম দান করে দাও।”
ঘুম ভেঙে গেলো রাবেয়া বসরী (র) এর বাবা ইসমাইলের। স্বপ্ন অনুসারে তিনি কথাগুলো চিরকুটে লিখে চলে গেলেন বসরার আমীর ঈসার নিকট। চিরকুটের লেখা পড়ে চমকে উঠলেন আমীর। নবী কারীম (সা) এর উপদেশের কৃতজ্ঞতা স্বরুপ দশ হাজার দিরহাম দান করলেন। আর পত্রবাহক কে দিলেন চারশ দিরহাম।
পিতামাতার কোলে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো রাবেয়া বসরী। কিন্তু প্রভুর মর্জি! ছোটবেলাতেই চিরবিদায় নিলেন গর্ভধারীনি জননী। কিছুদিন পর বিদায় নিলেন পিতা। চারটি অনাথা বোন নিয়ে অকূল সাগরে পতিত হলেন রাবেয়া বসরী (র)।
চলতে থাকলো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। মা-বাবা নেই। এতগুলো জীবনের ভরনপোষনের জন্য শুরু হলো কঠিন জীবন সংগ্রাম। চার বোন মিলে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করতে লাগলো। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে! এমন সময় বসরায় দেখা দিলো দূর্ভিক্ষ! এখন আর কেউ কাউকে না নেয় কাজে, না দেয় খেতে! দুর্ভিক্ষ এমন পর্যায়ে গেলো যে, পিতা মাতারাও নিজেদের সন্তানদের বিক্রি করে দিতে শুরু করলেন। জীবন বাঁচানো অনেক কষ্টকর হয়ে উঠলো। এমন দুঃসময়ে রাবেয়া বসরী (র) এর তিন তিনটি বোনই কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। অনেক খুঁজেও তাদের আর হদিস পাওয়া গেলো না। এবার রাবেয়া বসরী (র) এই বিশাল পৃথিবীর বুকে হয়ে পড়লেন সম্পূর্ণ একা।
নিঃসঙ্গ রাবেয়া বসরী। কান্নাকাটি করে কাটতে লাগলো দিনের পর দিন। হঠাৎ এক পাষন্ড এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেলো রাবেয়া বসরী (র) কে। দাসী কেনাবেচার হাটে নিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দিলো ততোধিক পাষান হৃদয় এক ব্যক্তির নিকট।
ক্রীতদাসীতে পরিণত হলেন রাবেয়া বসরী (র)। দিন রাত কাজ করে গৃহস্থ মনিবের বাড়িতে। কাজে একটু এদিক ওদিক হলেই কপালে জোটে নির্মম প্রহার! নির্যাতন! কোথাও এক ফোঁটা আদর নেই, ভালোবাসা নেই! বুক ভরা গঞ্জনা, পীড়ন আর অত্যাচারের ভয় নিয়ে দিন কাটে নাবালিকা রাবেয়ার! একটা সময় সব কিছু সহ্যের বাইরে চলে যায়!
মনিবের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান রাবেয়া বসরী (র)। রাতের অন্ধকারে মুক্তির নেশায় বিভোর হয়ে দৌঁড়াতে থাকেন পথে পথে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হঠাৎ আচমকা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। সম্পূর্ণরুপে ভেঙে যায় একটি হাত!
তীব্র যন্ত্রনায় গোঙাতে থাকেন রাবেয়া বসরী (র)। ভাঙা হাত নিয়েই প্রভুর দরবারে হাত তুলেন তিনি। কান্নাবিজড়িত কন্ঠে প্রার্থনা করেন, “ হে প্রভু আমার! আমি এক অসহায় দাসী! সমগ্র জগত যদি আমার ওপর বিরুপ হয়, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কেবল আপনি আমার উপর প্রসন্ন থাকলেই আমি খুশি।”
প্রার্থনা অঢেল প্রশান্তি এনে দেয় রাবেয়া বসরী মনে প্রাণে। হৃদয়ে স্বস্তি জাগে তাঁর। ভাঙা হাত নিয়ে এখন কি করবেন তিনি? ধীর পায়ে ফিরে চললেন আবার সেই মনিবের বাড়ি। হোক মনিব নিষ্ঠুর! তবু তো একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে!
এখন থেকেই শুরু হলো রাবেয়া বসরীর উপাসনার জীবন। সারাদিন কাজ করেন তিনি। সারারাত জেগে জেগে কাটান প্রভুর উপাসনায়।
হঠাৎ এক মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যায় রাবেয়া বসরী (র) এর মনিবের। অস্পষ্ট কিছু কথার গুঞ্জন শুনতে পান তিনি। গভীর অন্ধকারে কার কথার শব্দ? খুঁজতে যেয়ে দেখতে পান রাবেয়া উপসনা করছে। আকুল স্বরে প্রার্থনা করছে প্রভুর দরবারে। রাবেয়া আকুল প্রার্থনা শ্রবণ করে মন গলে যায় মনিবের। প্রার্থনাগুলো হৃদয় স্পর্শ করে মনিবের নিষ্ঠুর হৃদয়ে। তার মনে হয়, এ কোনো সাধারন দাসী বাদী নয়। এর মধ্যে রয়েছে ঐশ্বরিক ক্ষমতা।
পরদিন সকালবেলাতেই মনিব মুক্ত করে দেয় রাবেয়া বসরী (র) কে। এবার রাবেয়া বসরী মুক্ত। নিজের সম্পূর্ণ জীবন কে তিনি উৎসর্গ করলেন প্রভুর ইবাদত-উপসনায়। মগ্ন হলেন ধ্যানে। ধ্যান সাধনাতেই কাটতে লাগলো তাঁর সমগ্র দিন রাত।
মাঝে মাঝে যেতেন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ তাপস ও বিখ্যাত অলী হযরত খাজা হাসান বসরী (রা) এর নিকট। খাজা হাসান বসরী (রা) এর নিকট মুরীদ হয়ে তাঁর নির্দেশিত পথে শুরু করলেন ধর্মসাধনা। নির্জন বনভূমিতে একটা উপাসনালয় নির্মাণ করে তিনি বাদবাকী জীবন সেখানেই কাটান। আর লিপ্ত থাকেন প্রভুর নাম কীর্তন আর ইবাদতে।
সারা জীবনে তাঁর থেকে প্রকাশিত হয় নানান অলৌকিক ঘটনা। রাবেয়া বসরী (র) এর দরাবারে যাতায়াত ছিল তৎকালীন প্রায় প্রত্যেক অলী আউলিয়ার। একনিষ্ঠ আল্লাহপ্রেম, নির্জনতা, আর দুনিয়ার মোহমুক্ত জীবনের আদর্শ হলেন হযরত রাবেয়া বসরী (র)।
শেষ জীবনে তিনি চলে যান মক্কায়। সেখানেই তাঁর আলোকিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ মহিমান্বিতা মহাতাপসীর আলোকোজ্জল জীবনের বিচিত্র পরিচয় ছড়িয়ে আছে খোদাপ্রেমের পথিকদের হৃদয় জুড়ে। প্রভুপ্রমের যে আলোকবর্তিকা তিনি জ্বেলেছেন, তা চিরকাল অম্লান থাকবে সকল প্রভুপ্রেমিকের হৃদয়ে।
রচনাকাল – 09/08/2021
লেখক – লাবিব মাহফুজ চিশতী